Published : 06 Apr 2020, 01:28 AM
কোভিড-১৯ (নভেল করোনাভাইরাস) মহামারী ঠেকাতে হলে এখনই পাড়া-মহল্লা-গ্রাম-গঞ্জে সক্রিয় গণ সার্ভেলেন্স (Active mass surveillance) শুরু করতে হবে, বিশেষ করে যে সব স্থানে গুচ্ছ আকারে (Cluster) কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকা মহানগরীতে ৩০টি স্থানে রোগী শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে দু'টি স্থানে গুচ্ছ আকারে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকার বাইরে মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও গাইবান্ধাতে গুচ্ছ আকারে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে এবং অন্যান্য ৭ জেলাতে ১ জন করে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। গুচ্ছ হচ্ছে একটি এলাকাতে এক ব্যক্তির দেহে রোগ সংক্রমণের পর সেখান থেকে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া।
সারা দেশে ব্যাপক আকারে কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে হলে একা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে তা সম্ভব নয়। ব্যাপক জনগণকে সম্পৃক্ত করে সক্রিয় গণ সার্ভেলেন্স শুরু করতে হবে। পাড়া-মহল্লা-গ্রাম-গঞ্জে গণকমিটি গঠন করে প্রতিটি বাড়িতে যেতে হবে পারষ্পারিক শারিরীক দূরত্ব বজায় রেখেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর নিতে হবে: দীর্ঘ জাতীয় কোয়ারেন্টিনে (তথাকথিত লক ডাউন) তাদের কী অসুবিধা হচ্ছে, খাবারের বা বাজার করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, হয়ে থাকলে সমস্যা সমাধানের জন্য সক্রিয় হতে হবে। এর পরে জিজ্ঞেস করতে হবে- তার বাসার কারো জ্বর ও শুকনো কাশি আছে কি না? এ জিজ্ঞাসাতে মানুষ যেন ভয় না পান। গণকমিটিতে পাড়ার ডাক্তার বা কোনো স্বাস্থ্যকর্মী বা মেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রী থাকলে ভাল হয়। গণকমিটিতে নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-মতামতের প্রতিনিধিত্ব যেন নিশ্চিত হয়। রোগীকে আসামী হিসেবে বিবেচনা না করে বিপদে পড়া পরিবারের সদস্য হিসেবে গণ্য করতে হবে। তাহলে তারা তথ্য লুকাবেন না। হয়রানি হবে মনে করলে তথ্য লুকাবেন, পালিয়ে যাবেন। এতে মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
মৃদু জ্বর, মৃদু শুকনো কাশি থাকলে তাকে ঘরেই থাকতে বলতে হবে। ঘরে বসেই সাধারণ চিকিৎসাতে তিনি ভাল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বাসার অন্যান্য সদস্যরা স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। পাশাপাশি আইইডিসিআর বা স্থানীয় সরকারী স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে মৃদু লক্ষণযুক্ত রোগী ও কোয়ারেন্টিনের কথা জানাতে হবে। তারা প্রয়োজন মনে করলে তার নমুনা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করবেন। মৃদু লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিকে ও তার কোয়ারেন্টিকৃত পরিবারের সদস্যদেরকে স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়মিতভাবে খোঁজ-খবর করবেন। ঘরে স্বেচ্ছা অন্তরীণ মৃদু লক্ষণযুক্ত রোগী ও তার স্বজনদের খাবার বা বাজারের বা অন্য কোন সমস্যা হলে গণকমিটির পক্ষ থেকে তার তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করতে হবে। আর যদি রোগীর অবস্থা খারাপ থাকে, তবে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সাথে আগেভাগে যোগাযোগ করে অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করতে হবে বা স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশমত কাজ করতে হবে।
এভাবেই পাড়া-মহল্লা-গ্রাম-গঞ্জে কোভিড-১৯ রোগের উৎস খুঁজে বের কেরে রোগীকে আলাদা করা, পরীক্ষা করা, চিকিৎসা করা, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন করা প্রভৃতি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাদি (Public Health measures/intervention) নিয়ে মহামারীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে, তাদের মধ্যেকার শুভবুদ্ধিকে জাগিয়ে তুলে, তাদেরকে সংগঠিত করে মহামারীকে ঠেকিয়ে দেয়া যায়। মানুষকে সক্রিয় করেই সেটা সম্ভব।
১৯৭১ সালে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি তখন মানুষই যুদ্ধের কলা-কৌশল তৈরি করেছিল। তখন তারা পাকিস্তানি সৈনিকদের কত ট্যাংক, বিমান, কামান তা হিসাব করে বাঙালিদের জন্য ততগুলো ট্যাংক, বিমান, কামান জোগাড়ে নেমে পড়েননি, এবং অপেক্ষা করেননি কখন সেসব জোগাড় হবে, তারপরে যুদ্ধ নামবে। ঠিক তেমনি, আমাদের সীমাবদ্ধ সম্পদ নিয়েই মানুষের ওপর নির্ভর করে মহামারী ঠেকানোর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, এবং তা এখনই।