যে কোনো দুর্যোগে ত্রাণের চাল-ডালের সঙ্গে থাকুক স্যানিটারি প্যাডও; আঁখি সিদ্দিকা এ কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চান।
Published : 13 Mar 2023, 10:52 AM
মহামারীর সময় পথঘাট যেমন থমকে গিয়েছিল, তেমনি অনেকের বেলায় সীমিত হয়েছিল উপার্জন। এই পরিস্থিতিতে নারীর স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার খরচ যোগানো কোনো কোনো পরিবারের জন্য ভীষণ কষ্টকর হয়ে উঠেছিল।
দেশের দক্ষিণে খুলনা অঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় এমন পরিস্থিতিতে ত্রাণের ব্যাগে ভরে স্যানিটারি প্যাড বিলি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন আঁখি সিদ্দিকা।
২০২০ সালের সেই দিনগুলো মনে করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”আমাদের এলাকাটা লকডাউন করে দিল, আমাদের সমস্ত কিছু বন্ধ রাখা হলো; খুলনায় নিরালা, গল্লামারী, বাঘমারা এলাকাগুলো...।”
পেশায় ব্যাংকার আঁখি সিদ্দিকা তখন বদলী সূত্রে খুলনা শাখায় কর্মরত ছিলেন। তাই পরিবারসহ থাকতেন খুলনা মহানগরীর নিরালা আবাসিক এলাকায়।
ওই দিনগুলোকে তাকে অটো-রিকশায় আনা-নেওয়া করতেন চালক শহীদুল। বাকি সময় অন্য যাত্রী টানতেন এই চালক।
মহামারীতে জনজীবন স্থবির হলে শহীদুলের আয়-উপার্জনে টান পড়ে।বাধ্য হয়ে ঘরে খাবার সংকটের কথা মুখ ফুটে বলতে হয় শহীদুলকে।
আঁখি সিদ্দিকা বলেন, ”উনার ঘরে চালডাল নেই। আমি উনার ঘরে এক সপ্তাহের খাবার ব্যবস্থা করলাম কোনো ডোনেশন সংগ্রহ ছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে।”
অটো রিকশা চালক শহীদুল শহরে থাকলেও তার স্ত্রী থাকতেন রূপসা এলাকায়। খাবারের কষ্টের কারণে স্ত্রীকে শহরে আনতে পারছিলেন না তিনি।
একদিন সেই স্ত্রীর জন্য আঁখি সিদ্দিকার কাছে স্যানিটারি প্যাড চাইলেন অটো রিকশা চালক শহীদুল।
ঘটনাটি মনে করে আঁখি সিদ্দিকা বলেন, ” তার স্ত্রীর কাছে সাবানও ছিল না। কাপড় দিয়ে যে প্যাড করবেন, সে পরিমাণ কাপড়ও নেই। তখন আমি ঘরে থাকা একটি প্যাকেট দিয়ে দিলাম।”
এরপর একদিন নিজের পরিবারে স্যানিটারি প্যাড প্রয়োজন হলে আশেপাশের দোকানে খুঁজে পাননি তিনি।
”তখন আমার মাথায় কাজ করল আমরা যদি না পাই শহরের মাঝখানে থেকে, সিটি করপোরেশনের মাঝখানে থেকে তাহলে যারা রিমোটে আছে বা একটু দূরে আছে তারা কী ফেইস করছে?”
আঁখি সিদ্দিকা বলেন, ”চালের কথা বলা যায়, ক্ষুধার কথা বলা যায়, কিন্তু এই সমস্যার কথা তো মেয়েরা শেয়ার করতে পারে না।”
প্রচার-প্রসারের কারণে ’এখন গ্রামের মেয়েরাও স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করছে’। কিন্তু মহামারীর ওই পরিস্থিতিতে বেকায়দায় পড়ে মাসিকে পুরনো কাপড় ব্যবহারে ফিরে যাওয়ার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে নারীদের, এমন আশংকা হলো তার।
”আমার মাথায় এলো আমরা তাহলে আমাদের বাড়তি স্যানিটারি প্যাড বিতরণ করতে পারি। যেমন আমার তিনদিন মাসিক থাকলে ও তিনদিনে ছটা প্যাড লাগলে বাকি থাকে আরও চারটা। এই উদ্বৃত্তটাকে যদি আমি কাউকে দিতে পারি ...।”
অনেকে বেশি করে স্যানিটারি প্যাড কিনতে পারছিলেন না, কারণ তখন হিসাব করে খরচ করছিলেন সবাই। আবার স্যানিটারি প্যাড কেনার জন্য কোনো ডোনেশন জুটবে এমন আশাও দেখছিলেন না আঁখি সিদ্দিকা।
তিনি বলেন, ”আমি বাড়িতে বাড়িতে ফোন করলাম। কারণ বাড়িতে তো যাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির সামনে এসে অনেকে তাদের অব্যবহৃত বাড়তি প্যাড রেখে গেল। এভাবে আমরা চারটা-পাঁচটা প্যাড নিয়ে একেকটা প্যাকেট করলাম।”
খুলনা এলাকায় বাড়ি বাড়ি ত্রাণ বিতরণে সিটি করপোরেশন কয়েকটি দলে অনেককে সম্পৃক্ত করেছিল।
”আমরা সেই টিমের কাছে ত্রাণের সাথে প্যাডের প্যাকেটগুলোও দিলাম।”
আঁখি সিদ্দিকাদের এই উদ্যোগে প্রায় এক হাজার প্যাড বিলি করা হয়েছিল।
একজন নারীর জন্য পাঁচটি করে প্যাড বিলি করা হয়েছিল। কোনো পরিবারে তিন জন নারী থাকলে তাদের পনেরটি প্যাড দেওয়া হয়। এভাবে ৩০-৪০টি পরিবারে স্যানিটারি প্যাডের প্যাকেট পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন তারা।
এরপর পরিবেশবাদী যুব সংগঠন গ্রিন ভয়েস থেকে ত্রাণের জন্য আর্থিক সহায়তা পাঠানো হয়। তাদের সঙ্গে আলাপ করে সেই অর্থায়নে স্যানিটারি ন্যাপকিন যোগ করার প্রস্তাব রাখেন আঁখি সিদ্দিকা।
”চাল-ডাল,আলু-পেঁয়াজের সঙ্গে এক প্যাকেট করে স্যানিটারি ন্যাপকিনও যাবে।”
ত্রাণের সঙ্গে স্যানিটারি প্যাড দেওয়ার কথা এখনও ’সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করি সবসময়’ বলে জানালেন এই নারী সংগঠক।