প্রকৃতি কিন্তু বড্ড রসিক! রসবোধ তার যে পরিমিত নয়, বরং একটু বেশির দিকে, তা তিনি দেখিয়ে দিলেন।
Published : 14 Feb 2025, 10:09 AM
![]() |
বেসরকারি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা স্বরূপ জাহিদের শৈশব কেটেছে পুরান ঢাকায়, কৈশোর গড়িয়েছে ধানমণ্ডি ও মোহাম্মাদপুর। আর পরিণত বয়স ঝরছে উত্তরায়। সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত হতে দেখেছেন বসন্ত থেকে ভ্যালেন্টাইন আর শবে বরাতের ধরন। সেই অভিজ্ঞতাই প্রকাশ্য হয়েছে তার এই লেখায়। |
বোধকরি এবারই প্রথমবারের মতো উদযাপন হচ্ছে একই দিনে একসাথে- বসন্ত উৎসব, ভ্যালেন্টাইন ডে এবং শবে বরাত।
যেন মনে করিয়ে দেওয়া- এদেশে আর যাই হোক, বিশেষ দিবস উদযাপনে কোনো বিভেদ রাখা যাবে না। ধর্ম আর দেশীয় সংস্কৃতি উদযাপনে কোনো শর্ত নেই, নেই কোনো সীমারেখা।
আমাদের সংস্কৃতিতে এই তিন দিবস বহুবছর ধরে পালিত হয়ে আসছে। তা সে যেভাবেই হোক। উদযাপনের ধরন পাল্টেছে, দিন পাল্টেছে, দিবসের মতবাদও হয়ত পাল্টেছে। তর্ক বিতর্কে দিবসগুলো পাল্টে দেওয়ার জোর চেষ্টাও আছে।
তারপরও দেশীয় সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত এই উদযাপনগুলো কি এত সহজে মুছে দেওয়া সম্ভব?
উগ্রবাদ কিংবা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের চিকন চেষ্টা- এসব বাদ দিয়ে, এখনও সুদূর গ্রামের সাধারণ কৃষক বসন্ত বরণ করেন তার পরিবার নিয়ে।
এখনও মফস্বলের বাড়িতে বাড়িতে শবে বরাতের হালুয়া রুটির আদান প্রদান হয়। মসজিদে সারা রাত হয় নামাজ দোয়া।
বাসন্তী শাড়িতে নারীরা মাথায় ফুল গুঁজে প্রেমিকের জন্যে অপেক্ষায় থাকেন।
অথচ এই শহরে আশি বা নব্বই দশকে শবে বরাত ছিল দারুণ এক উৎসব। চার দশক আগেও ঢাকা শহরের ঘরে ঘরে শবে বরাতে, মা-খালার হালুয়া বানাতেন। বুটের হালুয়াটার চল বেশি ছিল তখন।
এছাড়াও থাকতো সুজি, পেঁপে আর গাজরের হালুয়া। নেসেস্তার হালুয়াও ছিল। তবে সেটা ঢাকায় অনেক পরে জনপ্রিয় হয়।
এসব হালুয়া বানিয়ে এক ধরনের বিশেষ নকশার ছাঁচে ফেলে হালুয়াটা কাঁটা হত। তখন এর নতুন নাম হত বরফি।
আমি জানি না, আজও ঢাকা শহরের বাসাগুলোতে বরফির চল আছে কি-না?
আমার শৈশব আর কৈশোরের একটা বড়ো অংশ কেটেছে পুরান ঢাকায়। সত্যিকারের ধর্মীয় আচার বা উৎসব কী, তা মনে হয় ওই সময়টায় পুরোনো ঢাকাতেই পাওয়া যেতো।
শবে বরাত চলে আসতো সাজ সাজ রব নিয়ে। প্রায় প্রতিটা মুদি দোকানে শুরু হতো তারাবাতি বিক্রির ধুম।
ছোট শিশুদের চোখের তারা যেন ঝিলিক দিত তারাবাতি দেখে। বাবার কাছে বায়না যেমন হত, তেমনি বাবার চোখ রাঙানিও ছিল দেখার মতো।
আমরা যারা প্রায় কিশোর, তাদের আবার অন্য আগ্রহ। তারাবাতি ছিলো আমাদের কাছে শিশুসুলভ। আমরা খুঁজতাম মরিচা বাতি। আমাদের ভাষায় ‘মোড়রা’। এই জিনিসটা তারাবাতির মতো নিরীহ না।
মোড়রা জ্বালিয়ে আমরা দৌড় দিতাম। আর মোড়রা এপাশ ওপাশ করে জ্বলতে জ্বলতে আগুনের ফুলকি ছড়াতে ছড়াতে ছুটে যেত। অনেকটা বিধ্বংসী টাইপ। আর তাই মুদি মামারা এটা লুকিয়ে বেচতো আমাদের কাছে।
পাড়ার মুরুব্বীরা দেখলে তো কথাই নেই, ডাইরেক্ট মাইর। পটকা তো ছিলই।
পটকা ফুটানোর মজাটাই অন্যরকম। আগুন ধরিয়ে কানে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকতাম। আর শব্দ হলেই দৌড়। কোন পাড়ার পটকার বেশি আওয়াজ, তার প্রতিযোগিতা চলতো পাড়ায় পাড়ায়।
মধ্য আশির শবে বরাত যেন ঢাকায় আরেক ঈদ। ঈদের সকালে যেমন নামাজের আগে গোসল করতে দেখতাম বাবাকে, ঠিক তেমনি শবে বরাতের সন্ধ্যায় গোসল করে নামাজের প্রস্তুতি নিতেন তিনি। সঙ্গে আমিও।
এরপর মাগরিবের নামাজ পড়ে তৈরি হয়ে, হালুয়া রুটি খেয়ে মসজিদে এশার নামাজ। আর ঠিক এই সময়টায় চলতো বাসায় বাসায় হালুয়া রুটির আদান প্রদান।
রুপা বা কাচের বড় থালায় প্রতিটা বাসার মা-খালারা হালুয়া আর চালের রুটি সাজিয়ে দিতেন। পাড়ার ছোট মেয়েদের মধ্যে সে কি উৎসবের আমেজ, এই হালুয়া রুটি বিতরণের।
থালায় হালুয়া সাজিয়ে তার ওপর লাল ওড়না বা সেলাই সুতার কাজ কারা সাদা কাপড়ের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে পাড়ার মেয়েরা বেড়িয়ে পড়ত। আর ওদিকে মসজিদে মসজিদে ছেলেদের ভীড় বাড়তে থাকত নামাজের জন্য। সারারাত চলতো সেটা।
সব দোকানপাট, রাস্তা সরগরম থাকতো ভোর রাত পর্যন্ত। প্রায় সব বাড়ির সদর দরজাও খোলা থাকতো সারারাত।
রাতের খাবারের কথা তো না বললেই নয়। সে এক জমকালো ভোজ। তেহারি ছিল সবচাইতে ‘কমন আইটেম’।
এছাড়া ঝাল গরু ভুনা সাথে চালের রুটি বা টাপ্পু রুটি। টাপ্পু রুটি ছিল একটা দেখার মত জিনিস।
আসলে বান রুটি হলেও, পুরান ঢাকায় এটার নাম ছিল টাপ্পু রুটি। শবে বরাতে লাইন দিয়ে সকাল থেকে বসতো দারুণ সব নকশা করা টাপ্পু রুটির দোকান। কোনোটা গোল, কোনোটা চ্যাপ্টা। আবার কিছু ছিল বিভিন্ন প্রাণীর আদলে।
মাছ, কুমির, কচ্ছপ আকৃতির টাপ্পু রুটিতে আবার ছোট ছোট আয়নাও বসানো থাকতো। সেই টাপ্পু রুটি, গরু ভুনা দিয়ে জমতো বেশ।
আর সারারাত প্রার্থনা শেষে ফজর নামাজের পরে হত বিশেষ দোয়া। মোনাজাত শেষে কোথাও থাকত কাঠালপাতায় মোড়া তেহারি। সেই তেহালি ছিল যেন স্বর্গীয় অমৃত।
আজ ঢাকা শহরে ধর্ম আছে, উৎসব নেই। প্রাণের এই শহরে আমি আজ আর কোনো উৎসব দেখি না। অনেকেই বলতে পারেন, এগুলা ধর্মে নিষিদ্ধ। শবে বরাতে কেন হালুয়া, পটকা হবে। ধর্মের সঙ্গে তা মানানসই নয়।
হয়ত ঠিক। তবে এই শহরে একটা ধর্মীয় সংস্কৃতি যে হারিয়ে গেল, একটা প্রজন্মের শুধু স্মৃতিতেই তারাবাতি, মোড়রা, হালুয়া বা টাপ্পু রুটি থেকে যাচ্ছে, তাতে কি এই শহরের বদলটা ভালো হল?
আজ পাড়া সংস্কৃতি নেই, তাই পাশের ফ্ল্যাটে হালুয়া বিতরণের তাড়াটাও নেই। আমরা এই শহরে জানিও না আমার পড়শী কে!
শবে বরাতের উদযাপনের মতোই এ শহরে দারুণভাবে পালিত হত বসন্তের প্রথম দিবস।
হত বলছি কারণ, নব্বইয়ের দিকের বসন্ত বরণের থেকে এখনকার আয়োজনের অনেক পার্থক্য আছে।
তখন সারা শহর যেন হলদে আলোয় ঝলমল করত। খুব ভোরবেলায় হলুদ পাঞ্জাবি আর কলাপুরি স্যান্ডেল পরে ছেলেরা অপেক্ষা করতো দশটা টকটকে লাল গোলাপ নিয়ে। কখনও শাহবাগে মৌলি ক্যাফের সামনে, আবার কখনওবা নিউমার্কেটের লাইট কনফেকশনারির সামনে।
মেয়েদের দেরি হত আসতে। কোনো বছর আধ ঘণ্টা আবার কোনো বছর এক ঘন্টারও বেশি। শাড়ি পরতে হত যে।
বাসন্তী শাড়ি। সাথে মিলিয়ে চুড়ি আর ফুলের গয়না। সময় তো লাগবেই। ছেলেদের অপেক্ষায় কোনো আপত্তি নেই।
প্রাণ ভরে প্রেয়সীকে দেখার এই ক্ষণ তো বছরে একবারই পাওয়া যায়। বসন্তের প্রথম দিন।
ঢাকা শহরে সে সময় বসন্ত আসতো আর কোনো হাঁক ডাক ছাড়াই দিনটা হয়ে যেত ভালোবাসা দিবস।
আমরা জানতাম ক্যালেন্ডারের পাতায় সেটা ১৩ ফেব্রুয়ারি। দশটি টকটকে লাল গোলাপ হাত বদল হত গভীর ভালোবাসায়।
কীভাবে যেন সেই শহরটা বদলে গেল। হলদে রং হটিয়ে রক্তিম লাল রংয়ে ছেয়ে গেল ঢাকা শহর। বসন্ত উদযাপন মলিন হল। ভালোবাসার জন্যে বিশেষ দিন হল ঢাকায়- ভ্যালেন্টাইন’স ডে। লাল রংয়ের ভালোবাসা দিবস।
আজ এ শহর বড্ড আধুনিক। ভালোবাসতেও যেন সবাইকে ঝা চকচকে আধুনিক হতেই হবে।
গত দুই দশকে এই শহর বদলেছে। বদলেছে ভালোবাসার নিয়ম। হ্যাঁ, আজ নিয়ম মেনে ভালোবাসতে হয়।
ভ্যালেন্টাইনের আগে তাই নামকরণ হয়েছে আরও কয়েকটি দিনের। এখন আর লাল গোলাপ নয়, জায়গা করে নিয়েছে টেডি, চকোলেট, হাগ আর কিস ডে।
টেডি, চকলেট কি আগেও ছিলো না? অবশ্যই ছিল।
নব্বই দশকের শুরুতে এই শহরে ভালোবাসার হরেক উপহার ফেরি করতো হলমার্ক অথবা আর্চিস গ্যালারি।
তখন কৈশোর চলে। ধানমন্ডি, গুলশান আর বনানী জুড়ে শুধুই হলমার্ক আর আর্চিস। কী কী পাওয়া যেত?
অবশ্যই চোখ ধাঁধানো সব কার্ড। এই দুইটা দোকানের কার্ড ছাড়া আবার ভালোবাসার উপহার হয় নাকি। সাথে ওই দোকানেরই ছোট ছোট স্যুভনির। আর চকলেট বক্স। ব্যাস হয়ে গেল ভালোবাসার উপহার।
ভালোবাসার উপহার হিসেবে আরেকটা প্রচলিত উপহার ছিল গানের ক্যাসেট।
নিউমার্কেটের ক্যাসেটের দোকান তো ছিলোই, আরও ছিলো এলিফ্যান্ট রোডের গীতালি, গানের ডালি।
আর ইংরেজি গানের ভক্ত হলে তো এলিফ্যান্ট রোডের কবির ভাইয়ের রেইনবো আর তার পাশের রিদম।
তবে এর বাইরেও ছিলো আরও একটা উপহার; সেটা হল বই।
বসন্তের ভালোবাসা দিবসের সময়টায় চলতো বইমেলা। সেখান থেকে বই কিনে অপেক্ষা করা কবে আসবে ১৩ তারিখ!
বইমেলা ছাড়াও নিউমার্কেট ও সোবহানবাগের জ্ঞানকোষ তো ছিলোই।
আজ হলমার্ক নেই, আর্চিস নেই, জ্ঞানকোষ নেই এই শহরে। বদলে আছে অনলাইন অর্ডার। যেখানে পাওয়া যায়, ডায়মন্ডের রিং, ব্রান্ডের পারফিউম বা মেইকআপ সেট।
বিদেশি ফুল আর চকোলেটও আজ অনলাইনে। তখনকার ছোট্ট ঢাকায় প্রেমিক প্রেমিকারা সারা শহর ঘুরে বেড়াতো হুড তোলা রিক্সায়।
আজ ঢাকা শহরে হুড তোলা রিক্সায় যুগল সমারোহ নেই। বরং নেট দুনিয়াতে পাওয়া যায় পাঁচ তারকা হোটেলে নাইট প্যাকেজের ভ্যালেন্টাইন অফার।
গত দুই দশকে ঢাকার হলদে বসন্ত থেকে লাল ভ্যালেন্টাইনে পাড়ি জমিয়েছে।