নারীর জন্য গালভরা কথার দিবস

মতামতের, জীবনযাপনের, কাজের, শিল্পচর্চার, ভালোবাসার, যৌনতার স্বাধীনতা নারীর ক্ষেত্রে সবটাই পিতৃতন্ত্রের অনুমোদনসাপেক্ষ। বিয়ের পর একটি মেয়ের জীবনযাপন ‘কেয়ার অব’ হয়ে যায় পুরুষের বাড়ির ঠিকানায়।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 7 March 2024, 06:15 PM
Updated : 7 March 2024, 06:15 PM

সাদা চোখে দেখলে অস্বীকার করার উপায় নেই যে স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের নারীর বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। হাজারও বাধা-নিষেধের দেয়াল ভেঙে, ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে, শাসন-বারণের পাহাড় ডিঙিয়ে, অপমান ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, নিপীড়ন-নির্যাতনকে তুচ্ছ করে নারীরা অদম্য শক্তিতে বেরিয়ে এসেছে। স্বাধীনতা-পূর্ব সেই প্রান্তিক-অক্ষম-অবলা-অশিক্ষিত-পরনির্ভরশীল-লাজুক ও অন্ধকারে ডুবে থাকা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তকমা ছুড়ে ফেলে অনেকাংশেই নারী নিজেকে মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। আপনশক্তিতে বলীয়ান নারী নিজে ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে নিজেকে নতুনভাবে নির্মাণ করেছে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে।

তারপরও প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি নারী স্বাধীন হয়েছে? কতজন নারী নিজের মতো করে চলতে পারে? নিজেদের প্রাপ্য অধিকার ভোগ করতে পারে? হ্যাঁ, এই তর্কটা অনেক দিন ধরেই চলছে। আসলে স্বাধীনতা মানে শুধু দেশের স্বাধীনতা নয়, ব্যক্তিস্বাধীনতা। দেশের স্বাধীনতা অবশ্যই অসীম গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্যও অপরিসীম। ব্যক্তিস্বাধীনতা মানে কী? ব্যক্তিস্বাধীনতা মানে ব্যক্তির নিজের মতো করে কথা বলার অধিকার। তার মানে, ইচ্ছে হলেই কাউকে গালি দিলাম, সেটা ব্যক্তিস্বাধীনতা নয়। নিজের মতো করে নিজের পথচলাই প্রকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতা।

দেশ যখন স্বাধীন হয়েছিল, তখন আমরা এক সংবিধান গ্রহণ করেছিলাম। সে সংবিধানের গোড়াতেই বলা হয়েছিল: স্বাধীন দেশের নাগরিকরাও স্বাধীন। চিন্তার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। থাকবে ন্যায়ের গ্যারান্টি সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়। ‘যে যে ধর্মেরই মানুষ হই না কেন, আমরা সবাই সমানভাবে বাংলা মায়ের সন্তান, আমাদের প্রত্যেকের সমান অধিকার, সমান সুযোগ ও সমান দায়িত্ব রয়েছে’— এই অঙ্গীকার রক্ষাই স্বাধীনতার মূল দর্শন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নারী, দলিত, আদিবাসী, প্রান্তিক মানুষ, সংখ্যালঘু ভিন্ন ধর্মের মানুষদের সমান অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সমাজ আজও তৈরি হয়নি। বহুত্ববাদী, সাম্যবাদী সমাজ গঠনের সাংবিধানিক অঙ্গীকার সত্ত্বেও আমাদের রাষ্ট্র তার ভূমিকা এবং দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না।

নারীর ‘স্বাধীনতার লড়াই’ চিরকালই দ্বিবিধ। ঘরের আর বাইরের। রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নারীর স্বাধীনতার একটি একক হতে পারে বড়জোর। ‘রাজনৈতিক’ কথাটিও নারীবাদের আওতায় এলে অর্থের সম্প্রসারণ ঘটে, কারণ সেখানে ‘ব্যক্তিগতও রাজনৈতিক’। অতএব খাতা-কলমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা যে নারীর স্বাধীনতার সমার্থক নয়, তা বলাই বাহুল্য। ঠিক যেমন খাতা-কলমে নানা আইনি বা সাংবিধানিক অধিকার থাকলেই নারীর অধিকার নিশ্চিত হয় না।

তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, যখনই তথাকথিত মূলধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের ডাক এসেছে, তখন তা মেয়েদেরও ঘর থেকে বাইরে টেনে এনেছে। আগল ভেঙেছে, ত্বরান্বিত হয়েছে নারীর আত্মিক মুক্তি। বাইরে বেরিয়ে আসা নারী প্রশ্ন করেছে শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাতন্ত্রকে নয়, পরিবারের মধ্যে থাকা পিতৃতন্ত্রকেও। সেদিক থেকে দেখতে গেলে স্বাধীনতার আন্দোলন ও উত্তর-ঔপনিবেশিক নানা তথাকথিত মূলধারার আন্দোলন নারী-আন্দোলনকে উসকে দিয়েছে ও নারীর মধ্যে জাগিয়েছে স্বাধীনতার স্পৃহা।

মনে পড়ে যায় সিমোন দ্য বোভোয়ার ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইটির কথা। মেয়েরা এখনো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক! মেয়েদের স্বাধীনতাকে আলাদা করে ‘নারী স্বাধীনতা’ বা ‘স্ত্রী স্বাধীনতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ‘পুং স্বাধীনতা’ বলে আলাদা কোনো শব্দ শোনা যায় না। কেন? কারণ ‘স্বাধীনতা’ পুরুষের জন্মগত বিষয়। আর, নারীর ক্ষেত্রে সবাই চেষ্টা করেন স্বাধীনতা ‘দিতে’। জন্ম-অসহায় মেয়েদের হাতে ধরে কিছু না তুলে দিলে তারা পাবেন কী করে! তাদের জন্য, স্বাধীনতা নিজে অর্জনের বস্তু নয়! অনেক ভদ্রলোক এখনো বলেন, ‘আমি কিন্তু আমার স্ত্রীকে অনেক স্বাধীনতা দিই।’ অনেক নারীও গদগদ চিত্তে বলেন, ‘বাড়িতে আমাকে প্রচুর স্বাধীনতা দেয়!’

অথচ স্বাধীনতা নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ তা চামচে করে মুখে তুলে দিতে পারে না। ভার্জিনিয়া উল্ফ লিখেছিলেন, ‘চাইলে গ্রন্থাগারে তালা ঝোলাতে পারেন। কিন্তু স্বাধীনতার ওপর কোনো দরজা, তালা বা খিল আঁটতে পারবেন না।’

তবু মেয়েরা আজও স্বাধীন নন। মতামতের, জীবনযাপনের, কাজের, শিল্পচর্চার, ভালোবাসার, যৌনতার স্বাধীনতা নারীর ক্ষেত্রে সবটাই পিতৃতন্ত্রের অনুমোদনসাপেক্ষ। বিয়ের পর একটি মেয়ের জীবনযাপন ‘কেয়ার অব’ হয়ে যায় পুরুষের বাড়ির ঠিকানায়। জীবনযাপনে আসে নিয়ন্ত্রণ। অবিবাহিতারও পদে পদে নিয়ন্ত্রণ। বাইরে বের হলেও সূর্যাস্তের আগেই ফেরার বাধ্যবাধকতা থাকে। তিল তিল করে তার চারপাশে পরাধীনতার পাঁচিল গড়ে দেওয়া হয়।

সমাজ নারীর পোশাক গণ্ডিতে বেঁধে দেবে। তিনি রাত পর্যন্ত একা রাস্তায় ঘুরেফিরে কিংবা পার্কে হেঁটে-চলে একাকিত্ব উপভোগ করতে পারবেন না। ভয় ও শাসন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। মানুন আর না-ই মানুন, সমাজনির্দিষ্ট ‘ভালো মেয়ে’র আদিকল্প তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করবে। চৈতন্যকে কুরে কুরে খাবে।

যে শ্বশুরবাড়িকে ‘নিজের বাড়ি’ ভাবতে শেখানো হয়, সেখানকার সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার নেই কেন? আইনি অধিকার যেখানে নেই, তা ‘নিজের বাড়ি’ হয় কীভাবে? সম্পদে অধিকার এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই সার্বিক স্বাধীনতার প্রথম ধাপ। তার জন্য, দুর্ভাগ্যবশত নারীকে লড়তে হয় শুধু রাষ্ট্রের সঙ্গে নয়, পরিবারের সঙ্গেও।

গৃহশ্রমের পারিশ্রমিকহীন দায়িত্বের দাস হয়ে, শখ-পেশা-স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়া মেয়েরা স্রেফ ঘরের লড়াইকে, আপনজনের সঙ্গে লড়াইকে ‘অহেতুক’ ভেবে পরাধীনতা মেনে নেয় আজও। শরীর, শ্রম, অর্থ সবকিছুর স্বত্ব ছেড়ে দেয়, কারণ ‘ওরা তো পরিবার, ওরা তো আপনজন।’ তাই পরিবার টিকে থাকে, কিন্তু ‘নারী স্বাধীনতা’ কথাটি বাগাড়ম্বর হয়ে যায়। আজও উদারমনা শ্বশুরবাড়ির লোকেরা প্রাপ্তবয়স্ক বধূকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার, চাকরি করার বা পছন্দের পোশাক পরার ‘অনুমতি’ দেন। বেশিরভাগ অবশ্য তা-ও দেন না। অর্থনৈতিক চাপে লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজন কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। বাড়ির পুরুষটি গৃহকাজেও হাত লাগান কোনো কোনো পরিবারে। কিন্তু সেটিকে তার মহত্ত্ব হিসেবে দেখা হয়, কর্তব্য হিসেবে নয়।

এখনো বেশিরভাগ পরিবার চায়, মেয়ে বা বাড়ির বউ, নয়টা-পাঁচটার নির্ঝঞ্ঝাট চাকরি করুক, বাড়ি ফিরেও যেন সে কাজের রেশ তাকে বইতে না হয়। গৃহকর্মে ব্যাঘাত না ঘটে এবং সে ভদ্রসভ্য কাজ করুক, যেখানে পুরুষের গা-ঘেঁষাঘেঁষি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ, আবার একটি মেয়ের খুশিমতো পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা হরণের বিষয়টি এসে পড়ে। যে মেয়ে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি তারও সত্যি বলার স্বাধীনতা নেই। হাত খুলে কিছু লিখলেই সবাই ভাবেন, তার ব্যক্তিগত জীবন বুঝি খুব ময়লা! পুরুষ রঙিন, নেশাময় জীবনযাপন লিখবেন, মুকুট ভরবে পালকে। নারীলেখককে কলমে পুরে নিতে হবে সেন্সরশিপের কালি। জীবনসঙ্গিনী কখনো কি স্বামীকে মুখ ফুটে বলতে পারেন, যৌনজীবনে তিনি অসুখী? বললেই বিপত্তি। সিনেমায় দেখেছিলাম, স্ত্রী সাহসে ভর করে স্বামীটিকে বিছানার অতৃপ্তির কথা জানালে সেই পুরুষ পালটা জানতে চান, ‘আগে কতজনের সঙ্গে শুয়ে-বসে সুখ যাচাই করেছ?’ স্ত্রী বলতে পারেন না বলেই শয্যাতেও তাকে ঘিরে পরাধীনতার হিমশীতল গণ্ডি।

স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও এ দেশে নারীর সমানাধিকার নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুমাত্র উন্নত হয়নি। ঘরে ও বাইরে স্বাধীনতার লড়াই তাই দীর্ঘ পাঁচ দশকেও থামেনি, কমেনি, বরং আরও ঘনিয়ে উঠেছে। দেশ মানে তো নিজস্ব আকাশ, নিজস্ব ঘর এক টুকরো। এতটুকুর জন্যই ঘর ও বাহিরময় যুগ যুগের এত লড়াই। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার এ লড়াই নিরন্তর। পাথর যে জগদ্দল। তদুপরি আবার সে যেকোনো মুহূর্তে গড়িয়ে আসতে পারে পেছনে। ইঞ্চি ইঞ্চি সে পাথর সরানোর কাজ যে বড় বেশি কঠিন!

সভ্যতা যতই এগোক, প্রযুক্তি যতই উন্নততর হোক, সমাজে মেয়েদের সার্বিক স্থান রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই! ভাইরাস যেমন নানা রূপে, নানা আকারে নিজেকে মিউটেট করে, তেমনভাবেই নানা আকারে নিজেকে প্রকাশ করছে পুরুষতান্ত্রিকতা। সভ্যতা কখনো কোনো পরিস্থিতিতেই মেয়েদের ওপর নির্যাতন কমাবে না। কমাচ্ছে না। আধুনিকতার মধ্যেই যেন হিংসা লুকিয়ে আছে। সমাজ যত আধুনিক হচ্ছে, হিংসাও তত বাড়ছে। বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত দলগত বা ‘গণধর্ষণের’ কথাই ধরা যাক। হিংসা প্রকাশের ভঙ্গি সংগঠিত হয় সভ্যতার সঙ্গে। সমাজ যত এগোচ্ছে, তত হিংস্র হচ্ছে সমাজ।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে উচ্চারিত সব ভাষণ, প্রতিশ্রুতি যাবতীয় ইতিবাচক আয়োজন শেষ পর্যন্ত গাল ভরা কথা হিসেবেই থেকে যায়! এটাও সমাজের এক নির্মম প্রহসন!