স্কুলের নাম ‘সোলাইমান কিন্ডারগার্টেন।’...হেডস্যারের রুমে ঢুকতেই দেখি গোলাপি তোয়ালে বিছানো চেয়ারে হেলান দিয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছেন।
Published : 24 Sep 2022, 10:09 AM
যখন আমি স্কুলে ভর্তি হই তখন ইংরেজিতে ‘আমব্রেলা’ শব্দের বানানটা না দেখেই লিখতে পারি। বয়স তখন ৫।
বাড়ির একদম কাছেই একটা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করার জন্য আমাকে নিয়ে গেলেন বড়দা। ওমা, স্কুল বুঝি এমন হয়! বড়দার হাত ধরে যখন স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকলাম, চলন্ত গাড়ির মতো পা দুটো কেমন যেন থমকে গেল। এ কোথায় এলাম! গতকাল সারাদিন কি এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ভেবেছি! স্কুলের নাম ‘সোলাইমান কিন্ডারগার্টেন।’ এখন অবশ্য বুঝি নাইন্টিজের পাড়ার কিন্ডারগার্টেন এর চেয়ে আর কত ভালো হয়!
চারপাশে ইটের গাঁথুনি আর উপরে টিনের ছাউনি। দরজা জানালাগুলো গাঢ় নীল রঙের। মেঝে টাইলসের হওয়া তো দূরের কথা, মাঝের পাসিংওয়েটা ইটের। তার দু’পাশে ক্লাসরুমের সারি আর সোজা গিয়ে যেখানে ঠেকেছে, সেখানে হেডস্যারের রুম। হেডস্যারের রুমে ঢুকতেই দেখি গোলাপি তোয়ালে বিছানো চেয়ারে হেলান দিয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। হেডস্যারকে কমবয়সী বলেই মনে হলো।
ক্লাসরুমে ঢোকার পর লক্ষ্য করলাম, ক্লাস হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছে। সবাই আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখছে। কেউ কেউ আমার হাঁটুর দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ পাশের জনকে ফিসফিস করে আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দিচ্ছে। যে দেখছে সে ফিক করে হাসছে।
বড়দার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন হেডস্যার। পাশের চেয়ারে বসে আমি চোখ ঘুরিয়ে আশপাশ দেখছিলাম। বড়দা স্যারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটা ফরম পূরণ করলেন। সম্ভবত ওটাই আমার ভর্তির ফরম ছিল। আমাকেও স্ট্যাপল করা কিছু সাদা কাগজ দেওয়া হলো। টুকটাক কিছু শব্দ, কিছু ওয়ার্ডমিনিং করতে বললেন হেডস্যার। আমি ঝটপট লিখে দিলাম। কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হেডস্যার বললেন, ‘ভেরি গুড!’ কেজি-তে ভর্তি নিলেন আমাকে।
স্যারের রুম থেকে বের হয়ে বড়দা আমাকে নিয়ে নীল দরজার ক্লাসরুমগুলোর সামনে দাঁড়ালেন। রুমগুলো পুরোই এয়ারটাইট বয়ামের মতো। সারি সারি বিছানো বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসে ছেলেমেয়েরা। কিচির-মিচির শব্দ। স্টুডেন্টদের কেউ কেউ ইউনিফর্ম পরা, আবার কেউ রেগুলার ড্রেস পরা। সামনের ক্লাসরুম থেকে হালকা-পাতলা গড়নের এক ম্যাডাম বের হয়ে এলেন। বাসন্তী রঙের সুতি শাড়ি পরেছেন। আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসিমুখে ম্যাডাম এগিয়ে এলেন। বললেন, মাত্র ভর্তি করলেন?
বড়দা বললেন- জি। ক্লাস করতে পারবে?
ম্যাডাম বললেন- অবশ্যই। বড়দার হাতের কাগজগুলো দেখে আঙ্গুল দিয়ে ক্লাসরুম দেখিয়ে দিলেন। বললেন, এটা ওর ক্লাসরুম।
ধর্ম ক্লাস চলছিল। একটা ছেলে সবার সামনে দাঁড়িয়ে কালিমা শাহাদাত পড়ছিলো। ওর নাম সৌরভ। পাশের টেবিল-চেয়ারে বসে আছেন স্যার। টেবিলের ওপর একটা বেত।
ক্লাসরুমে ঢোকার পর লক্ষ্য করলাম, ক্লাস হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছে। সবাই আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখছে। কেউ কেউ আমার হাঁটুর দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ পাশের জনকে ফিসফিস করে আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দিচ্ছে। যে দেখছে সে ফিক করে হাসছে।
বড়দা স্যারের সঙ্গে কথা বললেন। স্যার আমাকে সামনের বেঞ্চে অনেকগুলো মেয়ের পাশে বসিয়ে দিলেন। আমার কাছে বই-খাতা কিছু নেই। সবার সামনে একটা করে খাতা খোলা। হাতে পেন্সিল। আমার পাশে বসা মেয়েটা আমাকে বলল, অ্যাই তুমি এত ছোট জামা পরেছো কেন?
আমি বুঝলাম এখানে আমি ছাড়া কোনো মেয়ে হাঁটুর উপর জামা পরেনি। বললাম, এটা জামা না, স্কার্ট।
মেয়েটা ভেংচি কেটে আমার কথাকে বিকৃত করে বলল, জামা না, স্কার্ট! হি হি হি..
ওই ক্লাস শেষে সেই বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পরা ম্যাডাম ঢুকলেন। ‘রিফাত’ ম্যাম বলে সবাই ডাকছিল তাকে। কতগুলো অঙ্ক করালেন। তারপর একটা ঘুড়ি আঁকতে দিলেন। আমি বসে বসে ঘুড়ি আঁকা দেখলাম। আজ শুধু দেখাই কাজ। পাশের মেয়েটা বলল, তোমার নাম কী?
সানজিদা সামরিন। তোমার নাম?
সুলতানা।
ঘুড়ি আঁকা শেষে রিফাত ম্যাম ঘুরে ঘুরে সবার খাতা দেখছেন। সবার খাতা দেখা শেষে রিফাত ম্যাম বললেন, সবাই ব্যাগ গোছাও। ঘণ্টা পড়লে লাইন ধরে ক্লাস থেকে বের হবে।
সিন্দাবাদের এক একটা এপিসোড শেষ হতো আর পরদিন ওই এপিসোডের কাহিনি নিয়ে আমরা ক্লাসরুমেই খেলতাম। বেঞ্চগুলো ছিলো সিন্দাবাদের জাহাজ। আর আমি সিন্দাবাদের নায়িকা। সিন্দাবাদ চরিত্রে কে ছিলো তা মনে নেই এখন।
সবাই হুড়মুড় করে বই-খাতা গোচ্ছাচ্ছিল। নিমেষেই ক্লাসরুমটা শোরগোলে মুরগির ফার্ম হয়ে গেল। আমার ব্যাগও নেই, বই-খাতাও না। চুপচাপ বসে সবাইকে দেখতে লাগলাম। খেয়াল করলাম এখানকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই শুদ্ধভাষায় কথা বলে না, শুধু সৌরভ বলে, যে ছেলেটা কালিমা শাহাদাত পড়ছিল। ও ছাড়া অন্য সব ছেলেগুলো কেমন যেন দুষ্টু প্রকৃতির। কারণে-অকারণে হাসে। সেদিন কেন যেন কাউকেই আমার বন্ধু মনে হলো না। মনে হলো ওরা সবাই এক রকম, আমাকে ওরা ওদের মতো ভাবে না! হয়ত পছন্দও করে না।
পরের দিন স্কুলে গেলাম। ধর্ম স্যার আমাকে সৌরভের পাশে বসালেন। আমরা স্যারের সঙ্গে সঙ্গে পড়লাম, লিখলাম। বাংলা ক্লাসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছড়া বললাম। সেদিন সবাই হাততালি দিল। ধীরে ধীরে মনে হলো ওরা অনেকেই বন্ধু হতে পারে। আমার হেয়ারব্যান্ড, মোজা আর পেন্সিল ওদের ভালো লাগে। ছুটির পর আব্বু বা বাড়ি থেকে আমাকে নিতে না আসা অব্দি সৌরভ তার মা-সহ প্রায়ই অপেক্ষা করতো। মাঝে মাঝে রিয়া আর রিয়ার আম্মুও।
কিছুদিন বাদে কতগুলো নামও পেয়েছিলাম ক্লাসমেটদের কাছ থেকে। ‘মেমসাহেব’ সেসব নামের একটি। ক্লাসে ঢুকলে এদিক ওদিক থেকে অনেকে ডাকতো ‘মেমসাহেব’ এখানে বসো, আমার পাশে এসো। তখন টিচার জিজ্ঞেস করতেন আমি কোথায় বসতে চাই? আমি সৌরভের পাশে বসতে চাইতাম। আর সোহান নামের বেঁটে ছেলেটা গাল ফুলিয়ে বসে থাকতো।
ওহ একটা কথা- সোহান সবসময় মেয়েদের মতো মেহেদি পড়তো হাতের তালুতে আর নখে। কী যে বাজে লাগতো দেখতে; ভাবা যায় না! টিচার যখন রাইমস বলার জন্য ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে এসে দাঁড়াতে বলতেন, তখন সোহান, সৌরভ, ভিমসিন এমন অনেকেই নিজের বেঞ্চ থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে সামনে নিয়ে যেতে চাইতো। কোনো একটা অদ্ভুত কারণে এসব অদ্ভুত কাজ ওরা করতো।
তখন ছিলো বিটিভির যুগ। সিন্দাবাদ, এরপর রবিনহুডের রমরমা সময়। সিন্দাবাদের এক একটা এপিসোড শেষ হতো আর পরদিন ওই এপিসোডের কাহিনি নিয়ে আমরা ক্লাসরুমেই খেলতাম। বেঞ্চগুলো ছিলো সিন্দাবাদের জাহাজ। আর আমি সিন্দাবাদের নায়িকা। সিন্দাবাদ চরিত্রে কে ছিলো তা মনে নেই এখন।
ক্লাসে একজনই ট্রাইবাল বয় ছিল। নাম ভিমসিন। আমি বলতাম- চাইনিজদের মতো দেখতে ছেলেটা। ধবধবে সাদা। দ্বিতীয় দিনের ক্লাসেই বেঞ্চ থেকে দাঁড়িয়ে ধর্ম স্যারকে বলে বসেছিল- সানজিদাকে আমি বিয়ে করবো। ও আমার বৌ!
উফ কী যে একটা হো হো সিচুয়েশন সারা ক্লাস জুড়ে ভাবা যায় না! আমি দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। স্যার জোরে জোরে হাসছিলেন। বললেন, এখন বসো। বড় হলে তোমাকে আমরা বিয়ে দেব।
রিয়া নামের স্লিম, ঝরঝরে চুলের মেয়েটা আমার খুব কাছের বন্ধু হয়ে গেলো। মনে আছে, একবার ছুটি হয়ে যাওয়ার পর আমি, সৌরভ আর রিয়া ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছিলাম। কাউকেই বাসা থেকে নিতে আসেনি। তবে তিনজনের মধ্যে আমাকেই আগে নিতে এলো আমার বড়বোন। আদর করে সৌরভের চিবুক টেনে দিয়েছিলো বড়বোন। কী যে কেঁদেছিলাম হিংসায়! বাড়ি ফিরে ক্রোকারিজের শোকেজের পেছনে বসে কেবল কেঁদেইছিলাম। তবে হ্যাঁ সৌরভই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
সোহান আর রাজু আমার চুল ধরে টানাটানি করতো আর আমি বাংলা টিচারকে কমপ্লেইন দিতাম। মাঝে মাঝে তিনি ওদের দুজনকে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতেন।
সময়টা ছিলো জোড়ায় জোড়ায় বন্ধুত্বের। তার মধ্যে আবার ছেলে-মেয়ে আলাদা ভাগও আছে। রিয়া-সানজিদা, সুলতানা-লাকি এমন। সাথী নামে একটা মেয়ে ছিলো ভাসমান। কখনও এ দলে তো কখনও ও দলে। তবে কাছাকাছি সময়ে আমিও ভাসমান হয়ে গেলাম। ক্লাস ওয়ানে ওঠার পর সৌরভ অন্য স্কুলে চলে গেলো। রিয়াও সুলতানার খুব বন্ধু হলো।
লাকি বরাবরই ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে আমার কেমেস্ট্রি নিয়ে গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলতে শুরু করলো সবাইকে। ঝগড়া-ঝাটি করতে পারতাম না বলে যখন যে দলে জায়গা পেতাম সেখানেই থাকতাম, যে যা বলতো সেটাই মেনে নিতাম। কষ্ট হলেও ক্লাসে কাঁদতাম না। বাসায় এসে বড় সোফাটার পেছনে মেঝেতে শুয়ে কাঁদতাম। একবার অবশ্য এসব কারণে রাগে লাকির খাতা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। এরপর ও আমার খাতা টুকরো টুকরো করে দিল। দুজনেই ক্লাস টিচারের বকা খেলাম।
দিনে দিনে আমার চুল অনেক লম্বা হয়ে গেলো। কোমরের কাছাকাছি। সোহান আর রাজু আমার চুল ধরে টানাটানি করতো আর আমি বাংলা টিচারকে কমপ্লেইন দিতাম। মাঝে মাঝে তিনি ওদের দুজনকে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতেন। সেই বাংলা টিচার আমাকে খুব আদর করতেন।
তারপর দেখতে দেখতে ক্লাস ওয়ান শেষ হলো। বড়দা একদিন অন্য একটা স্কুলের ফরম তুলে আনলেন। সবাইকে বলতে লাগলেন- নতুন স্কুলটা নাকি বেশ কড়া। অর্থাৎ সোলাইমান কিন্ডারগার্টেনের পর্ব এখানেই শেষ হলো। অনেকদিন পর রাজুও আমার নতুন স্কুলে ভর্তি হলো। যদিও ওর সঙ্গে কখনওই কোনো ক্লাস পড়েনি আমার। তবে সৌরভকে আমার অনেকদিন মনে ছিলো। এখন অতটা মনে নেই, বড় হয়ে গেছি তো।
ক্লাসে যখন টিচার আমাকে ডাকতেন সামনে এসে ছড়া বলার জন্য, তখন সৌরভ ওর বেঞ্চ থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে সামনে নিয়ে যেত- একথা মনে পড়ে মাঝে মাঝে। তবে পথে আসতে যেতে এখানে ওখানে কেউ যদি কাউকে সৌরভ বলে ডাকে তাহলে আমার মনে হয়- হতেও পারে এটা আমার সেই বন্ধুটি! সেও তো আমার মতো এত্ত বড় হয়ে গেছে। আর রিয়া! ও এখন কোথায় কী করছে কে জানে! মেমসাহেবকে বুঝি হয়তো মনেও নেই ওদের।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!