Published : 09 Jun 2014, 04:37 PM
মাতা-পিতাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ঐশী রহমানের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঐশীর মা-বাবাকে তাঁদের নিজ বাড়িতে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং পুলিশের অভিযোগ ঐশী নিজেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মূলত পুলিশের বরাতে গণমাধ্যমের মাধ্যমে এ ঘটনা এবং ঐশী সম্পর্কে নানা তথ্য আমরা জেনেছি। 'দোষ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত আসামী নির্দোষ'– এ নৈতিক বাণী উপেক্ষা করে ইতোমধ্যে মেয়েটিকে খুনী হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। তাতে এই মেয়েটির প্রতি সাধারণ মানুষের মনে ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা এখনও প্রকৃত ঘটনা জানি না। এ ঘটনায় ঐশীর সম্পৃক্ততা আছে কিনা, থাকলে তা কতটুকু সেটাও জানি না। কেন, কীভাবে এবং কার দ্বারা এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটেছে তা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আমাদের আদালত কর্তৃক চূড়ান্ত বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
কিছুদিন আগে লন্ডনে এক ব্যক্তিকে তাঁর নিজ বাড়িতে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং ঘটনাস্থল থেকে একমাত্র সন্দেহভাজন হিসেবে তাঁর কিশোর সন্তানকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ এবং প্রচার মাধ্যম এই সন্দেহভাজনের নাম, ছবি, ঠিকানা কিছুই প্রকাশ করেনি। বর্তমানে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই সন্দেহভাজনের প্রতি যাতে অন্যায্য কোনো কিছু করা না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিয়ে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা এ ঘটনার তদন্ত এবং এর কারণ বিশ্লেষণ করছেন।
বলাবাহুল্য, নিহত ব্যক্তির কিশোর পুত্রকে একজন অপরাধী হিসেবে দেখা হচ্ছে না, বরং একজন সাধারণ, নির্দোষ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে একাধিক পেশাজীবী কাজ করছেন।
অন্যদিকে ঐশীর প্রতি আমাদের সমাজের আচরণের তুলনা করা যাক। পুলিশের দাবি, ঐশী নিজেকে তার মা-বাবার হত্যাকারী হিসেবে দোষ স্বীকার করেছে! পুলিশের তত্ত্বাবধানে স্বীকারোক্তি নিয়ে নানা সমালোচনা আছে, তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।
এ ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে অধিক আলোচিত-সমালোচিত বিষয় হচ্ছে ঐশীর সামাজিক জীবনযাপন, বিশেষ করে মাদকদ্রব্য গ্রহণ। সাধারণত কোনো মেয়েকে অভিযুক্ত ও অপদস্ত করতে তার বহির্মুখী জীবনযাপন এবং মাদক সেবনের তথ্য প্রচার একটা সস্তা কৌশল, যা প্রায়ই মূল বিষয় এড়িয়ে যাবার কূটকৌশল বলা যায়।
তরুণদের জীবনে বর্তমান সমাজ-সংস্কৃতির প্রভাব থাকাটা স্বাভাবিক। ভালো-মন্দ যা-ই হোক, তরুণদের অনেকেই আজকাল ঐশীর মতো সামাজিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কিন্তু সে কারণে এমন অস্বাভাবিক সহিংস ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। তাই ঐশীর ক্ষেত্রে এমনটি হবার সম্ভাবনা কতটুকু?
সন্তান কর্তৃক মা-বাবা হত্যা একটি বিরল ঘটনা এবং কন্যা কর্তৃক তা আরও বিরল। যে সব কারণে কদাচিৎ এ ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে মা-বাবা কর্তৃক সন্তানকে দীর্ঘদিন নির্যাতন একটি অন্যতম কারণ। পুলিশের কাছে দেওয়া ঐশীর বক্তব্য থেকে জানা যায়, কৈশোরের শুরু থেকেই মা-বাবার সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কারণ মা-বাবা তাকে বুঝতে চাইতেন না, গালমন্দ ও মারধর করতেন, ঘরের বাইরে যেতে দিতেন না ইত্যাদি।
স্পষ্টতই সে শারীরিক-মানসিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষার শিকার হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু তার প্রতি নির্যাতনের ধরন কত ব্যাপক এবং গভীর ছিল তা আমরা এখনও জানি না। কারণ তার প্রতি নির্যাতনের বিষয়টি খুব বেশি আমলে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
অনেক মা-বাবা এখনও মনে করেন যে, শাসনের নামে ছেলেমেয়েদের শারীরিক আঘাত করা তাঁদের অধিকার। মানসিক নির্যাতন এবং অবজ্ঞা-উপেক্ষা সম্পর্কে অনেকের যথেষ্ট ধারণা নেই। ফলে প্রায়ই শিশু-কিশোররা এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়।
যৌন নির্যাতন সম্পর্কে অনেক মা-বাবার ধারণা থাকলেও অধিকাংশই জানেন না কখন এবং কীভাবে শিশু-কিশোররা যৌন নির্যাতের শিকার হয়। আমাদের দেশে শিশু-কিশোর নির্যাতন, এর প্রতিকার বা করণীয় বিষয়ে স্কুল এবং পরিবার থেকে শিক্ষা দেওয়া হয় না। বরং প্রায়ই শিক্ষা দেওয়া হয় নির্যাতনের কথা, বিশেষ করে যৌন নির্যাতনের বিষয় গোপন করতে। ফলে শিশু-কিশোররা সহজেই বড়দের অন্যায় আচরণের (Child abuse) শিকার হয়।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, দীর্ঘদিন শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা এবং বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার চাপ একসময় নেতিবাচকভাবে বিস্ফোরিত বা প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, মনের তীব্র চাপা ক্ষোভ এবং ক্রোধের কারণে মানুষ, বিশেষ করে কিশোর-তরুণরা অসামাজিক এবং অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন, মাদকদ্রব্যের উপর নির্ভরশীলতা, বহির্মুখী জীবনযাপন, উদ্ধত আচরণ, সহিংসতা, প্রতিশোধপরায়নতা ইত্যাদি।
সাধারণত শুধুমাত্র মাদকদ্রব্য সেবনের কারণে কেউ কাউকে হত্যা করে না। তবে মাত্রাতিরিক্ত মাদকদ্রব্য সেবন কখনও কখনও ভয়ংকর ঘটনায় সহায়ক (Contributing factor) হিসেবে কাজ করতে পারে। অর্থাৎ, বিশেষ বিপদজনক মাদকদ্রব্য দীর্ঘদিন সেবন করলে চরম শারীরিক-মানসিক বিপর্যয় ঘটে, যা কখনও হত্যার মতো ভয়ংকর কাজে প্ররোচিত করতে পারে।
প্রথম থেকেই ঐশীকে দেখতে চরম মাদকাসক্ত বলে মনে হয়নি, বরং তাকে সুস্থ ও পরিপাটি দেখা গেছে। তাছাড়া চরম মাদকাসক্ত কারও পক্ষে নিয়মিত মাদকদ্রব্য গ্রহণ ব্যতীত স্বাভাবিক থাকা সম্ভব নয়। আত্মসমর্পণের পর ঐশীর মাদকদ্রব্যের চাহিদার কথা শোনা যায়নি, বরং কারাগারে তার স্বাভাবিক আচরণের কথাই আমরা জেনেছি। সে কী মাত্রায় মাদক সেবন করত সে পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্য আমার নজরে আসেনি।
তাই এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ হিসেবে ঐশীর মাদকাসক্তিকে দায়ী করার কোনো কারণ দেখি না। বিষয়টি অতটা সরল সাদামাটা বলেও মনে হয় না।
'ঘেটুপুত্র কমলা' চলচ্চিত্রে আমরা দেখি, কমলা নামক এক কিশোর, প্রতাপশালী এক ব্রক্তির যৌন নির্যাতনের শিকার। পাশাপাশি প্রতাপশালীর স্ত্রী নিজের দুর্বল অবস্থা ও অবস্থানের কারণে স্বামীর এ অন্যায় আচরণ প্রতিহত করতে অক্ষম। ফলে গৃহিণীর চরম ঘৃণা-রাগ-ক্ষোভের শিকার হয় কিশোর কমলা।
অন্যদিকে আর্থিক-সামাজিক এবং বয়সের কারণে কমলা অধিক ক্ষমতাহীন একজন, তার প্রতি গৃহস্বামী এবং গৃহিণীর অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে সে পুরোপুরি অক্ষম। তাই শেষ পর্যন্ত কমলা করুণ পরিণতির শিকার।
এমন কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে ঐশীর রাগ-ক্ষোভের শিকার তার বাবা-মা দুজনেই? যতটুকু জানা যায় তাতে নির্যাতনের ব্যাপারে সে মা-বাবা দুজনের কথাই উল্লেখ করেছে, তবে মায়ের প্রতি ওর ক্ষোভ যেন একটু বেশি ছিল। ঐশী কি তাহলে দীর্ঘদিনের নিষ্ঠুরতা থেকে নিজের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিল বা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল? নাকি সে 'কমলার' মতো নিরাপত্তাহীনতায় ছিল?
ঐশী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি। ধারণা করে কোনো কিছু বলা ঠিক নয়। কিন্তু এর যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার মনে করি। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা কেবল যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে এ ঘটনার মূল কারণ উদঘাটন করতে পারেন। সাধারণত এ ধরনের যন্ত্রণাদায়ক, অস্বস্তিকর, জঘন্য অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ধারণা পেতে ঘটনার শিকার ব্যক্তির দীর্ঘমেয়াদী মনোচিকিৎসা, মনোবিশ্লেষণ এবং তদন্তের প্রয়োজন হয়। ঐশীর ক্ষেত্রে এ ধরনের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ কতটুকু করা হয়েছে আমরা জানি না।
গবেষণায় দেখা যায়, শিশু-কিশোরদের ওপর যৌন নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনা ঘটে আত্মীয়-পরিচিতজন দ্বারা; যেমন, চাচা, মামা, গৃহশিক্ষক, বাবা, ভাই, তাদের বন্ধু এবং পরিচিতজন। সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমাদের দেশে যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই গোপন করা হয়। বিশেষ করে নিকটাত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনা কদাচিৎ প্রকাশ পায়। কারণ আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ যৌন নির্যাতনকে কার্পেটের নিচে রাখতেই স্বস্তিবোধ করেন!
সচরাচর হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটে না, কিন্তু একেবারে ঘটে না তা বলা যাবে না। যেমন, গাজীপুরে কন্যাকে ধর্ষণের দায়ে বাবাকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৯ এপ্রিল, ২০১৪)। সংবাদে প্রকাশ, এই ধর্ষণের অভিযোগ মেয়েটি বা তার নিজের মা করেনি, অভিযোগটি করেছিল মেয়েটির সৎ মা।
পরিশেষে, উপরে উল্লিখিত বিষয়ের বাইরে অন্য কোনো কারণে হয়তো এ হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে, যার শিকড় অনেক গভীরে। আসল ঘটনা যাই হোক, সম্ভাব্য সব বিষয়ে যথাযথ তদন্ত এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সেটা নিশ্চিত হতে পারে। তাই প্রকৃত দোষী এবং এর মূল কারণ জানতে আমাদের চূড়ান্ত বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
ঐশীর বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ড আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির জন্য একটি সতর্কতামূলক বার্তা। সেজন্যই এর মূল কারণ উদঘাটন জরুরি। তবে এ ধরনের ঘটনায় সন্দেহভাজনের প্রতি আমাদের সমাজ-কাঠামো যথেষ্ট নির্দয়, নির্মম। যেমন, বিচারের আগেই কিছু কিছু প্রচারমাধ্যম ঐশীকে যেভাবে চিত্রিত করেছে, তা তার জন্য অনেক বেশি গ্লানিকর ও আত্মক্ষতি (Self harm) করতে প্ররোচিত করার জন্য যথেষ্ট।
চূড়ান্ত বিচারে রায় যা-ই হোক না কেন, পরিবার এবং রাষ্ট্র থেকে ঐশীকে যথাযথ আইনি সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি তার পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি মনে করি। আশা করি, রাষ্ট্র নিরপেক্ষভাবে এর নাগরিকের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে সে ব্যবস্থা করবে।
ড. সীনা আক্তার: লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট; প্যারেন্টিং পেশাজীবী।