মাদকের পেছনে বছরে খরচ হয় ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। ১০ বছরে মাদকের কারণে সন্তানের হাতে খুন হয়েছেন দুইশত মা-বাবা।
Published : 26 Jun 2023, 04:58 PM
ধরা যাক তার নাম গণি মিয়া। বয়স ৬৩ বছর। বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার একটি গ্রামে। প্রথমে বলে নিই, মানুষটির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য ছদ্মনামের ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রামের নামটিও জানানো হলো না একই কারণে।
আমাদের এই গণি মিয়া কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের গণি মিয়ার মতো ভূমিহীন কৃষক নন। বেচাকেনার পর এখনও তার নিজের জমি আছে। ওই জমিগুলোর বেশ খানিকটা খাইখালাসি-বন্ধক দিয়ে কিছু দিন আগে দুই লাখ টাকা নিয়েছেন গ্রামেরই এক বর্গাদারের কাছ থেকে। খাইখালাসি-বন্ধকের রীতি অনুযায়ী, ওই জমিগুলো থেকে উৎপাদিত ফসলের সবটাই পাবেন ওই বর্গাদার। গণি মিয়া বন্ধকের বিনিময়ে নেওয়া টাকাটা ফেরত দিয়ে দিলে বর্গাদারের ওই জমিতে আর কোনো অধিকার থাকবে না।
আমাদের গণি মিয়া জমি বন্ধক রেখে পাওয়া দুই লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা দিয়ে ধার শোধ করেছেন। এই ধারটা হয়েছিল মূলত মাদকাসক্তির কারণে। মাদকদ্রব্য কেনা ও সেবনে ঋণ নিয়ে খরচ করেছিলেন টাকাটা। এরপর হাজার পঞ্চাশেক টাকা মাসখানেকের মধ্যেই নেশা করে শেষ দিয়েছেন। বাকি ৫০ হাজার টাকার টাপাল কিনে বন্ধুদের কাছে জমা রাখলেন।
টাপাল বেদনানাশক ওপিওড ওষুধের একটি। ইয়াবার পরিবর্তে বেদনানাশক এই ওষুধটি একই পদ্ধতিতে সেবন করা হয়। যে বন্ধুদের সঙ্গে গণি নেশা করতেন, তারা সবাই তার থেকে বয়সে ছোট। ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী। তার ইচ্ছে ছিল শেষ ৫০ হাজার টাকায় কেনা ওই টাপালগুলো টানা শেষ হলে নেশা ছাড়ার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হবেন। নিজেই পরিবারের সদস্যদের জানালেন কথাটা। তিনি জানাবার আগ পর্যন্ত পরিবারের কেউ গণি মিয়ার মাদকাসক্তির কথা জানতেন না।
গণি মিয়া ২০ বছর বয়স থেকে মাঝেমধ্যে তাড়ি খেতেন, এটা সবারই জানা ছিল। ২৮ বছর বয়সে বিয়ে করেন। নিজস্ব জমিতে চাষাবাদ করে সংসার ভালোভাবেই চালিয়েছেন। অন্য কোনো কাজকর্ম করেননি। তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। চার জনেরই বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের তিন জনই নৌবাহিনীর নন কমিশনড পদে কর্মরত। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই এবং নাতি-নাতনি নিয়ে সুখের সংসার বলা যায়।
গণির তাড়ি খাওয়াটা পরিবারের অজানা ছিল না বলে বছর দশেক আগে হঠাৎ করে ফেনসিডিল খাওয়া শুরু করলে কেউ বুঝতে পারেননি। একটানা পাঁচ বছর প্রতিদিন দু-এক বোতল করে চলতে থাকে এই মাদকদ্রব্যটি গ্রহণ। মাঝেমধ্যে গাঁজাও সেবন করতেন। তারপর শুরু করেন ইয়াবা। দিনে দুই থেকে তিন বার সেটাও চলত। বছরখানেক হলো শুরু করেছেন টাপাল সেবন।
পরিবারের লোকেরা গণি মিয়ার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার কথা অনুমান করতে না পারার আরও একটা কারণ হচ্ছে তার বদমেজাজ। অনেক আগে থেকেই তাকে বদরাগী মানুষ বলে জানেন তারা। পরিবারের সদস্যদের সবাই এমনিতেই তার ভয়ে তটস্থ থাকতেন। তাই ফেন্সিডিল থেকে টাপাল সেবনের মধ্য দিয়ে তার আচরণ বদলে যাওয়াটা ওদের চোখে ধরা পড়েনি। অন্যের বিপদে সর্বদাই সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন গণি মিয়া। ফলে তার খরচ বেড়ে যাওয়াটাও চোখে পড়েনি পরিবারের লোকজনের। মাস দুয়েক আগে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিজের মাদকাসক্তির কথা জানালে তার ছোট ছেলে বুঝিয়েসুঝিয়ে বাবাকে নিয়ে আসেন একটি নিরাময় কেন্দ্রে। তার এক রকম সম্মতিতেই ‘ভাবনা’ নামে নিরাময় কেন্দ্রটি নির্বাচন করা হয়। অবশ্য ভর্তির আগমুহূর্তে পালানোর চেষ্টাও করেছিলেন গণি। ৫০ হাজার টাকার টাপাল একটুও সেবন করতে না পারার আফসোস ছিল মনে। নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হওয়ার পরও বেশ কিছু দিন তার টাকায় বারো ভূতের নেশার জিনিস কিনে রেখে এসেছেন ভেবে দুঃখ করেছেন ।
গণি মিয়ার মতো আসক্তির শিকার হয়ে পড়া মানুষের সঙ্গে আমার জানাশোনা প্রায় দুই যুগের। ঘটনাচক্রে ২০০১ সালে আমি একটি নিরাময় কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমার এক বড় ভাই ডা. জিয়াউল হক ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনে (ডব্লিউএইচও) মাদকাসক্তি নিয়ে কর্মশালা করে এসে দিনাজপুর শহরে ছোট পরিসরে ভাবনা নামে এই কেন্দ্রটি চালু করেন। আমিও বিদেশ থেকে ফিরে কি করা যায় ভাবছিলাম। জিয়া ভাই ডেকে নিলেন তার সঙ্গে। পরে অবশ্য জিয়া ভাই উচ্চতর পড়াশোনা করতে দিনাজপুরের বাইরে চলে গেলে ভাবনার সকল দায় আমার ওপর বর্তায়। তখন সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুর মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। মাদকদ্রব্য বলতে তখন পর্যন্ত ফেন্সিডিলই ছিল প্রধান। ফেন্সিডিলের চালানের সবটাই আসত ভারত থেকে। প্রবেশদ্বারে এর মূল্য ছিল কম। সেই সময় যে তরুণরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। দুই যুগ পরে দেখছি, ওই সময়কার তরুণদের উত্তর প্রজন্ম আবার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। ছোট্ট ভাবনা এখন নিজস্ব জমিতে অনেক বড় পরিসরে বিস্তৃত হয়েছে। রোগী কিন্তু কমছে না। একেবারে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি, মাদকের উপাদান বদলে যাচ্ছে এবং প্রজন্মান্তরে মাদকসেবীর সংখ্যাও বাড়ছে।
ভাবনায় যে মাদকাসক্তরা নিরাময়ের জন্য আসেন এবং যাদের নিয়ে আসা হয় তাদের বেশির ভাগই এই উত্তর জনপদের। বলে রাখা ভালো নিজের উদ্যোগে কেন্দ্রে আসা মাদকাসক্তদের সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগই আত্মীয়-স্বজনরা নিয়ে আসেন। রোগীরা মূলত দিনাজপুর, পঞ্চগড় এবং নীলফামারী জেলার। তবে গাইবান্ধা এবং রংপুর থেকেও আজকাল রোগী নিয়ে আসছেন তাদের স্বজনরা।
আমার কাছে উত্তরের এই জনপদে মাদকাসক্তের আলাদা কোনো পরিসংখ্যান নেই। সারা দেশের পরিসংখ্যানটাও বেশ গোলমেলে। বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত? তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। গতবছর ৭ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল কেরানীগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ।’ এর বছর চারেক আগে ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, ‘দেশে ৭৩ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে।’ ২০১৮ সালেরই ৪ অক্টোবর বিভিন্ন পত্রিকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনিস্টিটিউট পরিচালিত এক সমীক্ষার বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৩৬ লাখ।’
২০১২ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি পোস্টারে দেখেছিলাম দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫০ লাখ। সেটি এখনও আমার সংগ্রহে রয়েছে। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, বিশ্বে মাদকাসক্ত সংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ২ ভাগ কিন্তু বাংলাদেশে এ হার প্রায় দ্বিগুণ ৩ দশমিক ৮ ভাগ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের এক অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয় দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩। ইউএনডিপির তথ্যে মাদকাসক্ত বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হলে এটি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়েও বেশি। ২০১২ সালে ৫০ লাখ মাদকাসক্ত ছিল ধরে নিয়ে শতকরা ৩ দশমিক ৮ ভাগ বৃদ্ধির সরল গাণিতিক হিসাব কষলে ২০২৩ সালে তা ৭০ লাখ ৯০ হাজার দাঁড়ায় অর্থাৎ প্রায় ৮০ লাখ। মাদকের কেনাবেচা এবং সেবন সবটাই ঘটে লোকচক্ষুর আড়ালে। কাজেই মাদকাসক্তের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ অসম্ভব একটা কাজ। ২৬ জুন ২০২২ মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছিলেন, মাদকাসক্তর ৮০ শতাংশই তরুণ। এই ৮০ শতাংশের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। বাকিদের মধ্যে নিরক্ষর এবং শুধুই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নরাও আছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে যাদের অবস্থান তারাও নেহায়েত কম নয়।
এবার চল্লিশোর্ধ্ব একজন মাদকাসক্তের কথা বলব। বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুরে। পারিবারিক রেস্টুরেন্টের ব্যবসায় নিয়মিত ক্যাশ কাউন্টারে বসতেন। নির্ধারিত হাত খরচ ছাড়াও ইচ্ছা মতো ক্যাশ থেকে টাকা নেওয়ার সুযোগ হতো তার। সে সময় কিছু বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়। তাদের সঙ্গে ২৩ বছর বয়সে প্রথম ফেন্সিডিল সেবন। ক্রমে আসক্ত হয়ে পড়েন। মাদক সেবন অনেকাংশেই নির্ভর করে সরবরাহের ওপর। ফলে কোনো মাদক সরবরাহ কমে গেলে আসক্তি অন্য মাদকে পরিবর্তিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গাঁজা, ইয়াবা, হিরোইন, মদ, ঘুমের ওষুধ সর্বশেষ টাপাল ট্যাবলেটে আসক্তি দেখতে পাচ্ছি। চল্লিশোর্ধ্ব এই আসক্ত ব্যক্তিটি কখনো একাধিক মাদক গ্রহণ করেছেন একই দিনে। ইতিপূর্বে ছয়বার বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি ছিলেন। ২২ বছরের বিবাহিত জীবনে তিন সন্তানের জনক। তার স্ত্রী ২০ বছর সহ্য করে দু'বছর আগে তাকে ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে গেছেন। ছেলেরা দাদা-দাদির সঙ্গে থাকে। বড় ছেলে নবম শ্রেণীতে পড়ে। দাদা এবং চাচারা ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ বহন করেন।
গত বছরের পহেলা নভেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক সংবাদে দেখেছি মাদকের পেছনে বছরে খরচ হয় ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। বিগত ১০ বছরে মাদকের কারণে খুন হয়েছেন দুইশত মা-বাবা। জাতীয় সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে ‘মাদক নিয়ন্ত্রণে ডোপ টেস্ট এই মুহূর্তে করণীয়’ শীর্ষক মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠানের খবরের সূত্রে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এ তথ্য দিয়েছে।
শিশু অধিকার বিষয়ক সংসদীয় ককাস এবং সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস) আয়োজিত ‘মাদক নিয়ন্ত্রণে ডোপ টেস্ট এই মুহূর্তে করণীয়’ শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ‘প্রতিদিন গড়ে একজন মাদকসেবীর ১৫০ টাকার মাদক লাগে। এই হিসেবে একজন মাদকাসক্ত বছরে ৫৪ হাজার ৭৫০ টাকার মাদকের জন্য ব্যয় করে। দেশে ২৫ লাখ মাদকাসক্ত ধরা হলে তারা বছরে ১৩ হাজার কোটি টাকার মাদক সেবন করে। এতে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।’
মাদকাসক্তের সংখ্যা যে ২৫ লাখের চেয়ে অনেক বেশি, এরই মধ্যে বিভিন্ন তথ্যউপাত্তে আমরা তা এরই মধ্যে জেনেছি।
বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় লক্ষ্য করা যায় ২০১৯ সালে চিকিৎসাপ্রাপ্ত মাদকাসক্তের ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ শিশু। করোনাকালীন সময় এ সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। পথশিশুদের মধ্যে ৮৫ ভাগ মাদকাসক্ত যাদের বয়স ৮ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। তারা সাধারণত ড্যান্ডি (আঠা জাতীয় দ্রব্য) দিয়ে নেশা শুরু করে।
ভাবনা মাদক নিরাময় কেন্দ্রের এক রোগী জামালের কথা বলব। ১৫ বছর বয়সী জামাল (ছদ্মনাম)। ঠাকুরগাঁও সদরের একটি গ্রামের ছেলে সে। তার বাবা পুলিশে চাকরির কারণে বছরের অধিকাংশ সময় বাড়িতে থাকতে পারতেন না। এর মধ্যে সবার ছোট এবং আদরের জামাল মাদ্রাসায় পড়ার নামে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও দুষ্টুমি করে সময় কাটাতো। এভাবেই এক সময় ড্যান্ডিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। ড্যান্ডি সেবনের প্রভাবে সে স্পষ্ট কথা বলতে পারত না। কথা জড়িয়ে যেত, সাধারণ হিসাব বুঝতো না। কিন্তু দুষ্টুমিটা বেশিই বুঝতো। নিরাময় কেন্দ্রে আট মাস থেকে অনেকটাই সুস্থতা লাভ করেছিল। কেন্দ্রের কাছেই তাকে আবার মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার কোন আগ্রহ না থাকায় বিষয়টি এগোয়নি। বাড়ি ফিরে কিছুদিন ভালো থাকার পর একই পথে যাওয়ায় আবার নিরাময় কেন্দ্রে তাকে ভর্তি করা হয়।
শিশু মাদকাসক্তের সমান্তরালে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বলে জানতে পারছি।মাদকসেবীদের ১৩ থেকে ২০ শতাংশ নারী বলে মনে করা হয়। ৮০ লাখ মাদকাসক্তের ১৫ শতাংশ নারী হলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লাখ। মাদকাসক্ত নারীদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী। মাদকপাচার এবং পরিবহনের কাজেও নারীদের ব্যবহার করা হয়। নারী মাদকাসক্তের জন্য দেশে যথেষ্ট নিরাময় কেন্দ্রও গড়ে ওঠেনি।
আমাদের প্রতিষ্ঠান ভাবনাতেও নারীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। করার চিন্তা রয়েছে। ভাবনার পরিসর আগের চেয়ে অনেকখানি বড় হওয়ায় রোগী ভর্তি করার সুযোগ বেড়েছে। আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না মেলায় এখনও বেছে বেছে রোগী ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো গুরুত্ব বিবেচনায় আমাদেরকে অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে কিছুটা বেশি রোগী রাখতে দিচ্ছে। কারণ মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়েছে দিন দিন। এখন ভাবনায় ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী রোগী ২৪ শতাংশ আছে। ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী রোগীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, এই বয়সীরা আছে ৪২ শতাংশ। ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ২৪ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৮ শতাংশ, পঞ্চাশোর্ধ্ব ২ শতাংশ। গণি মিয়া বাড়ি চলে যাওয়ায় তার বয়সী আর কেউ কেন্দ্রে নেই। গণি মিয়াকে আরো কয়েকটা দিন কেন্দ্রে রাখা গেলে ভালো হতো। স্ত্রী মারাত্মক অসুস্থ বলে নির্ধারিত সময়ের একটু আগে আগেই ছাড়তে হলো তাকে।
দেশের নিরাময় কেন্দ্রগুলো মধ্যে অনেকগুলোর সম্বন্ধে বেশ কিছু অভিযোগও রয়েছে। কিছু অভিযোগ রীতিমতন গুরুতর; যেমন: রোগীদের মানসম্পন্ন খাবার সরবরাহ না করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং নির্যাতন করা ইত্যাদি। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে ৪টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। বেসরকারিপর্যায়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রয়েছে ৩০০টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র । তার মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ১১৫টিরও অধিক। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, একদা মাদকাসক্ত ছিলেন, এমন ব্যক্তিরা নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করছেন। তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে কেন্দ্রের ভেতরেই মাদকাসক্তদের নেশা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অনেক কেন্দ্রে খেলার মাঠ তো দূরের কথা, একটু মুক্ত হাওয়া নেওয়ার সুযোগ পর্যন্ত নেই। ফলে রোগীদের জেলখানায় বন্দি থাকার অনুভূতি তৈরি হয়। তৈরি হয় আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের প্রতি ঘৃণা। যার ফলে ছাড়া পেয়ে আবারও মাদকের দিকে ছুটে যায় তারা।
বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক আসক্ত গাঁজাসেবী। তরুণ-তরুণীরা গাঁজাকে অপেক্ষাকৃত নির্দোষ মাদক বলে মনে করে থাকে। বাস্তবে এটাও একটি গাঁজাখুরি ধারণা । যদিও বিশ্বের কিছু রাষ্ট্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ গাঁজা-বহন আইনসিদ্ধ। মাদকের ক্ষেত্রে চাহিদা এবং যোগানের টানাপোড়েনমূলক একটা কথা বারবার চলে আসে। এখানে মুরগী আগে না ডিম আগে এমন বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। মাদকের চাহিদা বা যোগান, কোনটিই থাকার প্রয়োজনীয়তা নেই । সর্বোপরি, মাদকাসক্তি একটি মনো-শারীরিক রোগ যা উপযুক্ত চিকিৎসায় নিরাময় সম্ভব।
২৬ শে জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বজুড়ে়ে দিবসটি পালন করা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় ‘International Day Against Drug Abuse and Illicit Trafficking’। বাংলা করলে হয় ‘মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার এবং অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’। ইংরেজিতে ‘Illicit Trafficking’ বাংলায় ‘অবৈধ পাচার’ কেন বলা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। পাচার সব সময়ই অবৈধ। বৈধ হলে তা আমদানি -রপ্তানি বা চালান করা হতো। তবে কি মাদকের বৈধ পাচার বলে কিছু আছে? মানব পাচারের ক্ষেত্রে অবৈধ শব্দ ব্যবহার করে আমরা তো কখনো বলি না অবৈধ মানব পাচার! তবে মাদক পাচারের ক্ষেত্রে অবৈধ শব্দটি কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে? ভাষাগতভাবে বাক্যটি কি ভুল হয় না? এ বছর দিবসটির স্লোগান–‘People First Stop Stigma And Discrimination, Strengthen Preventio ‘ এর বাংলা ভাবার্থ এরকম হতে পারে ‘মাদকাসক্তকে নয় মাদককে ঘৃণা করি, মাদকের বিস্তার প্রতিরোধ করি’।