Published : 02 Mar 2018, 07:49 PM
উলুবেড়িয়া লোকসভা এবং নোয়াপাড়া বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফলে সাম্প্রদায়িক বিজেপির দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার বিষয়টি এখন রাজ্য রাজনীতির একটি বহুল চর্চিত বিষয়। বিজেপি কী সত্যি প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসছে?
মিটিং, মিছিল, জমায়েতে বামদের যে ভিড় দেখা যাচ্ছে ভোট রাজনীতিতে তার প্রতিফলন দেখতে না পাওয়ার একমাত্র কারণ কী শাসকের হাতে প্রশাসনযন্ত্রের চাবিকাঠি থাকা, নাকি আরএসএস দেশের অন্যান্য প্রান্তের মতোই এ রাজ্যেও দীর্ঘদিন ধরে যে সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং চালাচ্ছে, তারই ফল? এবং অবশ্যই দলীয় রাজনীতির লাইনের বাইরে গিয়ে সিপিআই (এম) নেতা গৌতম দেবের 'দানার বদলে দানা' তত্ত্বের পাশাপাশি আরএসএস নেতাদের সুরে 'বসিরহাটে সারারাত ধরে মুসলমানেরা হিন্দুদের দোকান- বাড়িঘর লুট করেছে', এই চরম সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দায়ী?
এর পাশাপাশি তৃণমূলের ভিতরে এখনো যে মুকুল রায় ভাইসিস থেকে গেছে, সেই ভাইসিস- যে নোয়াপাড়াতে কিছুটা হলে ও বিজেপির ভোটের ঝুলি বাড়াতে সাহায্য করেছে। এ সহজ সত্যটিকেও কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারা যায় না।
কেন্দ্রে ডঃ মনমোহন সিং এর নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিন থেকে আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে আবার সাউথ ব্লকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে সামাজিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে শুরু করে দিয়েছিল। গত ২০১৪ এর লোকসভা ভোটে বিজেপির একক গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় তাদের একক গরিষ্ঠতা পাওয়া, এসবের পেছনেই সঙ্ঘের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা বড় ভূমিকা থেকেছে। সেই সামাজিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এ রাজ্যে আরএসএস যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে ঘটাচ্ছে তার মোকাবেলাতে শাসক তৃণমূল বা বিরোধী বামপন্থীদের তেমন কোনো সামাজিক এবং রাজনৈতিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
অ-বিজেপি দলগুলির সঙ্ঘের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মোকাবিলায় শৈথিল্য ক্রমান্বয়ে বিজেপির ভোট বাড়ার পিছনে যে একটি উল্লেখযোগ্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শান্তি কুঞ্জ হরিদ্বার নামক সঙ্ঘ পরিবারের একটি শাখা সংগঠন গঙ্গার দুই পারে শ্রমিক অধ্যুষিত মিশ্র জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বর্ণ নির্বিশেষে, লিঙ্গ নির্বিশেষে লোকেদের পৈতে পড়িয়ে তাদের ব্রাহ্মণ্যত্বে উপনীত করে দীর্ঘদিন ধরেই একটা বিশেষ ধরনের সামাজিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। এই সংগঠনটি মূলত আরএসএসের শাখা সংগঠন 'বনবাসী কল্যাণ আশ্রমে'র ছত্রছায়ায় থাকা একটি প্রতিষ্ঠান। দলিত, নিম্নবর্গীয়দের ব্রাহ্মণত্বে উত্তীরণের এই খেলা আরএসএস খুব জোরদারভাবে খেলেছিল গুজরাট গণহত্যার সময়ে। সেখানে তাদের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভেতর দিয়েই দলিত, আদিবাসী, তপসিলি জাতি- উপজাতিভুক্ত মানুষদের উচ্চবর্ণে উত্তরণের ভাওতা দিয়ে তাঁদের ব্যবহার করা হয়েছিল মুসলিম নিধনে।উলুবেড়িয়া লোকসভার বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে শুরু করে বারাকপুর শিল্পাঞ্চল- সর্বত্রই সঙ্ঘের এই সামাজিক প্রযুক্তির প্রক্রিয়া জোরদার আছে বেশ কয়েক বছর ধরে।
ধূলাগড় পর্বের পর যে সামাজিক মেরুকরণ আরএসএস হাওড়া জেলার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে করেছে তার সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনক হলেও স্বীকার করতে হয় প্রশাসনের ছোট্ট একটি অংশ জড়িয়ে আছে কিনা তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন। কারণ, ধুলাগড় পর্বে পুলিশের এক আধিকারিক আশান্তি প্রশমনে সরকারী নির্দেশে একাধারে ভূমিকা পালন করেছেন, অপর পক্ষে তিনিই আরএসএস- বিজেপির ঘনিষ্ঠ এক বুদ্ধিজীবীকে সঙ্গে নিয়ে নিজে আড়ালে থেকে একটি আপাত নিরীহ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করে সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন। এইসব ঘটনাপ্রবাহ গুলিকে উলুবেড়িয়া লোকসভার উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
ভোটে , বিশেষ করে উপনির্বাচনে শাসকের দাপট থাকে। এবারও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু যদি সিপিআই ( এম) নেতা গৌতম দেবের বসিরহাটের সাম্প্রদায়িক গোলমালের দায় সম্পূর্ণভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে ভুলে থাকতে চাই , তাহলে বিজেপির এই ভোট বৃদ্ধির অন্যতম কারণ আমরা কিছুতেই বুঝতে পারবো না।
গৌতম দেব যেভাবে আরএসএস- বিজেপি নেতার সুরে সুর মিলিয়ে বসিরহাটের ঘটনায়, 'মুসলমানেরা সারারাত ধরে হিন্দুদের দোকান গুলো পোড়াচ্ছে, হিন্দুদের বাড়িগুলো পোড়াচ্ছে। রাস্তায় শুধু মুসলমানেরা'- বলে ক্যামেরার সামনে বলেছেন তা এই উপনির্বাচনের আগে একটা ভয়ঙ্কর রকমের মেরুকরণের কাজ করেছে। গৌতম দেবের কথাতে কেবল সিপিআই ( এম) এর-ই কেবল ক্ষতি হয়নি, বামফ্রন্টের ভিতরে এবং বাইরে থাকা বামদলগুলোরসহ গোটা ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছে। গৌতম দেবের এই চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থান উলুবেড়িয়া লোকসভা এবং নোয়াপাড়া বিধানসভাতে বিজেপির ভোট বৃদ্ধির যে অন্যতম কারণ, দিনের আলোর মতো এই সত্যটিকে অস্বীকার করবার কনো উপায় নেই।
উপনির্বাচনে শাসকের দাপট, শাসক শিবিরের ভিতরে মুকুল ভাইসিস, যার ফল শাসক শিবিরের একটা ভোটের বিজেপি ঝুলিতে যাওয়া। এসবকে ছাপিয়ে সঙ্ঘের সামাজিক প্রযুক্তিকে মারাত্মক রকমভাবে সাহায্য করা গৌতম দেবের সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা একটা বড়ো অংশের ভোটারকে বিজেপির দিকে ঠেলে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক বিজেপির ভোট রাজনীতিতে এই দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার পিছনে সিপিআই ( এম) দল নয়, তাঁদের দলের বলিষ্ঠ নেতা ব্যক্তি গৌতম দেবের সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক কথাবার্তার যে অবদান রয়েছে, তার দায় কে নেবে?
আজ গৌতম দেবের এই চরম সাম্প্রদায়িক কথার জেরে অন্যান্য কারণকে সঙ্গী করেই বিজেপির যে ভোট বৃদ্ধি ঘটেছে তার প্রভাব রাজ্য এবং আংশিকভাবে হলেও জাতীয় রাজনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। গৌতম দেবের অপরিণামদর্শিতার এতো বড়ো মাশুল যে সিপিআই (এম) কেই কেবল নয়, গোটা বামপন্থী শিবিরকে দিতে হচ্ছে এবং ভবিষৎতেও হবে- তার দায় কে নেবে?
এই উপনির্বাচনের ফলে বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি রাজ্য রাজনীতিতে কতোখানি ইঙ্গিতবাহী হবে তা আগামী দিনই বলে দেবে। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে ব্যক্তি গৌতম দেবের এই চরম সাম্প্রদায়িক অবস্থান জাতীয় এবং রাজ্য রাজনীতির ক্ষেত্রে কেবল সিপিআই ( এম) এরই নয়, গোটা বামপন্থী শিবিরের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিতে পারে। আরএসএস – বিজেপি নেতাদের মতো কথা যদি সিপিআই (এম) এর সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্যের মুখ থেকে নিসৃত হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের সামনেই একটা বড় বিপদ দেখা দিচ্ছে- এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
শাসকের ভ্রুকুটিকে অস্বীকার করে, হিন্দু- মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে সিপিআই ( এম) সহ গোটা বামপন্থী শিবির রাজ্যে এবং রাজ্যের বাইরে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছে, সেইসব লড়াকু মানুষদের কাছে তাঁদের নেতা গৌতম দেবের মুখে- 'সারারাত ধরে মুসলমানেরা হিন্দুদের দোকানপাট লুট করেছে, বাড়িঘর লুট করেছে'- এই কথা কতোখানি মানসিক যন্ত্রণার জন্ম দিয়েছে সেকথা বোঝার মতো মানসিক স্থৈর্য যদি গৌতমবাবুর থাকতো তাহলে ওই কথা বলার পরের দিন ই তিনি নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতেন।
আজ পর্যন্ত ওই সাম্প্রদায়িক কথা বলার পর ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ গৌতম দেব করেন নি। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মতোই তিনিও বিশ্বাস করেন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কালে মুসলমানেরা সারারাত ধরে হিন্দুদের বাড়িঘরে লুঠতরাজ চালায়, তাঁদের দোকানপাটে লুটতরাজ চালায়।
এটা চরম বেদনার বিষয় যে ব্যক্তি গৌতম দেবের এই চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক কথাবার্তার জন্য সর্ব অংশে ধর্মনিরপেক্ষ সিপিআই (এম) দলের গায়েও সাম্প্রদায়িক অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ তোলার সুযোগ তাঁদের বিরোধীরা পেয়ে গেলেন। নয়ের দশকে বিপক্ষ গোষ্ঠীর নির্মল চট্টোপাধ্যায় বা অমিতাভ নন্দীকে হারাতে বিজেপি প্রার্থী তপন সিকদারের প্রতি কতোখানি সহানুভূতিশীল ছিলেন সে সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী তা নিয়ে আর নতুন করে আলোচনার দরকার নেই। এ রাজ্যে বিজেপিকে নির্বাচনী সাফল্য দেখাতে একদা সুভাষ চক্রবর্তীর অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। পরিস্থিতি সেদিন এতোটাই জটিল আকার ধারণ করেছিল যে, অসুস্থ অশক্ত জ্যোতি বসুকেও কাতর আবেদন জানাতে হয়েছিল মৃত্যুর আগে দমদম পুনরুদ্ধারের জন্যে। অবশ্য গোষ্ঠী স্বার্থে সুভাষবাবু বা তাঁর ঘনিষ্ঠদের দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে বিরোধীদের জেতানোর গৌরবজনক রেকর্ড আছে নৈহাটিতে। ১৯৮৭ সালের বামফ্রন্টের ভরা বাজারে ও সুভাষবাবুর ঘনিষ্ঠদের বদান্যতায় নৈহাটিতে হেরে গিয়েছিলেন সেই সময়ের আর এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআই ( এম) নেতা গোপাল বসু।
তপন সিকদারকে জিততে সাহায্য করে বিজেপিকে এ রাজ্যে পা রাখার যে সুযোগ সুভাষ চক্রবর্তী করে দিয়েছিলেন , আজ উপনির্বাচনের আগে 'দানা তত্ত্ব' দিয়ে বিরোধী শিবিরকে অহেতুক প্ররোচিত করে চরম মুসলিম বিদ্বেষী কথা বলে সেই বিজেপিকেই কি আবার একটা বাড়তি সুযোগ করে দিলেন গৌতম দেব?
গৌতম দেবের এই চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক অবস্থানের বিরোধিতা করা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সিপিআই ( এম) এর বিরোধিতা করা নয়। তাঁর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করার অর্থ হলো যেসব ব্যক্তি সিপিআই ( এম) দলে অবস্থান করে, নীতি নির্ধারণের শীর্ষ কমিটিতে থেকে দলের রাজনৈতিক নীতি আদর্শের চরম বিরোধী অবস্থান নিয়ে সাম্প্রদায়িক ও কায়েমী শক্তিকে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দেন, সেইসব রাজনীতির নাম করে অরাজনীতিক পরাজীবীদের বিরোধিতা করা।
এঁদের যদি বিরোধিতা না করা হয়, এঁদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি গুলি যদি মানুষের কাছে মেলে ধরা না হয়, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করবে না সেইসব জানা অজানা বামকর্মী, যাঁরা জীবন বাজি রেখে লাল পতাকাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। এই উপনির্বাচনে বিজেপির দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা এবং এই পটভূমি নির্মাণে সিপিআই (এম) নেতা গৌতম দেবের আংশিক ভূমিকার প্রেক্ষিতে আসুন আর একবার আমরা রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করে বলি; 'এ আমার পাপ, এ তোমার পাপ'।