ফেইসবুক-ইউটিউব নাকি গণমাধ্যম, নির্ভরতা কোথায় তরুণদের?

হাল আমলে অন্যরা যেমন, ঠিক তেমনটাই সময় পেলে মোবাইল ফোনে ফেইসবুক স্ক্রল করতে থাকেন ভারতের চেন্নাইয়ের এশিয়ান কলেজ অব জার্নালিজমের ডিপ্লোমার শিক্ষার্থী শফিক মিতুল।

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিও রাসেল সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2021, 03:58 AM
Updated : 17 May 2021, 03:58 AM

জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকটা সময় কাটলেও বিষয় যখন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, তখন সঠিক তথ্য জানতে মূলধারার গণমাধ্যমের উপরই নির্ভর করেন তিনি।

বাংলাদেশের এই যুবক দিনের অধিকাংশ খবরই পেয়ে যান ফেইসবুক-ইউটিউবে, সংবাদের লিঙ্কও ঘুরেফিরে আসে তার টাইমলাইনে। এরপরও সংবাদ মাধ্যমগুলোর সাইটে প্রায়ই ঢু মারেন মনের ‘খচখচ’ দূর করতে।

তথ্যের চাহিদা পূরণের বিষয়টি মিতুল ব্যাখ্যা করছিলেন এভাবে, “মাঝেমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদের ব্রেক হয় ঠিকই, তারপরও তথ্য নিশ্চিত হতে গণমাধ্যমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়।”

ঘটনা দ্রুত জানাজানির এমন ধরনের কারণে এখন অনেক তরুণের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটারের মতো জনপ্রিয় সোশাল মিডিয়াগুলো।

ব্যক্তিগত যোগাযোগ আর বন্ধুদের সঙ্গে সেরা মুহূর্ত শেয়ারের ‘ট্রেন্ডের’ কারণে প্রায় সব বয়সীদের অবসরের বড় অংশ যাচ্ছে ফেইসবুকে।

দেশ-বিদেশের বড় ঘটনার পাশাপাশি নিজের আশেপাশে যা ঘটছে, সেটিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে জানাও যায় আগেভাগে।

কোনো ঘটনার নানামুখী প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে বলে মনে করেন টাঙ্গাইলের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুল হক আবির।

“কেউ ফেইসবুকে লাইভ করলে সেটা মুহূর্তের মধ্যে সবার কাছে পৌঁছে যায়। সেখানে পাঠক বা দর্শক নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।”

‘ফেইসবুকেই সব খবর পাওয়া যায়’ মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্থী নবনীতা বলেন, “ফেইসবুকে কোনো নিউজ লিঙ্ক পেলে হেডলাইনে চোখ বুলিয়ে নেই। গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে ক্লিক করে মূল সাইটে গিয়ে নিউজটা পড়ি। তবে পূর্ণাঙ্গ নিউজ খুব কমই পড়া হয়।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন মাহীর ধারণা, তরুণদের মতো গণমাধ্যমও কিছুটা হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে সংবাদ প্রদানের ধারাও বদলে যাচ্ছে।

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিউজ শেয়ার না করলে তেমন ভিউয়ার পাওয়া যায় না। বিজ্ঞাপনের আধিক্যের কারণে মানুষ টেলিভিশন খুলে সংবাদ দেখে না। তাই ইউটিউব বা ফেইসবুকে সেই সংবাদ পোস্ট না করলে সেগুলো তেমন দর্শক পায় না।”

সবধরনের তথ্য সহজে পেয়ে যাওয়ার কারণে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইমরান হোসাইনেরও আগ্রহ বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

তবে ‘অনেক সময় এখানে ভুল তথ্য দিয়ে, গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেক্ষেত্রে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে গণমাধ্যমের তথ্যগুলোই বেছে নেই।”

ভুল তথ্যের ছড়াছড়ির কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আস্থা নেই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মারিয়া জাহান মৌসুমীর।

“গণমাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়, সে কারণে সেখানেই আগ্রহ বেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক সময় ফেইক নিউজ আসে।”

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমানের মতে, স্মার্টফোনে এখন মুহূর্তেই সব খবর ভেসে আসে এবং ফেইসবুকে ঢু মারলেই অনেক খবর পাওয়া যায়।

তবে এসব সংবাদের নির্ভরযোগ্যতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আসলে কোনো একটা ঘটনা জানতে আমাদের দেশে একটি নিউজ সাইটের উপর নির্ভর করা যায় না। কোনো একটি বিষয়ে ডিপলি জানতে গুগলে সার্চ করে অসংখ্য তথ্য থেকে সঠিকটি যাচাই-বাছাই করে নিতে হয়।”

ফেইসবুক বা ইউটিউবে অনেকক্ষণ ধরে সময় কাটানো এসব তরুণদের মতে, দ্রুত সংবাদ প্রকাশে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো এখন অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছে।

তবে নানা গুজব আর বিভ্রান্তির ফাঁদ থাকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাস করতে চান না তাদের অনেকেই। সেখানেই এসব পাঠক ফিরে যান মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে।

সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম মনে করেন, নানা চাপে মূলধারার গণমাধ্যমে সব খবর না আসায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণরা আকৃষ্ট হচ্ছে।

“গণমাধ্যম মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। শাসকগোষ্ঠী বা মালিক পক্ষের বিভিন্ন নীতিমালা মানতে গিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো অনেক সময় সংবাদ প্রকাশ করতে পারে না। যে কারণে অবাধ তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভর করছে।”

এ কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গণমাধ্যমের স্থান দখল করে নিচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তুহিন ইমরান।

তিনি বলেন, “এক সময় মানুষ কতটা জানবে, কী প্রতিক্রিয়া জানাবে; গণমাধ্যম তা ঠিক করে দিত। এখন মানুষ নানা মাধ্যম থেকে তথ্য পায়। নানা কারণে গণমাধ্যমের তুলনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্ভরতা বাড়ছে। এক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমে কোনো ধরনের ফিল্টারিং না থাকাটা অন্যতম কারণ।”

তবে গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতার কারণে প্রচলিত গণমাধ্যমেই ভরসা রাখেন তেজগাঁও কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী কৌশিকুর রহমান রবিন।

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশিরভাগ তথ্যই ফেইক থাকে। সে কারণে ভরসা করা যায় না। যে যার মতো করে মনগড়া কথা লিখে। পত্রিকায় যে ঘটনাটা আসে, তা সত্য এবং অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পরই আসে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সিদ্দিক ফারুকের মতে, তথ্যের ‘ক্রসচেকে’র সুযোগ না থাকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে ‘গুজব মাধ্যমে’ পরিণত হয়।

তবে হাল আমলে গণমাধ্যমেও ‘গণমানুষের কণ্ঠস্বর নেই’ মন্তব্য করেন তিনি।

এমন প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই মাধ্যমের সামনেই চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা উৎরাতে পারলে পাঠকরাই উপকৃত হবেন।

ছবি: রয়টার্স।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মতে, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলাদা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে।

“গণমাধ্যমে সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুসরণ করে তথ্যগুলো পরিবেশন করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো সেটা নাই। এখানে দুয়েকজন ব্যক্তি একটা গ্রুপ পরিচালনা করে কিছু তথ্য দেয়। এবং সেখানে তাদের নিজেদের স্বার্থেও অনেক সময় তথ্য দেয়; যেটা সঠিক তথ্য নাও হতে পারে।”

তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান হয়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

দুই মাধ্যমেই গুজবের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন সাংবাদিকতার এই শিক্ষক।

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ইচ্ছাকৃতভাবেও ছড়ানো হয়। কারণ অনেকের উদ্দেশ্যই থাকে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। গণমাধ্যমেও গুজব দেখি। কারণ সঠিক তথ্যটা যখন তারা পায় না, তখন বিভিন্ন সোর্স থেকে এনে তথ্যটা দেয়; যেটা অনেক সময় সত্য হয় না। তবে সেটা তুলনামূলকভাবে কম।”

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে মিথ্যা, গুজব, বিদ্বেষ, ধর্মীয় উসকানি থেকে মুক্ত রাখতে সেখানে ‍কিছুটা নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন রয়েছে।

“স্বাধীনতার সাথে সাথে দায়িত্বের প্রশ্নটিও আসে। একেবারে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই, স্বাধীনতারও একটা নিয়ম থাকে।”

আর গণমাধ্যম সংবাদ পরিবেশনে বাধার সম্মুখীন হলে সেটিও তাদের প্রকাশ করা উচিৎ বরলে মত জানান তিনি।

“সেটি প্রকাশ করলেই পাঠক বুঝতে পারবে, কেন তারা সংবাদটি প্রকাশ করতে পারে নাই। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, যদি সম্পাদক, প্রকাশক এবং সাংবাদিকদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠতা থাকে। তাহলে কোনো বাধাই তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। যদি নিজেরাই বস্তুনিষ্ঠতায় কখনো আপস করে, তাহলে মুশকিল হয়ে যাবে।”