Published : 28 Apr 2019, 06:46 PM
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই আমি ঘুম নিয়ে মহা সমস্যায় পড়েছিলাম। 'জাহাঙ্গীরনগর' আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের সবারই হলে সিট পাওয়ার কথা। কিন্তু সেশন জটে আটকে থাকা অতিরিক্ত ছাত্রসংখ্যার কারণে শুরুতে সিট পাওয়া সম্ভব না। বিভিন্ন হলের টিভি রুম, কমন রুম, গণরুমে তাই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের থাকতে হতো। মীর মশাররফ হোসেন হলে আমাদের ব্যবস্থা হয়েছিল হলের সামনে দোতলা বিল্ডিং 'হল অফিসে'র দোতলায়। একরুমে দশ বিছানায় বিশজন। কখনো কম কখনো বেশি। নতুন ছাত্র-জীবন, নতুন বন্ধুবান্ধব, হই-হুল্লোড় ইত্যাদিতে সময়টা বেশ আনন্দের হলেও আমার জন্য রাতগুলো বেশ বিভীষিকাময় ছিল।
প্রথম কিছুদিন র্যাগিং তো ছিলই, তবে বেশি সমস্যা ছিল প্রায় সারারাত রুমের বাতি জ্বালানো। কারো কারো অভ্যাস রাত জেগে থাকা আর সকালে ঘুমানো। এ নিয়ে কারও কারও সাথে কিছু দ্বন্দ্বও হয়েছিল। পরবর্তিতে নিয়মিত ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার পরে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়। আর কয় মাসের মধ্যে আমরা হলে সিট পেয়ে গেলে নিজস্ব স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু হয়। কিন্তু পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আমি অবাক হয়ে দেখেছি, কিছু মানুষ রাতে জেগে থাকতে আর দিনে ঘুমাতে খুব পছন্দ করত।
চীনে আসার পরে এ বিষয়টা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এখানকার জীবনযাপন অতি সুনিয়ন্ত্রিত। তবে নতুন করে আবার দেখার শুরু হলো- দুই বছর আগে যখন আবার চীনে ফিরে এলাম ম্যাকাও ও ভিয়েতনাম ঘুরে। আমি যে ক্যাম্পাসে থাকে সেখানে বাঙালি ছাত্রদের বড় অংশ থাকে। মাঝে মাঝে ওদের ডর্ম বা হলে যেতাম। ক্লাসের সময়টা বাদ দিয়ে বাকি সময় দিনের বেলা ঘুমানো নিয়মিত অভ্যাস অনেকেরই। কারণ তারা রাত জেগে থাকে। আমি যতই অবাক হই, তাদের কাছে ব্যাপারটা ততই স্বাভাবিক।
আমাদের প্রজন্মের কিছু মানুষের কাছে এবং একালের বেশিরভাগের কাছেই রাতে জেগে থাকতে এবং দিনের অনেকটা সময় ঘুমিয়ে কাটাতে আনন্দ। কিছু মানুষ দাবি করেন, এটা তাদের 'ক্রিয়েটিভিটি' বৃদ্ধি করে। কথাটা হয়তো কিছু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যারা মহান বিজ্ঞানী, দার্শনিক কিংবা কোনও সৃষ্টিশীল পেশার প্রতিভাবান মানুষ, তাদের কারও কারও জন্য হয়ত রাতের নীরবতা কাজের ক্ষেত্রে বেশি উপযোগী। কিন্তু অধিকাংশ রাতজাগা মানুষ আমাদের মতো সাধারণ এবং তাদের রাতজাগা মানবকল্যাণে কোনও উপকার তো করেই না, বরং তাদের নিজেদেরই মহা ক্ষতি করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকের তরুণ সমাজের বড় অংশই এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
"মহান আল্লাহপাক আমাদের জন্য রাতকে বিশ্রাম বা আরামের জন্য আর দিনকে কাজকর্মের জন্য নির্ধারণ করেছেন।" (আল কুর'আন- ৬:৯৬; ১০:৬৭; ২৫:৪৭)
আমাদের দেহ ও মনের জন্য রাতের বিশ্রাম আর দিনের কাজই প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি অনিয়ম পছন্দ করেনা। নিয়মের ব্যাঘাত ঘটলে তাই সমস্যা তৈরি হয় বৈকি!
'সারকাডিয়ান রিদম' (circadian rhythm) 'বায়োলজিক্যাল ক্লক' (biological clock) বা বাংলায় 'দেহ ঘড়ি" ব্যাপারটির কথা অনেকেরই জানা। বিশেষ করে ২০১৭ সালে জেফ্রি হল, মাইকেল রসব্যাশ এবং মাইকেল ইয়ং নামের তিনজন বিজ্ঞানী এই বিষয়টিকে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য 'ফিজিওলজি ও মেডিসিন' এই নোবেল পুরস্কার লাভের পরে বিষয়টি জীববিজ্ঞানের বাইরেও বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। এই 'দেহঘড়ি' একটি শরীরবৃত্তীয় ব্যাপার যা মানুষের জেগে থাকা এবং ঘুমানোর বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করে। অন্ধকারে ঘুম পায়, আবার আলোতে জেগে ওঠে। অনেকটা সুইচ অন-অফ সিস্টেম। এই সুইচ অন-অফ আবার অন্যান্য শরীরবৃত্তীয় বিষয়গুলোর উপর প্রভাব ফেলে। তাই স্বভাবতই দেহ ঘড়িতে কোনও গোলমাল হলে তা আমাদের শরীরবৃত্তীয় কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাবেই। কিন্তু সেটা কতটুকু?
গত কয়েক দশকে 'সারকাডিয়ান রিদম' নিয়ে প্রচুর বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে। 'বায়োমেডিক্যাল সাইন্স' এর জনপ্রিয় ডেটাবেজ 'পাবমেড' (PUBMED) এ খুঁজলে এর উপরে গবেষণা-প্রবন্ধ পাওয়া যায় ৭৫ হাজারেরও বেশি! এই বিপুলসংখ্যক গবেষণা এটাই দেখিয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে 'সারকাডিয়ান রিদম' এ ব্যাঘাত ঘটালে বিভিন্ন রোগব্যাধি হতে পারে। এটা শুধু 'ইনসোমনিয়া' তে সীমাবদ্ধ নয়, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, পার্কিন্সন্স, এমনকি ক্যান্সারেও এর প্রভাব ভয়াবহ।
ক্যান্সার-বিজ্ঞানের একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে আমি প্রায়ই বিষয়টা নিয়ে ভাবি। আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবন পদ্ধতি, সেটা হতে পারে খাবারদাবার, হতে পারে পরিবেশ দূষণ, হতে পারে দৈনন্দিন জীবনযাপনে অনিয়ম যেমন 'সারকাডিয়ান রিদম' কে না মেনে চলা, ইত্যাদি আমাদের অতি দ্রুত ভয়াবহ এক স্বাস্থ্য-সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
'আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর ক্যান্সার রিসার্চ' এর বার্ষিক সম্মলনে (২০১৯) যোগ দিতে গিয়ে মহান সব বিজ্ঞানী কিংবা গবেষকদের কথা শুনছিলাম। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মধ্যে 'সারকাডিয়ান রিদম অ্যান্ড ক্যান্সার' এর উপরও দারুণ এক আলোচনা শোনার সুযোগ হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা সেখানে আলোচনা করছিলেন কীভাবে 'সারকাডিয়ান রিদম' এ ব্যাঘাত ঘটার কারণে একে নিয়ন্ত্রণকারী অন্যতম প্রধান জিন/প্রোটিন 'ক্লক' (CLOCK) এর এক্সপ্রেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তা কিভাবে ক্যান্সার সম্পর্কিত জিন/প্রোটিন সমূহের (উদাহরণ, 'মিক' [MYC]) এক্সপ্রেশনের উপর প্রভাব ফেলে ক্যান্সারের পেছনে কাজ করে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা রাতের শিফটে কাজ করেন তাদের মধ্যে স্তন-ক্যান্সারের সম্ভাবনা ৩৬ শতাংশ বেশি! এটা আসলেই অতি ভয়াবহ পরিসংখ্যান। একই ভাবে অন্যান্য ক্যান্সারেও 'ক্লক' বা অন্যসব জিন/প্রোটিনসমূহ যারা 'সারকাডিয়ান রিদম' এর সাথে সম্পর্কিত, তাদের অস্বাভাবিক এক্সপ্রেশন ভূমিকা রাখতে পারে।
শুরুর কথায় ফিরে যাই। যারা মহান বিজ্ঞানী, দার্শনিক কিংবা কোন সৃষ্টিশীল পেশার প্রতিভাবান মানুষ, তারা মানুষের কল্যাণে নিজেদের জীবন, সময়, স্বাস্থ্য ইত্যাদি উৎসর্গ করে থাকেন। রাত জাগা তাই তাদের মহান কর্মের অংশ। কিন্তু আমাদের মত সাধারন মানুষ যারা অকারণে আড্ডা দিয়ে, টিভি-সিনেমা দেখে কিংবা মোবাইল ফোনে গেম খেলে রাতের সময়টুকু কাটিয়ে 'সারকাডিয়ান রিদম' এলোমেলো করে দিচ্ছে, তাদের ভবিষ্যত স্বাস্থ্যসমস্যার শঙ্কা অনেক বেশি।
একটা কথা বলা প্রয়োজন। চিকিৎসা বা গবেষণা কী মানুষের মৃত্যু রুখতে পারে? না, পারেনা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য মৃত্যু রোখা নয়, বরং এটা নিশ্চিত করা, যতদিন মানুষ বাঁচবে, সুস্থ শরীরে, আনন্দিত চিত্তে বাঁচুক। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন আমাদের সুস্থভাবে বাঁচার প্রধানতম উপায়।
আমার ক্ষুদ্র এই লেখাটা অনেকের কাছেই ভালো না লাগতে পারে। তবে এটা তর্কের বিষয় নয়। আপনার স্বাস্থ্য, আপনার জীবন, আপনার ইচ্ছা আপনি কিভাবে যাপন করবেন। কেউ কোন তথ্যের জন্য বা এ সম্পর্কিত কোন গবেষনা পত্রের জন্য আমাকে লিখতে পারেন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। শুভকামনা সবার জন্য।