অভিনন্দনের প্রত্যাবর্তনে আপ্লুত ভারত, উত্তেজনা কমার আশা

বন্দি বৈমানিক অভিনন্দন বর্তমানকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে পাকিস্তান, যার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2019, 08:24 PM
Updated : 1 March 2019, 08:43 PM

শুক্রবার রাতে অভিনন্দন ফিরে আসার পরপর তাকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক টুইটে লিখেছেন, “ওয়েলকাম হোম উইং কমান্ডার অভিনন্দন! তোমার দৃষ্টান্তস্থাপনকারী সাহসিকতায় জাতি গর্বিত। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ১৩০ কোটি ভারতবাসীর অনুপ্রেরণা। বন্দে মাতরম!”

বিমান বাহিনীর এই পাইলটকে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও।

অভিনন্দন দেশে ফেরায় ভারতজুড়ে উৎসবের আমেজ চলছে বলে লিখেছে টাইমস অফ ইন্ডিয়া। বিমান বাহিনীর এই পাইলটকে ‘সত্যিকার হিরো’ হিসেবে বর্ণনা করে টুইট করেছেন ভারতের ক্রীড়া ও অভিনয় জগতের তারকারা।

বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি রজীনী বৈদ্যনাথ মনে করছেন, পাকিস্তানের এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দুই দেশ যুদ্ধের দুয়ার থেকে ফিরছে।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের মাটিতে ‘জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা’ বন্ধের বিষয়ে দেশটির কাছে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি চায় ভারত। শুক্রবারই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবিসিকে বলেছেন, এ বিষয়ে কাজ করবেন তিনি।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। ক্রেমলিনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে টেলিফোন করে দ্রুত সংকটের সুরাহা হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।

 

এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী শুক্রবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে টেলিফোন করে তাদের মধ্যস্ততার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন বলে পাকিস্তানের দৈনিক ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

রাশিয়ার এই প্রস্তাবের আগের দিন বৃহস্পতিবারই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকার মধ্যস্ততায় ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা কমছে।

এই ধরনের মধ্যস্ততার মধ্য দিয়েই এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন ইউএস ইনস্টিটিউট অফ পিসের বিশেষজ্ঞ মোঈদ ইউসুফ। অতীতেও নয়া দিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে সংকট তৈরি হলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চীন, ব্রিটেন ও রাশিয়া মিলে মধ্যস্ততায় সুফল মেলার কথা বলেছেন তিনি।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই উত্তেজনার শুরু গত ১৪ নভেম্বর ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় দেশটির সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) ৪০ জনের বেশি জওয়ান নিহত হওয়ার পর।

এর জের ধরে মঙ্গলবার ভোররাতে ভারতের বিমান বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে পাকিস্তানের বালাকোটে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করলে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়।এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর অন্তত ৫০টি স্থানে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের দিকে মর্টার শেল ছোড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা।

তারপর বুধবার সকালে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজৌরি জেলায় নওশেরা সেক্টরে বোমাবর্ষণ করলে আকাশে শুরু হয় লড়াই। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভূপাতিত হয় ভারতের একটি মিগ-২১ বিমান, প্যারাশুট দিয়ে নেমে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি হন পাইলট অভিনন্দন বর্তমান।

ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানে ঢুকে জঙ্গি আস্তানায় হামলা চালানোর নির্দেশ দেওয়ার প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভোটের পাল্লায় লাভবান হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।

বালাকোট অভিযানের পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম ও রাজনীতির অঙ্গনেও প্রবল জাতীয়তাবাদী প্রচারের প্রকাশ ঘটছিল। কিন্তু অভিনন্দন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ার পর পরিস্থিতি উল্টে যায়। 

এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বৃহস্পতিবার ঘোষণা দেন, শান্তির নিদর্শন হিসেবে ভারতীয় বৈমানিককে ফিরিয়ে দেবেন তারা।

অভিনন্দনের প্রত্যাবর্তন ঘিরে শুক্রবার চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয় পাঞ্জাবের ওয়াগা সীমান্তে। ‘জাতীয় বীরকে’ স্বাগত জানাতে সকাল থেকেই সীমান্তে জড়ো হন কয়েক হাজার ভারতীয়। তাদের অনেকের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা, গায়েও ছিল জাতীয় পতাকা, মুখে ছিল বন্দে মাতরম আর অভিনন্দনের প্রশংসা। তাদের স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত থাকে সীমান্ত এলাকা।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, অভিনন্দনকে ফিরিয়ে দিতে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শুক্রবার সকালে ইসলামাবাদ থেকে সড়কপথে তাকে লাহোরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে বিকালে তাকে নেওয়া হয় ওয়াগা সীমান্তে।

সেখানে অভিনন্দনের ডাক্তারি পরীক্ষা হয়। এরপর ওয়াগা-আতারি সীমান্তে দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে চলে কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা। জেনিভা কনভেনশন অনুযায়ী কাগজপত্র ঠিক করতে দুই দফা হস্তান্তরের সময় পরিবর্তন করে পাকিস্তান।

শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সময় রাত ৯টার পর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন অভিনন্দন। তাকে গ্রহণের পর আবারও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

ছেলেকে আনতে আগেই ওয়াগা সীমান্তে পৌঁছান অভিনন্দনের বাবা অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল এস বর্তমান এবং মা শোভা বর্তমান। ভারতীয় বিমান এবং সেনা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

অভিনন্দনকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইটারে একটি ছবি পোস্ট করেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড- বিসিসিআই। ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সিতে উইং কমান্ডার অভিনন্দন লিখে তার নিচে লেখা হয়েছে ‘১’ ।

ওয়েলকাম হোম অভিনন্দন হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে বিসিসিআই লিখেছে, “তুমি আকাশ শাসন করেছ এবং আমাদের হৃদয় জয় করেছ।তোমার সাহস ও আত্মমর্যাদাবোধ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে টিমইন্ডিয়ায় যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করবে।”

ভারতের ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুকার এক টুইটে লিখেছেন, “একজন হিরো শুধু চার অক্ষরের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। সাহস, নিষ্ঠা ও নিঃস্বার্থ আচরণের মধ্য দিয়ে আমাদের নায়ক নিজেদের ওপর আস্থা রাখতে শেখালেন। #ওয়েলকামহোমঅভিন্দন জয় হিন্দ!”

ভারতের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি টুইটে লিখেছেন, “রিয়েল হিরো, আমি তোমার কাছে মাথা নত করি। জয় হিন্দ।”

অভিনন্দনকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা লিখেছেন, “সত্যিকার অর্থে তুমি আমাদের প্রকৃত নায়ক। তোমাকে এবং তুমি যে সাহস ও মর্যাদাবোধ দেখিয়েছ তাকে স্যালুট করে দেশ।”

বলিউড তারকা শাহরুখ খান লিখেছেন, “তোমার সাহসিকতা আমাদের আরও শক্তিশালী করেছে। অন্তর থেকে তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।”

বুধবার অভিনন্দন ধরা পড়ার তার একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল পাকিস্তানের আইএসপিআর। ওই ভিডিওতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রশংসা করতে শোনা যায় ভারতীয় জঙ্গি বিমানের এই পাইলটকে।

শুক্রবার তাকে ফেরত দেওয়ার আগেও অভিনন্দনের ওই রকম কথার একটি ভিডিও সম্প্রচার হয় পাকিস্তানি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে।

বিবিসি বলছে, ওই ভিডিওতে অভিনন্দন বর্তমানের বক্তব্য কাটছাঁট করা হয়েছে বলেই তাদের মনে হয়েছে। সেখানে এই উইং কমান্ডারকে কীভাবে বিমানে গুলি লেগেছিল এবং কাশ্মীরে নামার পর উত্তেজিত জনতার হাত থেকে তাকে পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্ধারের ঘটনা বর্ণনা করতে শোনা যায়।

“পাকিস্তান আর্মি সত্যিকারে আমার খুব যত্ন নিয়েছে। তারা খুবই পেশাদার,” বলতে শোনা যায় তাকে।

ওই ভিডিওতে অভিনন্দনকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা করে বলতে শোনা যায়, তারা সব সময় ঘটনার অতিরঞ্জিত করে খবর প্রকাশ করে, যাতে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়।   

‘হিরো’ ইমরান, ‘ভিলেন’ মোদী

একটি মাত্র সিদ্ধান্ততেই নাটকীয় মোড় নিয়েছে দুই দেশের রাজনীতি। অভিনন্দনকে ফেরানোর সিদ্ধান্তে যেন রাতারাতি ‘হিরো’ হয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

 

স্যোশাল মিডিয়ায় অনেকেই তার প্রসংশা করছেন। ইমরানকে ‘প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন অনেকে।

অন্যদিকে নানা প্রশ্ন আর সমালোচনা ঝড়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অবস্থা হয়েছে ভিলেনের মতোই।

কয়েক দিনের যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব এবং তা নিয়ে অনেকের উচ্ছ্বাস ভারতে লোকসভা ভোটের আগে মোদীর দল বিজেপির জনসমর্থন বাড়ার লক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছিল।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিয়েছে তাতে নিজ দেশেই মোদীকে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার চেষ্টায় আসন্ন নির্বাচনে ভোট টানতে তিনি যুদ্ধের রাজনীতির পথে হেঁটেছেন বলে অভিযোগ করছে বিরোধী শিবির।