আনা ফ্রাঙ্কের বাড়িতে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এ বাড়িতে লুকিয়ে থেকেই তার করুণ ডায়েরিটি লিখেছিলেন ১৩ বছরের আনা ফ্রাঙ্ক।

কাউসার রুশোকাউসার রুশো
Published : 3 May 2023, 09:49 AM
Updated : 3 May 2023, 09:49 AM

আনা ফ্রাঙ্কের (১২ জুন ১৯২৯- ফেব্রুয়ারি/মার্চ ১৯৪৫) সঙ্গে পরিচয় তার জগৎ-বিখ্যাত ডায়েরির সুবাদে। জার্মান নাজি বাহিনীর নেদারল্যান্ডস অভিযানের সময় তিনি ও তার পরিবার দুই বছর একটি বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন, তার দিনলিপির বর্ণনা দিয়েছেন এ বইটিতে। স্কুলজীবনে পড়া সেবা প্রকাশনীর অনুবাদটা আমার কিশোর মনে ভীষণ দাগ কেটেছিলো। তারও অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম মূল ঘটনাটা।

নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে আনা ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবার যে বাড়িটাতে হলোকাস্টের সময় লুকিয়ে ছিলেন, তা জাদুঘর হিসেবে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। তাই পরিবারসহ আমস্টারডাম যাত্রার প্রথম গন্তব্যই ছিলো ‘আনা ফ্রাঙ্ক মিউজিয়াম’। 

আনা ফ্রাঙ্ক ও তার ডায়েরি সম্পর্কে সবাই কম-বেশি জেনে থাকবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে জার্মানির দখলকৃত নেদারল্যান্ডসে ইহুদি কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবারসহ আটজনের প্রায় দুই বছর আত্মগোপন করে থাকার ঘটনাই উঠে এসেছে বিশ্বখ্যাত এ ডায়েরিতে। দৈনন্দিন ঘটনা প্রবাহের পাশাপাশি তৎকালীন অন্ধকার সময়টাকেও ধারণ করে ডায়েরি। তেরো বছর বয়সী একটি মেয়ের মানসিক পরিবর্তনটা টের পাওয়া যায়। 

আনা ফ্রাঙ্ক লেখক হতে চেয়েছিলো। তাই আনা যখন রেডিও মারফত জানতে পারে সরকার যুদ্ধ শেষে ডায়েরি সংগ্রহে বের হবে, সে আবার নতুন করে লিখতে বসে। এ ডায়েরি তাই ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হলেও এর সাহিত্যমর্যাদা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু ১৯৪৪ সালে ফ্রাঙ্ক পরিবারসহ লুকিয়ে থাকা আটজন নাজি বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। পরিবারের সবাই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান। বেঁচে যান শুধু আনার বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে অটোর হাতে আসে আনার লেখা এ অসম্পূর্ণ ডায়েরি।

তিনি প্রয়োজনীয় পরিমার্জন আর সম্পাদনা করে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে পৃথিবীর মানুষের কাছে ডায়েরিটি প্রকাশ করেন। এ পর্যন্ত সত্তরটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এ ডায়েরি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ের তালিকায় উপরের দিকে অবস্থান করে ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’। আনা তার কোন এক জন্মদিনে এ ডায়েরিটি উপহার পেয়েছিল।

বেশ আগে থেকে টিকেট কেটে না রাখলে, এ জাদুঘরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। তাই যাওয়ার অনেক আগেই অনলাইনে কেটে রেখেছিলাম। জাদুঘরে যাওয়ার পথেই আনা ফ্রাঙ্কের একটি ভাস্কর্য রয়েছে যা পর্যটকদের নজর কাড়ে। আমস্টারডাম ক্যানেলের পাশ দিয়ে আনাদের বাড়িটা, যা এখন জাদুঘর। মূলত এ বাড়িটা ছিলো আনার বাবার ও তার ব্যবসায়িক পার্টনারের অফিস আর গোডাউন। এর মাঝেই বানানো হয়েছিলো সিক্রেট এনেক্স, আনার ভাষায় ‘গুপ্ত মহল’।

এ গুপ্ত মহল কাঠের তৈরি। জানালাগুলো এক সময় নীল রঙ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিলো যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায় এখানে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে। কালের বিবর্তনে নীলচে ভাবটা ধূসর ময়লাটে রঙ ধারণ করেছে। লুকানোর জায়গাটার প্রবশপথে সেই বিখ্যাত কাবার্ড যা দরজার মতো খোলা যায়। পুরো বাড়িটার যে অংশটা অফিস কামরা আর গোডাউন হিসেবে ব্যবহৃত হত, সেখানে এখন দেয়ালজুড়ে অজস্র ছবি আর ছবির বর্ণনা দিয়ে সাজানো। আর লুকানোর জায়গাটার প্রতিটা অংশই যেন ফিসফিসিয়ে না বলা অনেক গল্প বলে যাচ্ছে। জাদুঘরের ভেতরে ছবি তোলা, ভিডিও করা বারণ। তাই মনোযোগ দিয়ে জাদুঘরটা ঘুরে দেখা গেলো।

একদল হাইস্কুল পড়ুয়াকে দেখলাম জাদুঘরের ভেতর খুব হৈ-হুল্লোড় করছে আর ওদের নিয়ন্ত্রণ করতে বেচারি শিক্ষক খুব বেকায়দায় পড়ে গেছেন। ধমক-ধামকেও কাজ হচ্ছে না। ওদেরই বা কি দোষ! এ বয়সীদের কাছে জাদুঘর দর্শন ও অনুভব করার চেয়ে একসঙ্গে আউটিংটাই বেশি উপভোগ্য। তবে ভিন্ন দৃশ্যও চোখে পড়লো। এক কিশোরকে দেখি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মায়ের চোখও টলমল করছে অশ্রুতে। পুরোটা সময় জুড়েই মাতা-পুত্রের মুখে গভীর এক বিষাদ দেখেছি। আনার থাকার জায়গা, আনা-পিটারের চুমো খাওয়ার স্থল সেই চিলেকোঠা, আনার সংগ্রহ করা পোস্টার-কার্ড, খেলার জন্য মার্বেল, বইপত্র আর জন্মদিনে উপহার পাওয়া লাল রঙের সেই বিখ্যাত ডায়েরি দেখতে দেখতে মন বিষণ্ন হয়ে যায়।

জাদুঘর ঘুরে সন্ধান পাওয়া গেলো আনা ফ্রাঙ্কের একমাত্র ভিডিওটির। ভিডিওতে দেখা যায়, কোন এক প্রতিবেশীর বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে আর আনা বাড়ির বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। আগ্রহী পাঠকদের জন্য বলে রাখি, আনার এই দুষ্প্রাপ্য ভিডিওটি জাদুঘরের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলেও আছে। তবে আমার চোখ আটকে যায় একটি চিঠি আর ছবিতে। চিঠিটি আনার বাবা অটো ফ্রাঙ্কের কাছে লেখা, যেখানে নিশ্চিত করা হয়েছে তার দুই মেয়ে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মারা গেছেন। নাজি বাহিনীর নির্যাতন থেকে বেঁচে ফেরা অটো ফ্রাঙ্ক ১৯৬০ সালে সাংবাদিকদের দেখাচ্ছিলেন তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গাটি। অটো সিক্রেট এনেক্সের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে স্মৃতির বয়ান দিচ্ছেন। 

কোন এক ফটো সাংবাদিক অটোর একটি ছবি তুলে ফেলেন সেই সময়ে। এক সমুদ্র কষ্ট নিয়ে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে, তার যন্ত্রণাদায়ক এক প্রতিচ্ছবি এই ফটোগ্রাফটি। আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। সঙ্গে থাকা আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে স্বার্থপরের মতো ব্যথা লুকাই। কিন্তু অটো ফ্রাঙ্কের তো কোন যাওয়ার জায়গা ছিলো না! এক দানব যে তার পৃথিবী ওলট-পালট করে দিয়ে গেছে।

ফ্রাঙ্কদের গোপন কুঠুরিতে প্রবেশ করে সত্যিই এক দমবন্ধ করা অনুভূতি হয়। জাদুঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও এ অনুভূতি থেকে বের হওয়া সম্ভব হয় না। আমস্টারডামের পাথুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে তাও প্রায় পৌনে এক শতাব্দী হতে চললো। কিন্তু চির অধরা শান্তি কি মিলেছে? আজও যে গুটিকয়েক মানুষের জেদের কারণে বাতাসে অটো ফ্রাঙ্কদের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।

কাউসার রুশো: ভ্রমণ লেখক, কর্মসূত্রে যুক্তরাজ্য প্রবাসী