আদিবাসী নারীর ঘর কীভাবে ছোট হয়ে আসে?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা পুরুষের চেয়ে কতটা এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন থাকলেও মূলধারায় এসে একজন আদিবাসী নারী কতটা অধিকার পায়, তা নিয়ে কোনো গবেষণা, প্রতিবেদন হয় না।

ডালিয়া চাকমাডালিয়া চাকমা
Published : 8 March 2024, 07:29 AM
Updated : 8 March 2024, 07:29 AM

আমরা আজকাল নারীর ক্ষমতায়ন শব্দবন্ধটি খুব শুনতে পাই। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, উন্নয়নসংস্থা, গণমাধ্যম, সমাজমাধ্যম সর্বত্রই আজকাল এই শব্দবন্ধটি হরহামেশা ব্যবহার হয়। সব মাধ্যমেই নারীর সমস্ত প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প উঠে আসে। এতে অনেকে অস্বস্তি বোধ করলেও বলা চলে সমাজে নারীদের এই ক্ষমতায়নকে সাধুবাদও জানাচ্ছেন অনেকেই।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ শব্দবন্ধটি নারীর গণ্ডিকে সীমিত করে দিচ্ছে না তো? এই প্রশ্নটিতে হয়তো মনে হতে পারে আমি নারীর ক্ষমতায়ন চাই না। ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং আমি চাই নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন হোক। আপাতদৃষ্টিতে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্পের মধ্যে যে আরও নানান সূক্ষ্ম বিষয়, বঞ্চনা, সংগ্রাম, যাতনা, শোষণ, শ্রেণিপ্রশ্ন রয়েছে, সেসব আলাপের মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজে সমতার সম্পর্ক তৈরি হোক, এমনটাই তো চাওয়া উচিত।

এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন দিয়েই আমরা এগোতে পারি। যেমন, কোন নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে? বাংলাদেশের সকল নারী একইরকম পরিচয় ধারণ করেন না। এখানে মূলধারার নারীরা তো রয়েছেই, আদিবাসী আছে, শ্রমিক আছে, আছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত, উচ্চশিক্ষিত— এরকম নানান পরিচয় ও অবস্থানের মানুষ। অর্থাৎ বলা চলে নারীর পরিচয় কেবল নারী নয়; তার দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র কাঠামোতে এই পরিচয় নানান রকমের হয়ে থাকে এবং সেই অনুযায়ী তার সংগ্রাম চলমান থাকে। এরকম বাস্তবতায় সকল নারীর এগিয়ে আসার ম্যারাথন দৌড়ের রাস্তার মাপ সমান নয়। তাই সত্যিকারের ক্ষমতায়ন ঘটাতে চাইলে এসকল বর্গগুলোকে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে সেই অনুযায়ী আইন, নীতি, কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করে কাজ করতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আইন, নীতি, রাষ্ট্রীয় সংবিধান এসব কঠিন কঠিন প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়-আশয় সমাজের অভ্যন্তরে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক সেখানে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে? এই প্রশ্নটা আমাকে প্রায়শ ভাবায় নিজের অভিজ্ঞতা উপলব্ধি থেকে। আমার জন্ম, জীবন আমাকে অনেকগুলো পরিচয় দিয়েছে। আমি আদিবাসী। চাকমা জাতির একজন মানুষ। আমার জেন্ডার নারী। ধর্মীয় পরিচয়ে বৌদ্ধ। রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যালঘু। রাষ্ট্র অবশ্য আমাকে আদিবাসী নয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে পরিচিত করাতে চায়। আমার এমন অনেকগুলো পরিচয়, আমাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন বাঙালি মুসলমান নারীর জীবন সংগ্রাম থেকে আলাদা করেছে। এর মানে এই নয় আমাদের উভয়ের জীবন সংগ্রাম একেবারেই আলাদা, কিছুক্ষেত্রে মিল যেমন রয়েছে, রয়েছে ভিন্নতাও। যেমন, একজন মুসলিম বাঙালি নারীকে লড়াই করতে হয় মূলধারার বৃহত্তর সমাজের পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে। পক্ষান্তরে আদিবাসী নারীর লড়াই বহুমাত্রিক যেখানে তাকে একদিকে যেমন নিজের সমাজের পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, অন্যদিকে বৃহত্তর সমাজের পুরুষতন্ত্রের সঙ্গেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আদিবাসী হওয়ার সুবাদে এই রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংগ্রামটা কঠিনতর হয়।

এত লড়াইয়ের মধ্যে ভেতরে ভেতরে যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে চলেছে ক্রমশ, সেগুলোর মাশুল নারীর ওপরেই এসে পড়ে। আদিবাসী সম্পর্কে বৃহত্তর সমাজের বাঙালি মননের এক অংশে যেমন নেতিবাচক ধারণা আছে যে আদিবাসীরা অসভ্য, জংলী, গাছপালার পূজো করে, যা তা খায়, আবার অন্যদিকে এমনও বলা হয় যে আদিবাসী সমাজ মাতৃতান্ত্রিক, এখানে নারীরাই পুরুষের ভূমিকা পালন করে থাকে এবং অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে থাকে বাঙালি সমাজের পুরুষের মতো। অথচ, খেয়াল রাখা হয় না আদিবাসী সমাজের মধ্যে বৃহত্তর জাতির সান্নিধ্য কীভাবে সামাজিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এমনকি পরিবর্তন ঘটাচ্ছে আদিবাসী সমাজের পুরুষদের মধ্যেও, যার ফলে আদিবাসী নারীর সংগ্রামের মধ্যেও যুক্ত হয়েছে নানান মাত্রা।

আমাদের মনে রাখা উচিত, কোনো সমাজ কালের পর কাল একইরকম অনড়-অপরিবর্তনশীল থাকে না। সমাজ-সংস্কৃতি সবকিছুই ক্রমাগত রূপান্তরিত হতে থাকে। কোনো অঞ্চলে বহুজাতির পাশাপাশি অবস্থানের কারণে পারস্পরিক অনেক চিন্তা, চেতনা, চর্চার লেনদেন ঘটে। শান্তিপূর্ণ জবরদস্তিবিহীন অবস্থানের ক্ষেত্রে সহাবস্থান ঘটে, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু যখন সেখানে কোনো জাতির দ্বারা অপর জাতির ওপর একপাক্ষিক ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, শোষণ, দখলের ঘটনা ঘটে তখন সেখানে সহাবস্থান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বরং তৈরি হয় ক্রমাগত সংঘাত ও জুলুমের ক্ষেত্র। এই জুলুম কেবল জাতিতে জাতিতে থাকে না, এই জুলুমের রক্ত বয়ে চলে নিজের ভেতরেও।

যেমনটা আদিবাসী সমাজে ঘটছে। আদিবাসীদের জমি জোরপূর্বক দখল, তাদেরকে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা, গণহত্যা চালানো অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের সীমানায় প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণে আদিবাসী সমাজের ওপর যে নিপীড়ন চলে, তার প্রভাবে আদিবাসী সমাজেও তৈরি হয়েছে প্রবল জাতীয়তাবাদী চেতনা। আর জাতীয়তাবাদের মধ্যে থাকে পুরুষতান্ত্রিক একটি চেতনা, যেখানে পুরুষ জাতীয়বাদের রক্ষক ও জাতির নিরাপত্তাদানকারীর ভূমিকা নিয়ে থাকে। ওই রক্ষক ভূমিকা নিতে গিয়ে পুরুষ মূলত প্রভু হয়ে উঠতে চায়, যেখানে সে নারীর সীমানা চিহ্নিত করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। তাহলে কি নারীর ঘর সীমাবদ্ধ হয়ে আসে না?

আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় দেখতাম পাড়ার নারীরা জঙ্গলে যেতেন শাকসবজি তুলতে। বেশ দূরেই ওই জঙ্গলগুলো। দুই-তিন জন মিলে গিয়ে শাকসবজি তুলে আসার পথে পরিচিত ঘরের লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে করতে ফিরতেন। পরে ওই জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্প হলো। সেখানে নারীরা আর যেতে পারেন না। আবার দেখতাম ছড়ায় গোছল করতে যেতেন আদিবাসী নারীরা। আদিবাসী সমাজে যেহেতু আব্রু নিয়ে তেমন কোনো ছুতমার্গীয় ব্যাপার-স্যাপার নেই, তাই নারীদের এই খোলা আকাশের নিচে বুক পর্যন্ত বসনে স্নানের দৃশ্য কখনোই কামনাকারী বিষয় হিসেবে দেখা হয়নি। কিন্তু সেখানে যখন আশেপাশে বাঙালি সেটেলারদের ঘর হলো, সেই নারীদের স্নানের জায়গাও আর নিরাপদ রইলো না। এদিকে উন্নয়নের নামে, ট্যুরিজমের নামে, বন সংরক্ষণের নামে আদিবাসীদের পূর্বপুরুষদের জমি দখল হতে হতে পায়ের সীমানা ছোট হয়ে আসে, আকাশের সীমানা ছোট হয়ে আসে।

এসব তো গেল আদিবাসী নারীর বিচরণস্থল কীভাবে সংকুচিত হয়ে গেল তার গল্প। নারীর দুই পা এখন ঘরের উঠান আর ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই ঘরও আর নারীর জন্য বিপত্তিহীন হয়ে রইল না। আমার মনে পড়ে এক মান্দি (গারো) নারীর সঙ্গে কথোপকথনের কথা। তিনি একজন উদ্যোক্তা। ব্যবসার কারণে নানান জায়গায় ছুটতে হয়। বলছিলেন, “দিদি, আপনাদের তো তাও নিজের মানুষদের নিয়ে পাড়া আছে। আমাদের তো তা নেই। বাড়ির পাশেই বাঙালি পড়শি। ব্যবসা করতে গেলে তো কে বাঙালি, কে গারো, সেটা দেখার সুযোগ নেই। দেখা যায় মার্কেট সব বাঙালিরা নিয়ন্ত্রণ করেন। আমাকে তো তাদের কাছ থেকেই পণ্য কিনে নিয়ে আসতে হয়। তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। কিন্তু এসব নিয়ে ঘরে অশান্তি হয়। হাজব্যান্ড অনর্থক সন্দেহ করে, বাঙালিদের সাথে কাজ করি বলে মানসিকভাবে অত্যাচার করে।”

‘আপনাদের’ বলতে ওই নারীটি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের বুঝিয়েছিলেন। এই কথোপকথন তুলে ধরলাম এটা বুঝানোর জন্য যে কীভাবে আদিবাসী সমাজের পুরুষতন্ত্রও রূপান্তরিত হচ্ছে। তাই সামাজিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে মূলধারার বাঙালি মননে আদিবাসীদের সম্পর্কে যেই ধারণাটি রয়েছে যে, আদিবাসী নারীরা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেন, সেই ধারণাটিকে উল্টে-পাল্টে দেখা দরকার। নাহলে নারীর ক্ষমতায়নে ‘সকল বাঁধা পেরিয়ে নারীর এগিয়ে আসার’ গল্পে আদিবাসী নারীর সংকট অন্তর্ভুক্ত হবে না।

ভূমির সংকট, নিরাপদ আবাসনের সংকট— মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। ভূমি আর কেবল আবাস থাকে না, ভূমি হয়ে উঠে ভোগ্য সম্পত্তি। তখন প্রশ্ন ওঠে, কে হবে ভূমির মালিক। আদিবাসী সমাজের যে ঐতিহ্যবাহী প্রথা সেখানে নারীর জন্য আলাদা কোনো ভূমির অধিকারের প্রসঙ্গ ছিল না। কিন্তু দিনকে দিন যখন আদিবাসীদের ভূমি ক্রমাগত দখল হচ্ছে, উচ্ছেদ হতে হচ্ছে, তখন ভূমির ওপর, সম্পত্তির ওপর মালিকানার বিষয়টি সামাজিকভাবে একটি উদ্বেগজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে।

বাংলাদেশে চারটি জাতিগোষ্ঠী বাদে বাকি সকল আদিবাসী জাতিসমূহের প্রথাগত আইনে উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নেই। পরিবারের প্রধান কর্তা পুরুষটির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে নারী সম্পত্তির ভাগ পাবে কি পাবে না। অন্যদিকে, মাতৃতান্ত্রিক জাতি হিসাবে পরিচিত গারো, খাসিরা নামে মাতৃতান্ত্রিক হলেও অভ্যন্তরীণ সামাজিক ব্যবস্থাপনা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মতোই যেখানে ঐতিহ্যবাহী প্রথার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বপূর্ণ পদগুলো পুরুষরাই পান। মারমা ও রাখাইনদের মাতৃসূত্রীয় বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা কতটা মাতৃসূত্রীয় এ নিয়ে সংশয় করার অবকাশ রয়েছে। তাদের নারীরা উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তির অধিকার পায়। সার্বিক বিবেচনায় ক্ষমতায়নের সঙ্গে যে নিজের ঘর, নিজের অর্থ, নিজের সম্পদ, নিজের সিদ্ধান্ত, অধিকারের সঙ্গে সম্পর্ক, তা আসলে প্রকৃত অর্থে আদিবাসী নারীর জন্য তার নিজের সমাজের মধ্যেই নেই।

এমতাবস্থায় যখন মূলধারায় নারীর ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়ায় নারীকে এগিয়ে আসার জন্য নানা ধরণের আইন, নীতির প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন চলছে, তাতে আদিবাসী নারী কতটুকু অংশগ্রহণ করতে পারে? আজকাল কর্ম বা পড়াশুনার খাতিরে অনেক আদিবাসী শহরে এসে থাকছে। থাকতে গিয়ে তাদের প্রতিনিয়ত নানা ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়। বাসা না পাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, পোশাকের কারণে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। একজন আদিবাসী পুরুষকে একা থাকতে হলে এসব সমস্যা যতটা মোকাবেলা করতে হয়, একা আদিবাসী নারীর জন্য সেই সংকট আরও দ্বিগুণ।

সংখ্যাগুরুর মননে আদিবাসী সম্পর্কিত ধারণা থেকে উদ্ভূত ফ্যান্টাসি ও কামনার কারণে কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আদিবাসী মেয়ে ও নারীদেরকে প্রায়শ যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়, যা মূলধারার গণমাধ্যমে উঠে আসে না বললেই চলে, কারণ সেসব নিয়ে থানা-পুলিশ-মামলা পর্যন্ত যাওয়ার সাহস থাকে না আদিবাসীদের। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা পুরুষের চেয়ে কতটা এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন থাকলেও মূলধারায় এসে একজন আদিবাসী নারী কতটা অধিকার পায়, তা নিয়ে কোনো গবেষণা, প্রতিবেদন হয় না। কেন হয় না সেটা তলিয়ে দেখলে দেখতে পাব একজন বাঙালি নারীর চেয়েও কতটা দুর্বল অবস্থানে থাকতে হয় একজন আদিবাসী নারীকে।

মূলধারার একজন নারীর এগিয়ে আসার পথে যে প্রতিকূলতা সেটা সামাজিক সমস্যা, অন্যদিকে আদিবাসী নারীর প্রতিকূলতা রাষ্ট্রীয় ও পরিচয়বাদী রাজনীতির সমস্যা। তাই আদিবাসী নারীর ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ক্ষমতায়ন মানে কেবল চাকরি করা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করা নয়। ক্ষমতায়ন মানে অবাধ চলাচল, সামাজিক সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা, আইনি সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার, মজুরির সমানাধিকার, নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার, সম্পত্তির ওপর অধিকার। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার গল্পে আদিবাসী নারীর গল্প অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়োজন উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, সকল আদিবাসী নারীর অবস্থান সমান জায়গায় নয়। কেউ সুবিধাপ্রাপ্ত, কেউ প্রান্তিক, কেউ অধিকতর প্রান্তিক। আদিবাসীদের মধ্যে বৃহত্তর জাতি হিসাবে একজন চাকমা নারীর যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে, পাহাড়ের সবচেয়ে প্রান্তিক জাতি চাক নারীর সেই সুযোগ সুবিধা নেই। চাক নারী শিক্ষায়, সম্পদে, সুযোগে আরও পিছিয়ে রয়েছে। তাই মূলধারার নারীদের ক্ষমতায়নের সঙ্গে আদিবাসী নারীকে যুক্ত করতে হলে এসব ভিন্ন ভিন্ন বর্গের ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতাকে আমলে নিয়েই কাজ করতে হবে।

সমাজের উঁচুতলার সুযোগ সুবিধের মধ্যে বেড়ে ওঠা উচ্চশিক্ষিত নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার যতটা সহজ হয়, এর নিচে থাকা নারীদের জন্য ততটা নয়। তাহলে কীভাবে, কাদেরকে, কোন ধরনের ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তার জন্য দরকার বিশেষ নীতি, আইন ও তার বাস্তবায়ন। নাহলে কেবল পিরামিড লিডারশিপ তৈরি হয়, যা প্রকৃতপক্ষে পুরুষতান্ত্রিক একটি প্রক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়। নারীবাদ এখন ইন্টারসেকশনালিটির কথা বলে, সমাজে যে বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষ আছে তাদের ভিন্ন ভিন্ন চিত্রকে তুলে ধরার কথা বলে। এখন নারীবাদ বলে বৈচিত্র্য কেবল নারী আর পুরুষে নয়, বৈচিত্র আছে জাতি, ধর্ম, জেন্ডারসহ আরও নানান সূত্রে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের জনপ্রিয় নারীবাদে কি এসব আছে? নাকি তা আসলে শেষ পর্যন্ত কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিত মূলধারার বাঙালি নারীর ক্ষমতায়ন? আজকাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মীদের মধ্যে বৈচিত্র্য আনার এক প্রকার চাপ থাকে। এর সঙ্গে অবশ্যই আন্তর্জাতিক দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি ও শর্ত থাকে। কিন্তু তা করতে গিয়ে শুধু এক-দুইজন আদিবাসীকে প্রতিষ্ঠানে সাজিয়ে রাখার মতো করে রাখা হচ্ছে না তো? অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ (meaningful participation) বলে একটি শব্দবন্ধ আছে যা নিশ্চিত করতে গেলে কর্মক্ষেত্রে আদিবাসী নারীর প্রবেশাধিকার নিয়ে কাজ করতে হবে আলাদাভাবে। শুধু যে রাষ্ট্রই এই কাজ করবে তা নয়, এর জন্য দরকার সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানসহ আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক নানান সংলাপের— যার মধ্য দিয়ে সমাজে আদিবাসী সম্পর্কে জ্ঞাননির্মাণ, গঠনমূলক আলোচনা ও পারস্পরিক শিক্ষার লেনদেন হতে পারে। তবেই বাংলাদেশে নারী দিবসের নারীর ক্ষমতায়নের গল্প পূর্ণতা পাবে।