Published : 07 Feb 2022, 07:29 PM
আমার শৈশবে পাশের বাড়ির জোরালো শব্দের ট্রানজিস্টারে ভেসে আসতো এক মায়াবি কণ্ঠ। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার পেছনে বাড়তি খরচ জোগাতে অযথা ব্যয় কমানোর কারণে তখনো রেডিও আসেনি আমাদের ঘরে। ফলে গান শোনার জন্য ওই ট্রানজিস্টারই ছিল ভরসা। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক সুর পাগল মানুষ। তখনকার দিনে সুর ও বাণী- দুইয়ের জন্য নির্ভর করতে হতো ছোট ওই যন্ত্রটির ওপর। বেতারে ইথারে ভেসে আসা মায়াবি সেই কণ্ঠটি যে কার তা না জানলেও সে বয়সেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম তার। কালক্রমে পাড়া-মহল্লায় শুরু হয়েছিল মাইকের ব্যবহার। বিশেষ করে পূজা বা কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে মাইকের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। অনিবার্যভাবেই তার কণ্ঠ দিয়ে শুরু ও শেষ হতো এসব অনুষ্ঠান।
প্রথম বাংলা গানটি তিনি গেয়েছিলেন আমার জন্মের বছর ১৯৫৯ সালে। অর্থাৎ ৬২ বছর আগে। এখনো আধুনিক সে গান। 'না যেও না রজনী এখনো বাকি আরও কিছু কথা বাকি'- গানটি শুনে দেখুন। মনে হবে আধুনিক কালের কোন শিল্পী গাইছেন। এই জাদু আর জাদুবাস্তবতাই ছিল তার ক্যারিশমা। খুব সহজে বিখ্যাতজনদের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে না। সরস্বতীর বর পেতে হলে কষ্ট আর লাঞ্ছনা পোহাতে হবেই। খুব সহজে যারা তরতর করে ওঠেন ততোটা সহজেই পতন হয় তাদের। আর যারা তার মতো, তাদের শুরুটা বা পথচলা যত কঠিন ভবিষ্যত বা কীর্তি ততোই উজ্জ্বল । ইতিহাস বলছে:
এক মারাঠি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি, ১৯২৯ সালে। নাম ছিল তার হেমা। কিন্তু বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর সেই নাম পরিবর্তন করে রাখেন লতা। 'ভব বন্ধন' নামে একটি নাটক ছিল, যার একটি চরিত্রের নাম ছিল লতিকা। সেই থেকে লতা।
বাবাকে বেশি দিন পাননি লতা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবার চলে যাওয়া দেখেছিলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি। বড় এক সংসার, তাই বড় বোন হিসেবে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল লতাকে।
১৯৪২ সালে মারাঠি ছবি 'কিতি হাসাল'- এ প্রথম গান করেছিলেন লতা। শুরুটা যে খুব ভালো ছিল তা নয়। যখন প্রথম সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দার তাকে পরিচালক শশধর মুখার্জির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তখন লতার গান শুনে তিনি বলেছিলেন, 'বেশি চিকন গলা। এমন কণ্ঠ প্লেব্যাকের জন্য নয়।' সে কথা মানেননি গুলাম হায়দার। বলেছিলেন, 'একদিন পরিচালকেরা এই মেয়ের পায়ে পড়ে তাদের চলচ্চিত্র মহল গান গাওয়ার জন্য ভিক্ষা করবে।' গুলাম হায়দার কোত্থেকে এত বড় সত্য উচ্চারণ করার শক্তি পেয়েছিলেন, সেটা ভেবে অবাক হতে হয়।
ওস্তাদ আমানত খানের কাছে তালিম নেওয়ার পর তিনি নিতান্ত জীবনের প্রয়োজনে গান গাইতে এসেছিলেন। বাধা-বিপত্তি আর প্রতিবন্ধকতা কিছুই তাকে ঠেকাতে পারে নি। পারার কথা না। কিছু মানুষ আছেন যাদের মূলত প্রকৃতি বা ইতিহাস বেছে নেয়। এরা না থাকলে ইতিহাস নিজেই আসলে তার স্বরূপ বা ভালোবাসা নিয়ে মাথা তুলতে পারে না। আপনি ভাবুন মীনা কুমারী থেকে কাজল, কতোগুলো জেনারেশনের নায়িকারা তার গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন। শুধু কি ঠোঁট মেলানো- এরা তো বিখ্যাতও হয়েছেন তার গানের জন্য।
যৌবনের শুরুতে জিনাত আমনের দেহবল্লরী আর লতার 'সত্যম শিবম সুন্দরম' আমাদের কাছে মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠেছিল । সে ছায়াছবিটি আমি দেখেছিলাম কলকাতার সিনেমা হলে। তার তিরিশ বছর পর সিডনির সিনেমা হলে দেখেছিলাম 'কাভি খুশি কাভি ঘম'। নায়িকা বদলে গেছে, কাহিনী পাল্টে গেছে। নায়িকা জয়া ভাদুড়ি হয়ে গেছেন মা। কিন্তু গানের শিল্পী একই। সেই লতাজি। সেই সুরেলা অসাধারণ কন্ঠ। আর সে রকমের জনপ্রিয়তা। এটা সবাই পারে না। তাকে নিয়ে একটি লেখায় পড়লাম:
"দেখা কি হয় সেসব মানুষদের সঙ্গে? তাদের আবির্ভাব ঘটে। আর তারা একটা সাধারণ রক্তমাংসের শরীর ছেড়ে অনন্ত হয়ে যান। যাতে আমাদের সঙ্গে তাদের যুগ-যুগান্তর দেখাশোনা হতে পারে, কথা চালাচালি হতে পারে।"
তিনি-ই প্রথম দেখা মকবুল ফিদা হুসেনের সরস্বতী, যিনি দেবী কি ঈশ্বরী নন, জীবন্ত শরীরী এবং এক অনন্ত বিরহিনী রাধা। যিনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন জীবনের গান। তা না হলে কি এত প্রেম, এত বিরহ, এত পূর্বরাগ, এত অভিসার অবলীলায় বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে পারতেন। আমি চুপ করে বসে সেই রাঁধা-রানিকে দেখছিলাম। লতা মঙ্গেশকরকে কেন্দ্র করে সলিল চৌধুরী নাইট, একের পর এক গান। কখনও 'এ নদীর দুই কিনারে' কখনও 'আ যা রে পরদেসি' হয়ে 'না মন লাগে না' থেকে 'কেন কিছু কথা বলো না', এভাবেই 'না জানে কিউ' ছুঁয়ে আরও কত গানে আমাদের গ্র্যান্ড হোটেলের রিহার্সাল রুমকে মোহিত করে তুলেছেন। দেখেছিলাম প্রতিটা মিউজিশিয়ানের চোখে কী অসম্ভব শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
এটা তো হবেই। তিনি এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন এবং তার গাওয়া মোট গানের সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি। এছাড়া ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষাতে ও বিদেশি ভাষায় গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ডটি তারই।
১৯৮৯ সালে ভারত সরকার তাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত করে। তার অবদানের জন্য ২০০১ সালে তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ভারতরত্নে ভূষিত করা হয়; এম এস সুব্বুলক্ষ্মীর পর এই পদক পাওয়া তিনিই দ্বিতীয় সংগীতশিল্পী। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাবে ভূষিত করে।
তিনি ৩টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, ৪টি শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ২টি বিশেষ ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে সংগীত পরিবেশন করেন।
এসব হিসেব-নিকেশের গল্প। এই অর্জন, পুরস্কার ও পদকের অনেক ওপরে তিনি। তার মতো সম্মান বা ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বললেও কম বলা হয়। আপনি যদি তার জীবনের দিকে ফিরে তাকান দেখবেন এ ছিল কর্ম আর ঈশ্বরের যৌথ মেলবন্ধন। লতা মঙ্গেশকার এর মূল্যায়ন বা তাকে নিয়ে আলোচনা করার সাধ্য আমাদের নাই। নাই উপমহাদেশের বহু সঙ্গীতজ্ঞেরও । তিনি সেই কুসুম যা ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিচয় সূত্র। আপনি যখন উপমহাদেশে কিংবা দেশের বাইরে তখন আপনাকে চেনার সূত্র কী কী? তার একটি শাখা সংস্কৃতি আর সে শাখার মূলধারার পুরোধা গায়িকা লতা। বাঙালি না হয়েও দরদ আর মায়ায় বাঁধা গানে যুগ থেকে যুগ, কাল থেকে কালান্তরে 'ও মোর ময়নাগো কার বিহনে তুমি একেলা' বা 'গোপীজন মনচোর গিরিধারী নাগর' গানগুলো শুনে চোখে পানি আসবেই মানুষের। হঠাৎ করে আনন্দে মেতে উঠবে চোখমুখ বাইরে যখন লতা কণ্ঠে চলছে- 'গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি, আমায় চমকে দাও চমকে দাও চমকে দাও…।'
আজীবন বুকে চমক দিয়ে যাওয়া লতাজীকে বিদায়ী প্রণাম ।
সিডনি