Published : 10 Aug 2021, 01:41 AM
খেলার মাঠ শুধুই ছেলেদের?:
আমরা দুইবোন। ছোটবেলা থেকেই খেলনা হিসেবে পেয়েছি পুতুল আর হাঁড়ি-পাতিল। আমরা একসাথে বাসার বারান্দায় বা ছাদে যখনই খেলেছি তখন দেখেছি রাস্তায় অনেক ছেলেরা ফুটবল খেলত, ক্রিকেট খেলত। কিন্তু আমরা কখোনোই বাসার বাইরে খেলিনি। বল বা ব্যাটও পাইনি খেলনা হিসেবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেদের খেলতে দেখতে ভালোই লাগত। আমারও বাইরে খেলতে ইচ্ছে করত। কিন্তুই এটাই দেখে এসেছি যে, খেলার মাঠে খেলাধুলা করে শুধুই ছেলেরা।
মেয়েরা ছোট বয়সে বাইরে একটু খেলার সুযোগ পেলেও দশ-এগারো বছর বয়সে পা দিলে মাঠে গিয়ে খেলার সুযোগটা হারিয়ে ফেলে। তখন পরিবারও তাদেরকে ঘরবন্দি করে রাখে। মাঠগুলোও ছেলেদের একক দখলে থাকায় মেয়েরা খেলতে পারে না। নানা রকমের কথাবার্তা শুনতে হয়। এমনকি মেয়েরা খেলতে গেলে তাদের অভিভাবকদেরও অনেক সময় কথা শুনতে হয়। মেয়েরা কেন বাইরে বের হবে, দোকানে কেন যাবে ইত্যাদি কতকিছু।
ছেলেরা খুব ভালো খেলাধুলা করলে অনেক সময়ই পরিবার থেকে তাকে উৎসাহিত করে। কিন্তু একটি মেয়েও যদি ভালো খেলে, তখন পরিবার তাকে খুব একটা উৎসাহিত করতে চায় না। বরং তাকে খেলা থেকে বিরত রাখতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে দেখেছি। অথচ উন্নত বিশ্বে দেখি মেয়েদের কত কত অর্জন। অলিম্পিকের মতো আসরেও মেয়েদের কত স্বর্ণজয়ের গল্প পড়ি পত্র-পত্রিকায়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী প্রতিটি শিশুকে দিনে অন্তত এক ঘণ্টা বাইরে খোলা হাওয়ায় খেলাধুলা করার পরামর্শ দেয়। বাংলাদেশ রাজধানী ঢাকায় সেই সুযোগ পায় ২ শতাংশের কম শিশু। তাদের বেশিরভাগই ছেলে। আর ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য মহানগর বা শহরে এই হার কত, তার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। পরিস্থিতি যখন এমন তখন এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার সুযোগ অবশ্যই আছে।
যখন থেকে ভাবতে শুরু করি
আমাদের দেশে প্রায় পরিবারই ছেলে ও মেয়েকে শৈশবেই খেলনা আলাদা করে দেয়। ছেলেরা খেলবে বল দিয়ে, রিমোট নিয়ন্ত্রিত গাড়ি ছেলেদের জন্য। আর মেয়েরা খেলবে পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল দিয়ে। এমনকি আমাদেরকে রঙটা পর্যন্ত আলাদা করে দেওয়া হয়। গোলাপি রঙ হালকা, দুর্বল, নরম এমন ইঙ্গিত প্রকাশ করে বলে সবাই বলে থাকে এটা মেয়েদের সাথে মানায়। এভাবে ছোট থেকেই পরিবার ও সমাজ ছেলে আর মেয়েদের মাঝে একটা বৈষম্য সৃষ্টি করে দেয়। বড় হলেও তার ছাপ রয়ে যায়। একটা সময় বড় হয়েও অনেক মেয়েও এটা মনে করতে শুরু করে যে, ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা শুধু ছেলেদের জন্য। মাঠে খেলাটা মেয়েদের জন্য শোভা পায় না।
আমি ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় তেমন ভালো ছিলাম না। কিন্তু খেলা দেখতে খুব পছন্দ করতাম। আমার দাদা একজন ক্রীড়াপ্রেমি। তার সঙ্গে টেলিভিশনের সামনে বসে খেলা দেখা হত। আমি এখনো খেলাধুলা দেখতে পছন্দ করি। আমার শহর বাগেরহাটে যে সকল খেলার মাঠগুলো রয়েছে, বিকেল হলেই সেখানে প্রতিদিন খেলা হয়। অনেক ছেলেরা খেলে সেখানে। আমি কখনো কোনদিনও দেখিনি কোনো মেয়ে বড় হয়ে সেখানে খেলতে পেরেছে।
তখন থেকেই আমি এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। মেয়েদের খেলাধুলার কি প্রয়োজনীয়তা নেই? একটি মেয়ে কীভাবে খেলার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায় নাম করতে পারে, সেই সুযোগ কীভাবে হতে পারে? মেয়েদের খেলাধুলা করা কি অপরাধ? আমার মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করে। পরে এই বিষয়টা নিয়ে ভালো করে জানার চেষ্টা করি। দেখলাম আসলে আমাদের সমাজে মেয়েদের খেলার উপযোগী কোনো পরিবেশই নেই। সে ছেলেদের মাঠে খেলতে গেলেই সবাই এটা নিয়ে তামাশা করবে। কিন্তু কেন একটি কুঁড়ি নষ্ট করে দেওয়া হবে? মেয়েদের মধ্যে কি সম্ভাবনা থাকতে পারে না? একটি মেয়ে খেলার সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে সে হয়ত হতে পারবে একজন ভালো ক্রিকেটার বা ফুটবলার। কিন্তু পরিবার ও সমাজের কাছে অবহেলিত হওয়ায় অনেক প্রতিভাবান মেয়ে নিজের প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ পায় না। অল্পতেই ঝরে যায় সুপ্ত প্রতিভা।
হ্যালোতে বলার সুযোগ
শিশু সাংবাদিকতায় বিশ্বের প্রথম বাংলা সাইট হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের শিশু সাংবাদিক আমি। মেয়ে হয়েও জেলা পর্যায় থেকে সহশিক্ষা হিসেবে সাংবাদিকতা চর্চা করছি। আমি বসে থাকতে চাই না। শুধু মেয়ে বলে হেরে যাব, মেনে যাব এটা আমি চাই না। যেহেতু মূলধারার গণমাধ্যমে কথা বলার জায়গা আমার আছে তাই মেয়েদের অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য হ্যালোকে উপযুক্ত মঞ্চ হিসেবে মনে হয় আমার।
আমার জন্য বড় একটি সুযোগ আসে গেল ২৪ জুলাই। হ্যালোর একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন বাগেরহাট সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মাদ মোছাব্বেরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করি আমি।
সাক্ষাৎকার এক পর্যায়ে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলি আমি।
ইউএনও মোছাব্বেরুল ইসলাম তখন বলছিলেন, খেলাধুলার ক্ষেত্রে মেয়েরা প্রথমত সেই পরিমাণ সুযোগই পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, খেলতে গেলে সমাজের কাছ থেকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। এ অবস্থায় মাঠের সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ না থাকলেও অন্যভাবে সমাধানের সুযোগ রয়েছে।
"যেহেতু খেলার মাঠগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। তাই ইউনিয়ন পর্যায়ে ফুটবল ক্লাব করতে আমরা জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বসব। একটা হতে পারে, দুই দিন বা তিন দিন করে দিন ভাগ করে দেওয়া (ছেলে ও মেয়েদের জন্য) অথবা ঘণ্টা ভাগ করে দেওয়া ভাগ করে দেওয়া।"
তার প্রস্তাবিত বিষয়টি আমার ভালো লেগেছে। তারচেয়েও বেশি ভালো লেগেছে তিনি যে বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন।
আমি যা চাই
মেয়েদের জন্য খেলার সুযোগ সৃষ্টি করা হোক বেশি করে। আলাদা মাঠ বা স্লট করা যেতে পেরে তাদের জন্য। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কাছে যদি বার্তাটি আমি পৌঁছে দিতে পারি এবং তা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তাতেই আমার সার্থকতা। আমি যেহেতু গণমাধ্যমে কথা বলতে পারি তাই এ বিষয়টি তুলে আনতে চেষ্টা করে যাব। সবাইকে মনে রাখতে হবে মেয়েদের বাদ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না কোনোভাবেই।