আবুল বাশার শুধু শ্রমিক আন্দোলনের ঐক্যের দিশারি ছিলেন না, তিনি বামপন্থী আন্দোলনেরও ঐক্যের প্রভাবক ছিলেন। ১৯৮৫ সালের শেষদিকে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কংগ্রেসে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন।
Published : 07 Nov 2023, 11:42 PM
বাংলাদেশের শ্রেণিসচেতন অগ্রসর একজন বামপন্থী রাজনীতিক আবুল বাশার ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের এক স্বপ্নদ্রষ্টার জীবনের অবসান হয়নি; একজন সত্যিকারের শ্রমিকপ্রিয় নেতাকেও হারিয়েছে জাতি।
বাংলাদেশের বামপন্থীরা ৭ নভেম্বর সাধারণত রুশ বিপ্লব বার্ষিকী পালনে অভ্যস্থ, সেই দিনে একজন বাঙালি বিপ্লবীর প্রয়াণ স্মরণ করার বিষয়ে এখনও অভ্যস্থ হয়তো হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির ইতিহাসে আবুল বাশারের নাম উল্লেখযোগ্য।
আবুল বাশার বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরে জন্মগ্রহণ করলেও মেট্রিক পাশ করে চট্টগ্রামের কালুরঘাটস্থ ইস্পাহানি জুট মিলে টেকনিক্যাল শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৭ সালের দিকে তিনি শ্রমিকনেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৫৮ থেকে আইয়ুব খানের মার্শাল ল-এর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ট্রেড ইউনিয়নের কাজকে এগিয়ে নিয়ে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা হিসেবে জাতীয় পরিচিতি পান। ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রামে গ্রেফতার হলে কালুরঘাট থেকে চল্লিশ কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে শ্রমিকরা কোর্ট বিল্ডিং অবরোধ করে তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে যান।
১৯৬৭ সালের পর থেকে তিনিই প্রথম শ্রমিক জনসভায় শ্লোগান তোলেন, ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর’। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি চট্টগ্রাম থেকে প্রায় কয়েক হাজার শ্রমিক নিয়ে হেঁটে গিয়ে নোয়াখালী ও কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। কয়েকটি বামপন্থী দল মওলানা ভাসানীকে প্রধান করে সমন্বয় কমিটি গঠন করে জাতীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলে তিনিও তাতে যোগ দেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষ সংগঠক।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক সংগঠন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি তাঁর রাজনৈতিক সাধনায় পরিণত হয়।
একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের পাট, বস্ত্র, সুতাকলসহ প্রায় সব সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়নে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তিনি সকলের স্বীকৃতি অর্জন করেন। তিনিই প্রথম শ্রমিকদের জন্য দুই ঈদে বোনাস আদায় করেন যা পরবর্তীতে অন্য সকলের জন্য প্রযোজ্য হয়।
সরকারি কলকারখানা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, রুগ্ন শিল্পকে বাঁচানোর জন্য, ভিসামুক্ত শ্রমিকদের অভিগমনের জন্য আবুল বাশার আন্দোলন করেছেন। সংগ্রাম করেছেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর শ্রমিক ও জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং শ্রমিক আন্দোলনে আঞ্চলিকতার বিরুদ্ধে।
আবুল বাশার কেন স্মরণীয়?
বর্তমানে শ্রমিক আন্দোলনের যে বিভক্তি, আবুল বাশার তার বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন পারস্পরিক সংহতি ও ঐক্য ছাড়া শ্রমিক আন্দোলন সফল হয় না এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের সমর্থন ব্যতিত শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিকদের সার্বিক মুক্তি আসে না।
আবুল বাশার শুধু শ্রমিক আন্দোলনের ঐক্যের দিশারি ছিলেন না, তিনি বামপন্থী আন্দোলনেরও ঐক্যের প্রভাবক ছিলেন। ১৯৮৫ সালের শেষদিকে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কংগ্রেসে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। তারপরে সেই ঐক্যের ধারা স্ফীত হয়েছিল।
আবুল বাশারকে শ্রমিক আন্দোলন বা বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই অস্বীকার করা যাবে না। কারণ, তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়া।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র ও শ্রমিকের মুক্তির বিষয়কে অবিচ্ছেদ্য মনে করতেন। বর্তমানে গণতন্ত্রের সংগ্রাম হয় শ্রমিকের ন্যূনতম বাঁচার দাবিকে উপেক্ষা করে আর ইউ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মালিকপক্ষ চায় রাজনীতিবিহীন শ্রমিক ইউনিয়ন। আবুল বাশার কিন্তু তার বিপরীতে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামকে রাজনৈতিক সচেতনতার মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তিনি জানতেন, শ্রমিকের দাবি পূরণে গণতান্ত্রিক সরকার, আমলা পুলিশ লাগে, লাগে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো।
তিনি বামপন্থী ছিলেন কিন্তু যান্ত্রিক ছিলেন না, ছিলেন বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ঐক্যের পক্ষে। শিশুসুলভ বালখিল্যতা বা বিশৃঙ্খলা তাঁর মধ্যে ছিল না। তিনি জাতীয়ভাবে শ্রমিকদের নেতা যেমন ছিলেন তেমনি জাতীয় রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন।
আমরা এই যুগে সৎ নেতার খোঁজ করি কিন্তু হয়তো জানিই না আবুল বাশার তেমনই একজন নীতির প্রশ্নে আপোষহীন সৎ নেতা ছিলেন। তাঁর ছিল গতিশীল বিজ্ঞানমনষ্ক একটি বিপ্লবী চেতনা। আজকাল মানুষের মুক্তির বিষয়টি নিয়ে ভাবলে অন্য অনেককের মধ্যে আবুল বাশারকে স্মরণ হয়!