Published : 16 Jun 2012, 07:55 PM
বাজেট হলো সরকারের এক বছরের আয় ব্যয়ের হিসাব, সেখান থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতি বোঝা যাবে না। তবে রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রতিফলন থাকে এখানে। পরোক্ষভাবে বাজেটের ঐতিহাসিক ও গভীরতর বিশ্লেষনের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক অর্থনীতিটাকে বুঝতে পারবো। রাজনৈতিক অর্থনীতির মূল কথা হচ্ছে শ্রেণীস্বার্থ। অর্থাৎ বাজেট কোন শ্রেণীর স্বার্থে প্রনীত হলো সেটাই রাজনৈতিক অর্থনীতির মূল বিষয়। দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক ক্ষমতায় যে দলটি আছে তার একটা ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাসটিও বুঝতে না পারলে রাজনৈতিক অর্থনীতি বোঝা যাবে না। এই ইতিহাসের আবার সুস্পষ্ট চারটি পর্ব রয়েছে । ৪৭ পূর্ববতী পর্ব, ৪৭-৭১ পর্যন্ত একটি পর্ব, আরেকটি পর্ব হচ্ছে ৭১-৭৫ পর্যন্ত এবং ৭৫ পরবর্তী পর্ব। ৪৭ এর আগে আওয়ামী লীগ ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। মূলত সৌরওয়ার্দীর হাতে গড়ে উঠে এ সংগঠনটি। তিনি ছিলেন পশ্চিমা ইম্পিরিলিজমের ভক্ত এবং ০+০ থিওরির প্রবক্তা। যেটা দিয়ে তিনি বুঝিয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বন্ধুত্ত্ব না করলে আর্থিক সমৃদ্ধি আসবে না। তার বিচারে সমাজতন্ত্র ছিল শুণ্য। আমরাও শুণ্য। অতএব ০+০ =০। সেই পশ্চিমাপন্থী সৌরওয়ার্দীর আওয়ামী মুসলিম লীগ পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। এভাবেই আওয়ামী লীগের ভেতরে আস্তে আস্তে পেটি বুর্জোয়া মিডলক্লাস গড়ে ওঠে। সেই পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন শেখ মুজিবর রহমান। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন– এগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আওয়ামী লীগের চরিত্র আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে সে সময়ে। এই সময় আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রগ্রেসিভ অংশের প্রতিনিধিত্ব করতেন আদিতে মুসলীম লীগের যারা প্রগ্রেসিভ অংশ ছিল তাঁরা। আবুল হাসেমপন্থি মুসলিম লীগ ছিল তাদেরই শিষ্য। যাদের সঙ্গে গোপনে কমিউনিষ্ট পার্টির যোগাযোগ ছিল। আব্দুস সামাদ আজাদ, মহিউদ্দিন আহমেদ, তাজউদ্দিন আহমেদ এদের ওয়েস্টার্ন প্রীতি তেমন ছিল না। এরা ছিলেন জোট নিরপেক্ষ অথবা আরেকটু এগিয়ে সমাজতন্ত্রের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের পক্ষে এসেছেন নানা অভিঘাতের মধ্য দিয়ে। তার আদর্শগত কমিটমেন্ট ছিল জাতীয়,পরে তিনি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের পক্ষে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর সমস্ত জীবনে দেখা যায়, তিনি ছিলেন প্র্যগমেটিক এবং অবস্থা বুঝে বুঝে তিনি এগিয়েছেন। তার প্র্যাগমেটিজমের গোড়ায় একটা সুনির্দিষ্টতা ছিল সেটা হলো জাতীয়তাবাদ, বাঙ্গালী জাতি সম্পর্কে গর্ব। তিনি ইমোশনালি একজন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ঝাড়ুদারকেও জড়িয়ে ধরেছেন! কিন্তু তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য কী ধরনের সমাজ ব্যবস্থা দরকার, সেটা তিনি নির্ধারণ করেননি। তিনি মিশ্র অর্থনীতির পক্ষেই ছিলেন। দৃঢ়ভাবে সমাজতন্ত্রের পক্ষেও ছিলেন না, আবার দৃঢ়ভাবে ধনতন্ত্রের পক্ষেও ছিলেন না। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সোভিয়েত তথা ইন্দোসোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর আমরা যে সংবিধান প্রণয়ন করি, সেখানেও সুস্পষ্টভাবে সমাজতন্ত্রের কথা আসে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি গণতন্ত্রসহ সমাজতন্ত্র। সুতরাং মার্ক্সীয়ান সমাজতন্ত্রের যে প্রিলিমিনারি পর্ব যাকে প্রলেতারিয়ান ডিকটেটরশীপ বলা হয় বা যাকে একদলের শাসন বলা হয় সেপথে বঙ্গবন্ধুও যাননি, তাজউদ্দিন আহমেদও যাননি, আওয়ামী লীগও যায়নি। এখানকার কমিউনিষ্ট পার্টিও বঙ্গবন্ধুর সেই বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পক্ষেই আদিতে অবস্থান নিয়েছিল। সেই সময়ে বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের যারা তাত্ত্বিক ছিলেন উইলিয়ানোভস্কি, সিমোনিয়া তাঁরাও তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদী নেতারা সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে আস্তে আস্তে সমাজতন্ত্রের দিকে এগুবে বলে বিশ্বাস করেছিলেন। সেখানে সমাজতান্ত্রিক শক্তি, জাতীয়তাবাদী শক্তি, রেডিক্যাল শক্তি এমনকি জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় শক্তি তারাও পক্ষে থাকতে পারে। সে জন্য তারা তখন কৌশলী নমনীয় নীতি গ্রহন করেন। জাতীয়তাবাদী নেতাদের তাঁরা পক্ষে রাখার চেষ্টা করেন। এধরনের নেতাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, চিলির আলেন্দে, তানজানিয়ার নায়ারে, প্রমুখ। এদেরকে সমাজতন্ত্রের দিকে টেনে আনার চেষ্টা সোভিয়েত ইউনিয়ন করেছে। কখনো সাহায্য দিয়ে, কখনো পরামর্শ দিয়ে, কখনো সামরিক সহায়তা দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে যখন গেল এবং সপ্তম নৌবহর পাঠাল বঙ্গোপসাগরে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন সাবমেরিন পাঠিয়েছে। ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটা সামরিক চুক্তি করেছিল; তাতে উল্লেখ ছিল ভারতকে যে আক্রমন করবে, সে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমন করবে। এই চুক্তিটা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। চীন যদি ভারতের অন্য সাইডে একটা ফ্রন্ট খুলতো তাহলে ভারত মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করতে ইষ্টার্ন ফ্রন্টে আর্মি পাঠানোর সুযোগ পেতো না। ভারতীয় আর্মি একই সঙ্গে দুটি ফ্রন্টে যুদ্ধ করার ঝুঁকি নিতে পারত না। সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনের বর্ডারে সৈন্য এনে বসিয়ে রেখেছিল, তোমরা ভারতকে আক্রমন করলে আমরা তোমাদেরকে আক্রমন করব। ভিয়েতনামের সময়ও তাই করেছিল। সে কারনে চীন সেই কাজটা করতে পারেনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। এ ঘটনাবলী বঙ্গবন্ধুকে কনিভিনস করে, আমেরিকা তার প্রকৃত বন্ধু নয়। তবে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত নীতি কিন্তু সুস্পষ্টভাবে এমন ছিল না– "আমি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষে"। বরং তিনি সবসময় বলে গেছেন আমি কারও শত্রু নই, আমি সবার বন্ধু। এ কারণে আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা দক্ষিণপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যারা আসলেই সমাজতন্ত্রের দিকে কোনোদিনই যাবে না, তাদেরকে তিনি দল থেকে বহিস্কার করেননি। তার মানে আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর অবস্থানটা ছিল দোদ্যুাল্যমান। তিনি ডানেও যেতে পারেন বামেও যেতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শক্তির ভারসাম্য বিবেচনা করে প্র্যাগমেটিক্যালি হয় বামে যাবেন, নয় ডানে।
আমাদের দুর্ভাগ্য বাম শক্তি তাকে সঠিক সময়ে চাপ দিয়ে বামের দিকে নিতে পারল না। বরং তিনি বাম ডান করতে থাকলেন এবং বামকেও তিনি হারালেন ডানকেও। তার দলের ভেতর যে বাম শক্তিটা ছিল সেটা ভাগ হয়ে গিয়ে জাসদ তৈরি হয় এবং তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। ভাসানীপন্থি, চীনাপন্থী বামরাও তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। একমাত্র মস্কোপন্থী বামরা তার সঙ্গে থাকলো। আওয়ামী লীগের মধ্যেও যারা প্রগতিশীল তারাও আস্তে আস্তে কোনঠাসা হয়ে পড়ল। আমরা একটা উদাহরণের মাধ্যমে সেটা বুঝতে পারি। তাজউদ্দিনকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার করা হলো। যদিও বঙ্গবন্ধু জানতেন, খন্দকার মোস্তাক আসলে সাম্রাজ্যবাদের লোক তবুও সঠিক সময় তাকে দল থেকে বহিস্কার করতে পারলেন না। এই জিনিসটা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। দলের মধ্যে নানা রকম প্রবনতা থাকতে পারে কিন্তু দলের আল্টিমেট অবস্থান ডানে না বামে এটা ঠিক সময়ে নির্ধারন করা জরুরি। বাম দিককে শক্তিশালী করতে না পারলে ডানকে মোকাবেলা করা যাবে না। ডান বাম করতে থাকলে ডানকেও হারাতে হবে, বামকেও। শেষে বন্ধুহীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর লাইফের ট্র্যাজেডিটা আমি মনে করি এ রকম। একটি জায়গায় আমি তাকে ক্রেডিট দেব, শেষ বছর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আওয়ামী লীগকে তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে টানতে পারবেন না, তাকে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সমাজতন্ত্রের দিকে যেতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার মাঝে দোদুল্যমানতা ছিল, মাঝামাঝি ছিল , আপস ছিল এবং এর কারনও বঙ্গবন্ধু নিজে নয়, দলের ভেতর থেকে দক্ষিণপন্থীদের চাপ।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পুরো অর্থনীতি ডানে যাওয়া শুরু করলো খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে। মোস্তাক বেশীদিন স্থায়ী থাকলেন না। বিষয়টিকে স্টেবিলাইজ করলেন আর্মি জেনারেল জিয়া। যেহেতু তার রাজনৈতিক দল নেই, সুতরাং তাকে দল তৈরি করতে হলো। দল তৈরি করতে গিয়ে তাকে গোয়েন্দা সংস্থা, আর্মি, আমলা, ব্যক্তিগত পছন্দের লোকদের নিয়ে এটা গঠন করলেন। এটা করতে গিয়ে তিনি কোনো আদর্শের ধার ধারলেন না। তিনি অভির মতো প্রতিভাবান গুণ্ডাকে নিয়ে জাহাজে গেলেন, তাকে বুঝিয়ে ছাত্রদল তৈরির কাজ দিলেন। আবার তিনি শাহ আজিজের মত স্বাধীনতা বিরোধীকে প্রধানমন্ত্রী বানালেন। মোজাফ্ফর আহমেদের মত লোককে বস্ত্রমন্ত্রীও বানালেন। জিয়ার মূল বিষয়টা ছিল আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে হবে। এ জন্য একটা শক্তি প্রয়োজন। সুতরাং কালো লোক, ভালো লোক, ভদ্রলোক-মন্দলোক টেকনোক্রেট ব্যুরোক্র্যাট সব মিলিয়ে ঘুষ-ভয় এই দুই অস্ত্র ব্যবহার করে দল তৈরি করলেন তিনি। আমেরিকার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা হলো– ঠিক আছে আমি ক্যাপিটালিজম করবো, তবে একটু রয়ে-সয়ে। ক্যাপিটালিজম প্রতিষ্ঠা করব কিন্তু সময়ের প্রয়োজন। তখন ক্যাপিটালিজমের মূল লড়াইটা কেন্দ্রীভূত হলো একটা জায়গায়; সেটা হলো, বড় বড় পাট কল, বড় বড় বস্ত্রকল বা প্রধান শিল্পগুলো যেগুলো সেক্টর কর্পোরেশনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছিল সেগুলো আওয়ামী লীগ আমলে যে নব্য ধনিক শ্রেণী তৈরি হয়েছে তাদের হাতে তুলে দাও। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উপর চাপ ছিল। আমেরিকা, বিশ্বব্যাংক চাপ দিল বিজাতীয়করন করতে হবে। পিওর ক্যাপিটালিজমের পক্ষে যদি কেউ হয়, তখন সে বলবে রাষ্ট্রের বাণিজ্য করার দরকার নেই, সব কমার্শিয়াল কাজ রাষ্ট্র থেকে ছেড়ে দাও। এ্যক্সট্রিম ভার্সনটা হলো রাষ্ট্র কোন কিছুতে হস্তক্ষেপ করবেনা। বাজারের মাধ্যমে সব হবে, ব্যাক্তি মালিকানার মাধ্যমে হবে। মজার বিষয় হলো, জিয়াউর রহমান ঠিক লেস এ্যাফেয়ার ক্যাপিটালিজমের লাইনটা নিলেন না। তিনি বললেন কোনো কারখানা সরকারি খাতে প্রফিটেবল হলে ওটা ডিন্যাশনালাইজেশন করবো না। যদি কোন কারখানা নন প্রফিটেবল হয়, সেটা করবো। এখানে আটকে গেল বিশ্বব্যাংক আর জিয়াউর রহমান। বিশ্বব্যাংক বলল আদমজি এখনই ডিন্যাশনালাইজ করতে হবে; জিয়াউর রহমান বললেন, আদমজি এখনো লাভজনক, তাই আমি এটা করবো না। জিয়াউর রহমান ধনতন্ত্রের ধারক; কিন্তু সেই ধনতন্ত্র আবার পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদের দাসত্ব করতে চায়না। কিছুটা জাতীয়তাবাদী স্পিরিট তার আছে। কিছুটা প্র্যাগমেটিক বিবেচনা তার আছে। জিয়াউর রহমানকে চলে যেতে হবে সাম্রাজ্যবাদকে যদি এখানে অবাধ আধিপত্য বিস্তার করতে হয় বা সে যদি তা চায়; তাই জিয়াউর রহমানকে চলে যেতে হোল। সুতরাং তিনি চলে গেলেন। তার জায়গায় যিনি আসলেন সাধারনত যাকে আমরা স্বৈরাচার বলি তিনি জেনারেল এরশাদ । তিনি প্রথম সাম্রাজ্যবাদের টোটাল ডিজাইনটা কার্যকর করলেন। এ ডিজাইনটার নাম স্ট্রাকচারাল এ্যাডজাস্টম্যান্ট প্রোগাম (স্যাপ)। এর মূল কথা হলো সেই সরকার সবচেয়ে ভাল যে কম কাজ করে। গোলাবারুদ, বর্ডার, আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ; আর কিছু দরকার নাই । বিদ্যুৎ, গ্যাস সবই প্রাইভেট সেক্টরে দিয়ে দিতে হবে, ভর্তুকি উঠিয়ে দিতে হবে। এরশাদ এ কাজগুলো একটার পর একটা করে গেছেন এবং এর প্রথমিক ফলাফল খুব খারাপ হলো। দুইদিক দিয়ে খারাপ হল। একদিক দিয়ে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেল। আবু আব্দুল্লাহ একজন ফেমাস ইকোনোমিস্ট। এরশাদীয় অর্থনৈতিক আমল সম্পর্কে একটি বই সম্পাদনা করেছিলেন, যেখানে দক্ষিণপন্থী উদারপন্থী সবার লেখা ছাপা হলো। সে বইয়ের টাইটেল হলো "ডিকেইড অব স্ট্যাগনেশন বা এক দশকের স্ট্যাগনেশন"। সে সময়ে প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ। বঙ্গবন্ধুর আমলে ৬ শতাংশ, জিয়াউর রহমানের আমলে ৩-৪ এর মধ্যে ছিল। পুরো এক দশক ধরে এরশাদ ৪ শতাংশে গিয়ে আটকে গেলেন। কৃষিতে ভতুর্কি উঠে গেল, কলকারখানার ক্ষতি হলো। ঠিক সেই সময় এরশাদের বিরুদ্ধে সব দলের আন্দোলন শুরু হলো। তবে অর্থনৈতিক ইস্যুটা সামনে আসেনি তেমনভাবে। অর্থনৈতিক ইস্যুটা এসেছিল মাঠে। শ্রমিক কর্মচারি ঐক্য পরিষদের আন্দোলনে। কৃষকরাও আন্দোলন শুরু করল। কিন্তু রাজনৈতিক ইস্যু থাকল একটাই: আমরা আর্মি রুল চাইনা। আমরা নির্বাচিত সরকার চাই। সুতরাং গণতন্ত্রের জন্য এবং স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট প্রোগামের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হল বলে এরশাদ আর ক্ষমতায় টিকতে পারলো না। শহরকেন্দ্রিক একটা মিনি অভ্যুত্থান সংঘটিত হল।
শহরবাসী এরশাদকে সমর্থন করেনি। তবে গ্রামে কোথাও কোথাও এরশাদের সমর্থক ছিল। এখনও আছে। সেটার কারণ হলো এরশাদ গ্রামে তার ভিত্তি তৈরির জন্য কতগুলো কাজ করেছিলেন যেমন গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প। তার একজন টেকনোক্রেট মন্ত্রী আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরশাদ কতগুলো রাস্তা ঘাট তৈরি করেছিলেন যে কারণে গ্রামাঞ্চলে তার একটা ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। যদিও অনেক কৃষকই তার পক্ষে ছিল না কারণ তিনি ভর্তুকি প্রত্যাহার করেছিলেন। আর শ্রমিকরা তো ছিলোই না কারন তিনি একের পর এক শিল্পকারখানা ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। শ্রমিকদেরকে নির্যাতন করেছিলেন। বড় ক্যাপিটালিস্টরা তার পক্ষে ছিলেন, কারণ ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ তাদের দিয়েছিলেন তিনি। ঐ সময় সৃষ্টি হয় দুটো ব্যাংক বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থা। যাদেরকে বিশ্ব ব্যাংক প্রচুর বিদেশী সাহায্য যুগিয়েছিল এবং সেই টাকা দিয়েই ঋণ খেলাপীর সংস্কৃতির শুরু। বড় বড় হাউসগুলো কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়েছিল।
যেখান থেকে আমরা বের হয়ে পরবর্তীতে গণতন্ত্রে এসেছি। একবার খালেদা জিয়া আরেকবার শেখ হাসিনা। শুধু একবারই পর পর দুইবার খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছিল। তাছাড়া প্রতিবারই একই চিত্র। মানুষ বুঝতে পারছে না, কাকে ক্ষমতায় আনবে, কে কী করবে। অর্থাৎ মানুষ একটা বিকল্প চাচ্ছে কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না।
এমন অবস্থায় রাজনৈতিক অর্থনীতিটা কী হবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। একটা হতে পারে যে আমরা আমাদের অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্র কায়েম করব। সেটার কোনো সম্ভাবনা এই মুহূর্তে প্রত্যক্ষ ভাবে নেই কারণ ৯০ দশকে পুঁজিবাদ বিশ্বপর্যায়ে একটি সাময়িক বিজয় অর্জন করেছে। এখানে সোসালিজম কায়েম করতে গেলে সমাজতান্ত্রিক দেশের যে সহায়তা প্রয়োজন, সেটা পাওয়া যাবে না। এখন বরং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো পুঁজিবাদী দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। তাদের মধ্যে দুর্নীতি ঢুকেছে, আমলাতন্ত্র ঢুকেছে, ফ্লেক্সিবিলিটি ঢুকেছে। এগুলো সংশোধনের চেষ্টাও তারা অবশ্য করছেন। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো পুঁজিবাদের ইতিবাচক দিকগুলো অনুসরনের চেষ্টা করছেন, যেটা "নেপ" আমলে লেনিনও করেছিলেন, যা ষ্ট্যালিন অবশ্য পরিত্যাগ করেন। পুঁজিবাদের ইতিবাচক দিকগুলো ব্যবহার করলে যে আশ্চর্য রকম সুফল পাওয়া যায়, তার বড় প্রমান চীন। চীন দেখিয়েছে বিড়াল কালো হোক সাদা হোক আমি সেটা দেখবোনা; শুধু দেখবো বিড়ালটা ইদুর ধরতে পারছে কিনা। এ কৌশলটা কিন্তু একটার পর একটা সামাজতান্ত্রিক দেশ অনুসরণ করে যাচ্ছে। যখন যেটা কাজে লাগবে, তখন সেটা অনুসরণ করতে হবে। এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেশন এক্সপোর্ট সাবষ্টিটিউশন– কোনটারই পক্ষে নই। আমার যেটায় লাভ হবে সেটিতে যাব। এই তত্ত্বটা এখন দিচ্ছেন অমর্ত্য সেন , স্টিগলিটজ। তারা বলছেন সোসালিজম ক্যাপিটালিজম এইটা ডিবেট নয়, ডিবেট হচ্ছে এই দুটি মিশ্রণের অনুপাত কী হবে। কোন দেশে কোন অনুপাতটা প্রযোজ্য। এটাকে প্র্যাগমেটিজম বলা হয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে কিছুটা প্র্যগমেটিজম দেখেছিলাম, জিয়াউর রহমানের মধ্যেও প্র্যগমেটিজম দেখেছিলাম। এই সময় ইব্রাহিম খালেদের বক্তব্যের মধ্যে আমরা প্র্যাগমেটিজম দেখতে পাই। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের একটা অংশের মধ্যে এখনো আমরা প্র্যাগমেটিজম দেখতে পাই। কিন্তু দক্ষিণপন্থী একটা অংশ এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক শক্তিশালী। সেই অংশটা কতটা শক্তিশালী তা উদাহরণ দিলে পরিস্কার হবে। একটি উদাহরণ হচ্ছে শেয়ারবাজার কেলেংকারী। ইব্রাহিম খালেদের মত লোকেরা বের করে দিল যে শেয়ার কেলেঙ্কারী কারা করেছে। বেআইনিভাবে নয় আইনের ফাঁক দিয়ে টাকাগুলি মেরে দিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের উচিত ছিল আইনের ফাঁক বন্ধ করে তাদের শাস্তি দেয়া। আবার কেউ বলতে পারে তোমার আইনে ভুল ছিল সেই ভুলের মাসুল তুমি দাও, আমি কেন দেব। সুতরাং এখন তুমি আইন সংশোধন করে আমাকে "এক্স-পোষ্ট"শাস্তি দেবে তা হয় না। তখন সরকার কী বলতে পারে? তখন সরকার বলতে পারে, এই টাকার উপরে তুমি কর দাও। সেটিও কিন্তু হচ্ছে না। আরেকটা উদাহরণ থেকে বুঝা যায়, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে একটা বিরোধ চলছে। বিশ্বব্যাংক বলছে এই প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। আমি যতদূর জেনেছি যে আসলেই দুর্নীতি একটু হয়েছে। কানাডিয়ান কোম্পানী ঘুষ দিয়েছে। এখন ঘুষটা কাকে দেয়া হয়েছে সেখান থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত সুতাটা টানা যাচ্ছে না। এটা হচ্ছে সরকারের সুবিধা। তার মানে এটা নয় যে বিশ্বব্যাংক ঋণটা বন্ধ করে ভালো কাজ করেছে। একটা লোক দুর্নীতি করেছে সে জন্য ঋণ বন্ধ করে দেওয়াটা ঠিক না। বিশ্বব্যাংকের এজেন্ডা অন্য জায়গায়। সেখানে ঘুষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। তাদের এজেন্ডা হচ্ছে বাংলাদেশকে লেস এফেয়ার ক্যাপিটালিজমে নিয়ে যাওয়া। এই সরকার যে বলছে শিক্ষা কোনো ব্যবসা না, শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা হবে। তার প্রাথমিক কাজ শুরু করা হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করার মধ্য দিয়ে। বিশ্ব ব্যাংক অবশ্যই এটা চাইবে না। তারা চাইবে প্রাথমিক শিক্ষাকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য। এই সরকার বলছে যে আমি কৃষিতে ভর্তুকি দিব, জ্বালানীতে ভর্তুকি সহসা এক লাফে কমাতে পারবো না বরং সহনীয় মাত্রায় কমাবো। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, এটা সরাসরি এডজাস্ট করতে হবে। তার মানে বিশ্ব ব্যাংকের পলিসির যে এক্সট্রিমিজম, তার সঙ্গে সরকারের কিছুটা দ্বন্দ্ব আছে। তবে বিশ্বব্যাংকের সুশাসন, দুর্নীতি ইস্যুগুলো ভালো। এখন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এইখানে পলিটিক্যাল ইকোনমি আটকে আছে। এই জায়গাটা পরিস্কার করতে না পারলে বা প্রধানমন্ত্রী যদি দেরিতে সিদ্ধান্ত নেন তাতে অর্থনৈতিক সংকটটা পেয়ে বসবে। সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের বিপক্ষে চলে যাবে, এক্ষেত্রে নির্বাচন হলে বিএনপি হয়তো নেগেটিভ ভোটে জিতে যাবে। এইখানে আমি একটা পলিটিক্যাল ইকোনমির সমস্যা দেখছি, যা আগামী এক দেড় বছরের মধ্যে প্রকাশিত হবে।
আরেকটি সমস্যা হল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে আরেকটি গ্রুপ আছে, সেটা হল জঙ্গী, সন্ত্রাসবাদী, ধর্মভিত্তিক ফোর্স, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের ফোর্স। তাদেরকে পরাজিত করতে পারলে গণতন্ত্রটা একরকম মুক্তি পাবে। গণতন্ত্রের মধ্যে তখন কে বেশি দক্ষিনপন্থী, কে কম দক্ষিনপন্থী, কে বামপন্থী, সেই বিষয়টা চলে আসবে। তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই ক্ষমতায় থাকত এবং পক্ষেরই শক্তি বিরোধী দলে থাকতো। কিন্তু সেটা হচ্ছেনা দুটো কারণে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তারা ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে ক্ষমতায় আসার জন্য বড় বাধা মনে করে না। কারণ তারা এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারছেন না। এ কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে প্রধান শত্রু মনে করে। এই সুযোগটাই ধর্মভিত্তিক দলগুলো ও এরশাদ নিচ্ছে। তারা কখনো আওয়ামী লীগের ঘারে ভর করে কখনো বিএনপির ঘারে ভর করে। এ জন্যেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত প্রশ্নটা বারে বারে অমীমাংশিতভাবে ফিরে আসছে। এটি সমাধান করতে পারলে সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের যে রাজনৈতিক অর্থনীতির নীতিমালা, সেটাতে হাত দিতে পারবো। তার ধারাবাহিকতায় আমাদের কী কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত, এটা কিন্তু ধাপে ধাপে আসবে। দুঃখের বিষয় হলো, সে জায়গাটায় হাতই দিতে পারছি না। এখন বাজেটে রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়টা হচ্ছে কয়েকটা ফোর্সের টানা পোড়েন। একদিকে দাতাদের টানাপোড়েন, যারা এটাকে এক্সট্রিম স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্টের দিকে নিয়ে যেতে চায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প সবকিছুর বেসরকারী মালিকানাধীন, ভুর্তুকিহীন অর্থব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে চায়। এখানেও দুইটি অংশের বিরোধ স্পষ্টত বিদ্যমান। আওয়ামী লীগের প্রগ্রেসিভ অংশ যারা নির্বাচনী ইস্তেহার লিখেছিল তারা দলকে সে দিকে নিয়ে যেতে চায় না। আওয়ামী লীগের একটা দল দোদ্যুাল্যমান, এইদিকে যাবে না ঐদিকে যাবে। আরেকটা দল হচ্ছে বিগ হাউজ যাদের প্রডাক্টিভ পথে একটা পা, আরেকটা পা লুটপাটের দিকে। সুতরাং বিগ হাউজের দিকে গেলে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি হবে না। মুক্তিযুদ্ধের অর্থনৈতিক চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হবে চারটা সেক্টরের দিকে যদি আমরা নজর দেই। একটা হচ্ছে রেমিটেন্স; একটা হচ্ছে আমাদের কৃষি; একটা হচ্ছে গার্মেন্টস সেক্টর এবং আরেকটা হচ্ছে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প। আওয়ামী লীগ যদি গণতন্ত্রকে অব্যাহত রাখতে চায়; তাহলে তাকে এ দিকেই যেতে হবে। বৃহৎ কেলেঙ্কারীর শাস্তি দিতে হবে। সরকার এখন নানামুখী টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের সবকিছু আমরা গ্রহণ করব–তাও না আবার সবকিছু বাদ দিব তাও না। এখানে নীতিতে নিষ্ঠাবান থেকে প্র্যাগমেটিক্যালি সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যেটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে আমরা সেটা করব।
এম এম আকাশ:অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।