Published : 24 Feb 2012, 07:03 PM
রুনী-সাগরের নিহত হবার ঘটনা পত্রিকায় পড়ে দুঃখ পেয়েছি। বেশ হৃদয়বিদারক ঘটনা। এমন নৃশংস মৃত্যুর ঘটনা আমাদের শোকাচ্ছন্ন করে, ভাবিত করে। তাদের ছোট্ট পাঁচ বছরের ছেলে মেঘের অবুঝ দৃষ্টিও আমাদের ব্যথিত করে। সাংবাদিক দম্পতির এমন মৃত্যু দেশের পুরো সাংবাদিক সমাজকে আহত করেছে। আমরা অবিলম্বে অপরাধীর শাস্তি দাবিও করেছি। দেশব্যাপী সাংবাদিক সমাজ বিক্ষুদ্ধ; মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন করেছেন। সামনে আরও বিক্ষোভ করবেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে এই হত্যাকাণ্ড কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজের ঘটে যাওয়া আরও ঘটনার মত। সাংবাদিকরা তো সমাজেরই অংশ। সুতরাং এই নিষ্ঠুর ও আপাত দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কিত এই হত্যাকাণ্ড আমাদের সামাজিক অবক্ষয়কে মনে করিয়ে দেয়। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে কী এমন কারণ ছিল যে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে হত্যার করেছিল খুনী ? হত্যা ছাড়া কি সমস্যার সমাধান হতে পারতো না। তাদের শুভ্যানুধায়ীর সংখ্যা, নিশ্চয় কম নয়। তারাই যখন পারেন নি, তখন এমন শোকাবহ পরিণতি আমাদের শঙ্কিত করে তোলে।
আমরা দেখেছি এমন ঘটনা ঘটে যাবার পর অনেক সত্য মিথ্যা কথা ছড়ায়, কেউ কেউ তার সঙ্গে রঙও মেশায়। এক্ষেত্রেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা পারিবারিক, প্রতিবেশি ও তদন্তকারি পুলিশের মুখে যা শুনে থাকেন তা-ই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। অতীতে অনেক হত্যাকাণ্ডের পর যেসব সংবাদ পত্রিকায় পড়েছি তা-ও এখন মনে পড়ে যাচ্ছে।
এই ঘটনার সময় আমি দেশে ছিলাম না। দেশে ফেরার পর অনেকের কাছে শুনলাম একটি চ্যানেলে নিহত রুনী-সাগরের পাঁচ বছরের ছেলে মেঘের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছে। সেখানে মেঘকে এমন কিছু প্রশ্ন করা হয় যা শিশুদের করা উচিত নয়। যেহেতু আমাদের সংবাদ প্রচারে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কোন নীতিমালা নেই, সুতরাং তারা যা ইচ্ছা তা নিশ্চয় করে থাকেন। অথচ সাংবাদিকতার নীতি ও সততায় অনেক দেশে তা করা যায় না। সেখানে সমাজে বিরূপ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার একটা মূল্য আছে। সেসব দেশেও সন্তানের সামনে পিতামাতা ঝগড়া করেন, একে অপরকে মারধরও করে থাকেন এবং নিহতও হয়ে থাকেন। কিন্তু সমাজের আর পাঁচটা শিশু ও পরিবারের কথা মাথায় রেখে যা ইচ্ছা তা-ই প্রচার বা প্রকাশ করা যায় না। আমি সাক্ষাৎকারটি দেখিনি। যারা দেখেছেন তারা ভীষণ ক্ষুদ্ধ চিত্তে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আমাদের সাংবাদিকতার দায়িত্বহীনতার কথাও বলছিলেন। ঐ অবুঝ শিশুটি তার মা-বাবাকে হত্যার দৃশ্য হয়তো দেখেনি, হয়তো দেখেও থাকতে পারে। তাদের রক্তাক্ত দেহও পড়ে থাকতে দেখেছে। এই নৃশংসতার একমাত্র সাক্ষী সে হতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু তাই বলে তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রশ্ন করে ঘটনার বিবরণ শোনা এবং প্রচার করাটা কখনও সাংবাদিকতার নীতিমালার মধ্যে পড়ে না। আমাদের মনে রাখতে হবে শিশুটির মানসিকতা। সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং পিতৃ-মাতৃহীন শিশুটির প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে তাকে এভাবে প্রশ্নে জর্জরিত করে সাক্ষাৎকার নেবার জন্য কি সময়টা সঠিক ছিল ? আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষের ক্ষোভ দেখে উপলদ্ধি করা যায় শিশু অধিকার বলে একটা নীতি আছে, সেই নীতির প্রতি সম্মান রেখে আমাদের উচিত তার সাক্ষাৎকার নেয়া। এটা শুধু সেই শিশুটিই নয়, সেই সঙ্গে যারা দেখছে ও শুনছে সেই শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। তাদের মনের ভেতরও বিষয়টি দীর্ঘ দিন থেকে যায়। আমরা যারা সাক্ষাৎকার নেই তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কার নিচ্ছি-কেন নিচ্ছি-কাদের জন্য নিচ্ছি। যার সাক্ষাৎকার নেব তার সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার প্রতি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।
আমাদের দেশে সাংবাদিকতায় চমক সৃষ্টি করার জন্য অনেকে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা নেন এবং প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জনের সুযোগ নেন। অতীতে দেখেছি কোন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে তার ছবি ও পরিচয়, সাক্ষাৎকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হতো। অথচ অপরাধী ধর্ষকের ছবি বা নাম ও পরিচয়ের খবর থাকতো না। পরবর্তীতে সরকার ধর্ষিতার ছবি ও নাম ছাপানো নিষিদ্ধ করে দেয়। আমার মনে হয় শিশুদের সাক্ষাৎকার প্রচারের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা উচিত। ঘটনার তদন্তের জন্য যতখানি সম্ভব নরম ভাষায় কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু জনসমক্ষে ব্যাপক প্রচারের কোনও মিডিয়াকে কতখানি সুযোগ দেয়া হবে– সেটাও আইনসঙ্গত কিনা তা নিয়েও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আমি নিজেও একজন সাংবাদিক-লেখক। পত্রিকা, বিটিভি ও বিবিসির জন্য অনেক সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রচার করেছি।
সাক্ষাৎকার আমার প্রিয় বিষয়। থমসন ফাউন্ডেশন থেকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছিলাম। আমাদের বলা হয়েছিল, সাক্ষাৎকার যার নেয়া হবে এবং যার উদ্দেশ্যে প্রচার হবে তাদের অবস্থান এবং মর্যাদাকে সম্মান দেয়া উচিত। সাংবাদিক চরিত্র হবে অনুসন্ধান করা এবং বস্তুনিষ্ঠতা তুলে ধরা। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে কতখানি দেব, কী দেব সে ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের থাকতে হবে। স্বাধীনতার সুযোগ আছে ঠিকই কিন্তু তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। অপব্যবহার করে, সাংবাদিকতার নীতি ও চরিত্র নষ্ট করা ঠিক হবে না। সরকারে উচিত একটি প্রচার নীতিমালা প্রণয়নের।
২৩.২.২০১২