Published : 20 Oct 2015, 09:27 PM
কাঁটাতারে ফেলানী, কাশ্মীরে আধিপত্য, গোমাংসে জীবনহানি, অতঃপর গোবর খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত। অদ্ভূত এক বৈচিত্র্যের দেশ। একদিকে গান্ধী-নেহেরু-সুভাষ-আজাদ, আরেক দিকে বিজেপি-জামায়াত জাতপাতের নামে মারামরি। একদিকে উন্নয়ন, আরেক দিকে আগ্রাসন। নিজের বেলায় মিতব্যয়ী, অন্যকে ধরিয়ে দেয় দামি পণ্য। নিজে ব্যবহার করে সাধারণ সামগ্রী, পাচার করে ফেনসিডিল। বুদ্ধ-অশোক-গান্ধীর দেশের নানা ঘটনায় পাশের দেশগুলো প্রায়ই আঁতকে ওঠে। ভূমিকম্পের পর আবারও ভারতীয় কম্পনে খবর হয়েছে নেপাল।
যেবার নেপাল গেলাম, সে দেশের সাধারণ দোকানে ভারতীয় রুপির ব্যবহার দেখে অবাক হয়েছিলাম। ইউএস ডলার, নেপালি রুপি আর ভারতীয় রুপি সমানে চলছে। তবে ভারতীয় রুপির বেলায় তারা সতর্ক। আমার কাছে ভারতীয় রুপি ছিল না। আমার সম্বল 'অজি' ডলার। আমাকে প্রথমে ভারতীয় ভেবে মুখ না খুললেও পরে বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ান জেনে তাদের মনের কথা বলা শুরু করেছিল। ভারতীয় ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট গ্রহণে অনিচ্ছুক নেপালিদের অভিযোগ, এর অধিকাংশই নকল।
ভ্রমণে গেলে বাজারে যাবার মানুষ নই আমি। মানুষের সঙ্গে গল্প করি। তাদের সঙ্গে মিশে যাই। এ মেশার আনন্দ আমার জীবনে দিয়েছে নতুন সব অভিজ্ঞতা। নেপালিরাও আমাকে ঠকায়নি। মুখ খোলার পর জানলাম, তাদের ধারণা মতে, ভারতীয় মানেই ঠকবাজ। তারা নাকি ইচ্ছে করে সে দেশে জাল নোট পাঠায়। আমি তাদের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন এমন বলছে? সব দেশেই তো জাল নোট আছে। সব দেশেই কিছু মানুষ এগুলো করে বেড়ায়। কিন্তু তাদের যুক্তিও অকাট্য। তারা বলেছিল, বেছে বেছে ১০০ আর ৫০০ টাকার নোট কেন তবে? এর উত্তর তো আমার জানা নেই, ছিলও না। পরে দেখলাম, উপরে 'ভারত-ভারত' করলেও ভেতরে তারা ঘোর বিদ্বেষী। তাদের ইতিহাসের সঙ্গেই এই বিরোধিতা জড়িয়ে।
যারা নেপালের ইতিহাস জানেন তাদের অজানা নয় যে, নেপালিরা হার-না-মানা জাতি। পাহাড়ি দুর্গম এলাকা আর যোদ্ধার জাতি বলে তাদের ইংরেজরাও হারাতে পারেনি। তাদের স্বাধীনতার ইতিহাস যেমন বীরত্বের, তেমনি রক্তে প্রবহমান। কিন্তু পাশের একমাত্র দেশ ভারত তো বিগ বস। একমাত্র এ কারণে যে, তাদের মতো আর কারও সঙ্গে সীমান্ত নেই নেপালের। তাও আবার স্থল-সীমান্ত।
স্বাধীন নেপাল আরও একটি কারণে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। তাদের দেশে জন্মালেও নদ-নদীগুলো বয়ে গেছে ভারতে, তারপর অন্যদেশে। ফলে বাণিজ্যের জন্য না আছে নৌ-বন্দর, না স্থল-সীমান্ত।
নেহেরুর ভারত আর রাজীবের ভারতে ছিল তফাৎ। সে আমলে, মানে রাজীবের আমলে নেপালকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছিল ভারত। স্থল সীমান্তগুলো বন্ধ করে দিলেই নেপালের বারোটা বাজে। গরিব দেশ, না আছে শক্তি, না সামর্থ্য। একমাত্র হিন্দু দেশ থাকার পরও সে আমলে ভারতের সুনজর পায়নি দেশটি। মানেটা এই বাণিজ্য-স্বার্থ; আর দরকার পড়লে ইরান-ইরাক ফাইট যেমন জায়েজ, তেমনি নেপালের ওপর চড়াও হতে পারে। নেপালের চোঙ্গা পাজামা আর পাঞ্জাবির নেতারা মাথায় স্বদেশি টুপি আর কপালে টিপ লাগিয়েও বশ করতে পারেনি। যতক্ষণ না ভারত তার পাওনা বুঝে নিতে পেরেছে।
এই অবরোধ বা আগ্রাসনের জবাব দিতে কিংবা সমঝোতার জন্যে একটা সংগঠনও আছে দেশগুলোর। সার্ক নামের এই সংগঠনের কাজ কারবার দেখলেই বুঝবেন কার কী ভূমিকা। এরশাদের আমল, জিয়ার আমল সবাই সার্কের ক্রেডিট নিতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে। আমাদের দেশ বা অন্য দেশে এর সম্মেলন হলেই সাজ সাজ রব পড়ে যায়। ভারত আর পাকিস্তান কিন্তু তা করে না। পাকিস্তান করে না তার স্বভাবসুলভ আগ্রাসী মনোভাবের জন্য। আর ভারত এমন ভাব দেখায় যেন বড় ভাইয়ের বাড়িতে অবহেলিত ছোট ভাইবোনেরা বেড়াতে এসেছে। ফলে সার্কেরও সাধ্য নেই নাক গলানোর। অথচ এখন ভারত আবার নেপালের সঙ্গে যে ব্যবহার বা আচরণ করছে তার একটা জবাব চাওয়ার জন্য সার্কের বৈঠক হতেই পারে।
ভারতের ভূমিকা উপমহাদেশে বরাবরই এমন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের বিশাল ত্যাগ আর ভূমিকার পরও তাদের মনোভাব দাদাগিরির। যে কারণে প্রায়ই আমরা ঠকি। আমাদের স্বার্থে টান পড়ে। প্রতিবেশি দেশগুলোর বেলায় ভারতের এই আচরণ তাদের প্রায় একঘরে করলেও তারা নাছোড়বান্দা।
শ্রীলঙ্কায় গেলে দেখবেন, সিংহলিজরা মনে করে, ভারত তাদের গৃহযুদ্ধের উস্কানিদাতা। এককালে বশংবদ তামিলরা এখন পারলে ভারতের মুণ্ডু চিবিয়ে খায়। টাইগার নেতা প্রভাকরণ নিহত হবার পর তারা আর ভারতমুখী নয়। বিশ্বাসও করে না। মালদ্বীপে আছে অবিশ্বাস। বাংলাদেশে বিরোধিতা। পাকিস্তানে উগ্র-বিদ্বেষ। বাকি থাকল ভুটান আর আফগানিস্তান। তাদের না আছে কিছু বলার সাহস। সব মিলিয়ে ভারতের জন্য উপমহাদেশের, এমনকি তার প্রতিবেশিদের কোথাও আসলে স্বস্তি বা শান্তি নেই।
এমন পরিস্থিতিতেও আবার নেপালে হাত বাড়িয়েছে তারা। যে চাপের জন্য এই অবস্থা, তার ফলাফল যাই হোক, এর মাশু একদিন দিতে হবে। ভারতের আকাশে যখন দেবী দুর্গার আগমন, যখন বিপদ-আপদ ও অসুর থেকে বাঁচাতে নেপালের কৈলাস ও হিমালয়-দুহিতা আসবেন, তখন সে নিজেই কিনা দানব হয়ে গেল? তাও দেবীর জন্মভূমি নেপালে? দেশটি মাত্র ভূমিকম্প থেকে উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তার সংবিধানে এসেছে পরিবর্তন। সব মিলিয়ে একটি আধুনিক ও সুন্দর দেশ হবার পথে তাকে সহায়তা করার পরিবর্তে এমন বিরোধিতা কাম্য হতে পারে না।
এই ভারতের নেতা নেহেরুই নির্জোট আন্দোলনের পুরোধা। গান্ধীর দেশের এমন আগ্রাসন কি প্রমাণ করে না যে, হিমালয়ে আবার দানবের মতো আচরণ করছে তারা? উপমহাদেশে তো বটেই, এশিয়ায় শান্তির জন্যেও এর বিহিত হওয়া প্রয়োজন।
অজয় দাশগুপ্ত: কলামিস্ট।