Published : 25 Feb 2012, 06:53 PM
॥১॥
ফেব্রুয়ারির বিষন্ন এক শীত-সন্ধ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যের এডমন্ডের এক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জীবনের অনিত্যতা নিয়ে ভাবছি। জানালার ভারি পর্দা এক পাশে সরানো। নজরে এলো বাইরে হঠাৎ কেমন যেন আলোর দ্রুত অপসৃয়মানতা। শীতের বিকেলেও আলোর মেয়াদ থাকে অনেকক্ষণ এখানে। আজ কেমন যেন নিয়মের ব্যতিক্রম।
কামরায় ঢুকলেন সদা হাস্যময়ী সেবিকা স্যামি। মুখে তার সব সময়ে লেপ্টে থাকা সংলাপ: দেখতে আমাকে বয়সী মনে হয় না, আমি কিন্তু চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। স্যামির হাতে সাদা কম্বল। পরম মমতায় গরম উমে অসম্ভব মায়াময় কম্বলটি আমার ওপর মেলে ধরে স্যামি বললেন: বাইরে তুষার নামার আয়োজন চলছে। তাপমাত্রা হঠাৎ করে অনেকটাই পড়ে গেছে। শীত কাতুরে তুমি। অনেকগুলি ব্ল্যাংকেট যদিও তোমার ওপর চাপানো, একটা গরম কম্বল নিয়ে এলাম। তোমার ভালো লাগবে।
মমতাময়ী এই নারীর প্রাণোজ্জ্বল ব্যবহার হাসপাতালের নিরানন্দ দিনগুলিতে আমার কাছে মনে হতো উজ্জ্বল আলোর টুকরো। হাসতে হাসতে বললেন "তোমার স্ত্রীর সঙ্গে কিন্তু আমার পরিচয় করিয়ে দাও নি। ভয় নেই। আমি কিছু বলছি না তাকে।"
কথা বলতে বলতে পরিচর্যা, ওষুধ পরিবেশন সব দায়িত্ব শেষ করে বললেন, "এখন আমার ডিউটি শেষ। কাল সন্ধ্যায় আবার দেখা হবে। স্টে ওয়েল এ্যান্ড বি গুড! ঘন্টাখানেক পরে বরফ পড়তে শুরু করবে। আশা করি এর আগেই আমি বাসায় পৌঁছে যেতে পারবো। প্লিজ, প্রে ফর দ্যাট– তার জন্য প্রার্থনা করো, তুমি।"
কিছুক্ষনের মধ্যে মেয়েকে নিয়ে কামরায় ঢুকলেন দিলারা। সারা শরীর গরম কাপড়ে মোড়া। মাথায় হুডি। হাতে খাবারের বাটি। বললেন: বরফ পড়বে। তার আগেই বাসায় পৌঁছাতে হবে। খেয়ে নাও। এতো সন্ধ্যায় খেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না। বললাম: রেখে যাও। পরে খাবো।
রাগ করলেন দিলারা। বললেন: তুমি ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো না। নার্সরা অভিযোগ করেছেন। কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো না। প্রকৃতির বিষন্নতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মনে কেমন যেন এক ধরণের দুঃখবোধ থেকে থেকেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিলো।
মাথার কাছে চেয়ার টেনে বসলেন দিলারা। কন্যা প্রীতু আমার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে খোঁজ খবর নিতে এদিক সেদিক যাওয়া আসা করছে।
কী যেন বলতে গিয়েও বলছেন না দিলারা। হঠাৎ করেই দুঃসহ সংবাদটি দিলেন তিনি। মেহেরুন রুনী-সাগর দম্পতির খুন হওয়ার অবিশ্বাস্য সংবাদটি। মুহূর্তের মধ্যে আমার স্মৃতিশক্তি যেন লুপ্ত হয়ে গেলো।
কী হচ্ছে আমার প্রিয় জন্মভূমিতে ! মৃত্যুর কাফেলা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মৃত্যু, অপমৃত্যুর এই মিছিলে সর্বশেষ যুক্ত হলো তরুণ সাংবাদিক দম্পতির নাম। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের জগতে তরতাজা দু'টি নাম। ব্যক্তিগত ভাবে দু'জনের কারো সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। পরিচয় তাদের কর্মতৎপরতার সঙ্গে। সেটাই তো বড় কথা। ব্যক্তি পরিচয় তো বাহুল্য মাত্র। দিলারা বললেন: আহারে, মেয়েটা আমার ছাত্রী ছিলো শাহীন ইস্কুলে-আশির দশকের মাঝামাঝি। প্রীতুর ক্লাস ফেন্ড। ফেসবুকে প্রীতুর সঙ্গে কথা হতো। প্রতিবারই তার ম্যাডামকে সালাম জানাতে বলতো মেয়েটি। আহারে… বলে দুই চোখের পানি মুছতে শুরু করছে দিলারা।
দেড় বছরাধিক প্রবাস জীবনে এমন মর্মন্তুদ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খবর আর পাইনি। পাবো এমন ধারণাও ছিলো না।
ভালোই ছিলাম হাসপাতালে। দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। দেয়ালের টিভি নির্বাক। মার্কিন টেলিভিশনের অনুষ্ঠানেও আনন্দ নেই।
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল নেই। নার্স এসে জাগালেন। রাত এগারোটা। ওষুধ খেতে হবে। এই এক বিরক্তিকর ব্যাপার এখানে। ঘুম থেকে উঠিয়েও ওষুধ ইনজেকশন দেয়ার ব্যাপারটা। নার্স বললেন, তোমার খাবারতো ওভাবেই পড়ে আছে। খাবে না, ট্র্যাশ করবো ?
বললাম, ট্র্যাশ করো এবং প্লিজ লেট মি স্লিপ। ঘুমের মধ্যেই আমি বাস্তবতা থেকে পালাতে চাই।
॥২॥
দুই দিন পর ডা: হাল নিজে থেকেই বললেন, চাইলে আমি এখন বাসায় যেতে পারি।
বলে কি ! বাসায় যেতে পারলেও এখানে পড়ে থাকবো আর কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করবো, এমন চিন্তা কে করে !
ঘন্টা খানেকের মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাসায় যখন ফিরলাম, বিকেল তখন তিনটা। শীত সন্ধ্যার বিষন্নতার মাঝে আপনজনদের কাছে ফিরে আসতে পেরে কী যে ভালো লাগলো:
গৃহে প্রত্যাবর্তনে শুধু যে আপনজনদের মাঝে ফেরা হলো, তা নয়। সংযোগ সাধিত হলো এই ক'দিন বিচ্ছিন্ন দেশের খবরাখবরের সঙ্গেও। স্যাটেলাইট ব্রডকাস্টিং-এর কল্যাণে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়।
শুয়ে শুয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে পরিবেশিত সংবাদ শুনি। সব চ্যানেলের সংবাদের অগ্রে সাংবাদিক-দম্পতির নৃসংস হত্যাকাণ্ডের খবর। ভয়াবহ সব বর্ণনা। বিভিন্ন জনের বক্তব্য: বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য শোনাতে ইলেকট্রনিক মিডিয়া উদগ্রীব। বক্তাদের কাতারে শামিল রাজনীতিক। আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনীর পদস্থ কর্তাব্যক্তিরা, ডাক্তার আর অপরাধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিছু মানুষ !
শুরু হলো সময়-সীমা আরোপের মতো অবিশ্বাস্য আশ্বাস। যেন ঘটনা ঘটেছে হুকুমে এবং ঘটনার রহস্যও জানা যাবে হুকুমে নির্দিষ্ট সময় শেষে। শুনে চমকিত হই। আট চল্লিশ, আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই উন্মোচিত হবে রহস্য। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সর্বোচ্চ ব্যক্তির মুখনিসৃত এই আশ্বাসবাণী শুনে চমকিত হই। কী জানি, তার কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য থাকলেও থাকতে পারে, যার বলে বলীয়ান হয়ে এমন অমোঘ আশ্বসবাণী উচ্চারণ করা সম্ভব হতে পারে।
ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার ক্ষিধে নাকি তীব্র আর এর চাহিদা নাকি হাঙ্গরের দাঁতের সুতীক্ষ্ণ। শুরু হলো বিভিন্ন জনের মুখ নিঃসৃত বাণীর অনর্গল স্রোতধারা। যেন অপরাধ বিজ্ঞানের শাখা থেকে রচনা পাঠ শুনছি। ক্রাইম সিন, ডিএনএ, জনগণের সচেতনতা আলামত নষ্ট না করা – কতো রকম উপদেশ। তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি বলা বলা ঠিক হবে না, এমন বলেও বলার জন্য মুখ নিশপিশ করে কর্তাব্যক্তিদের কতো রকম বিশেষণ। প্রয়োগ আর অপপ্রয়োগে সমৃদ্ধ আ. মরি বাংলাভাষা। তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ডাক্তার সাহেব ফরেনসিক রিপোর্ট দিতে গিয়ে, অনাবশ্যকভাবে যেন নারকীয় আনন্দে বলেন, তদন্তে অমুক বস্তু পাওয়া যায় নি।
অতএব…। ইত্যাদি ভিকটিম আমার সন্তান-তুল্য ভাবতে গিয়ে গা শিউরে ওঠে।
এর মধ্যে মশলা মিশেলের মতো রুনী-সাগরের ব্যক্তি জীবন নিয়ে মৃদুকালে কিছু কথা উঠতেই সুস্থ চিন্তাসম্পন্নদের প্রতিবাদের মুখে তা চুপসে যায় তপ্ত কড়াইয়ে কলমি শাকের মতো। একজন নেতৃস্থানীয় সাংবাদিক তো রীতিমতো, সাংবাদিক-পাঠক থিয়োরি প্রতিষ্ঠা করে বসতে চাইলেন, শ্রোতা-পাঠকরা যা জানতে চাইবেন, তা জানাতে আপত্তি নেই।
সাংবাদিকরা আন্দোলনে নামলেন হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই দেখে। দ্বিধাবিভক্ত সাংবাদিক-শ্রেণী এই এক ইস্যু-নির্ভর ঐক্য গড়ে ফেলেন আপাতত:। সাংবাদিক নেতা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে সকাল-দুপুর গুলিয়ে ফেলে ১২টা থেকে এক ঘন্টা কর্মবিরতির ঘোষণা দিলেন। এক লাইনের এক ঘোষণায়, এবং যা শোনার জন্য উদগ্রীব শ্রোতা, এমন গুলিয়ে ফেলা। নেতা কি ঘোষণার বিষয়ে আগাম অবহিত ছিলেন না, না ঘোষণার সঙ্গে সহমত ছিলেন না ?
রুনী-সাগর দম্পতির হত্যারহস্য এখনো উদঘাটিত হয়নি। কবে হবে? শুধু ভবিষ্যতই তা বলতে পারবে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এখন টনক নড়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের জন্য কোন কোন সুযোগ সুবিধা এদেশে দুর্লভ, জনবলের অভাব কতো তীব্র, জনগণ কতো অসচেতন-ইত্যাকার বাক্যাবলী চমকিত হয়ে শুনি, মিডিয়ায় কর্তাব্যক্তিরা আগের মতোই সরব। মিডিয়াও তাদের কাছে ছুটে যায়, তাদের মুখ নি:সৃত বাণী ধারণের জন্য।
কেউ কেউ মর্মন্তুদ ঘটনার কথা বলতে গিয়ে মুখের কোনে সুক্ষ্ণ হাসির আভাসও ছড়িয়ে দেন। হয়তো প্রকৃতিগত সেই সুক্ষ্ণ হাসির রেখা।
এতোদিন ধরে যা দেখছি, মনে হয়, একটি মর্মান্তিক জোড়া খুনের ঘটনায় আমাদের অনেক ধরণের সীমাবদ্ধতা একসঙ্গে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
আমাদের অনেক কিছুরই অভাব।
এই মুহূর্তে মনে হয় সবচেয়ে বেশি অভাব জনসমক্ষে কিছু বলার মতো প্রশিক্ষণের। পাবলিক স্পিকিং যে এক ধরণের শিল্পকর্ম, তা যেন নতুন করে উপলদ্ধি হচ্ছে।
সেই সঙ্গে কড়া বিভাজনে চিহ্নিত হলো আমাদের দায় ও দায়হীনতার দিকটিও।
ফখরুজ্জামান চৌধুরী : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক।