মেয়েদের ফুটবলের ‘পোস্টার গার্ল’ বলা হয় সানজিদা আক্তারকে। সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দল যে ছাদখোলা বাসে করে ঢাকা শহর ঘুরেছিল, সেটা সানজিদার এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসের কল্যাণেই। সেই সানজিদা আজ জানাচ্ছেন তার শৈশব-কৈশোর আর ফুটবলে আসার নানা গল্প।
Published : 15 Oct 2022, 06:20 PM
ছোটবেলায় অনেক দুষ্ট ও চঞ্চল টাইপের মেয়ে ছিলাম। এমন কোন খেলা নেই যা আমি খেলতাম না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতাম, সবার সঙ্গে খেলতাম।
আম চুরি করে খেয়েছি, বরই চুরি করে খেয়েছি, বিকেলে যখন বাসা থেকে প্র্যাকটিসের জন্য বের হতাম তখন রাস্তায় বরই চুরি করে খেয়েছি। তারপর দৌড়!
আমরা চার বোন দুই ভাই। মেঝো বোনটা আমার সঙ্গে 'ইয়ে' করতো, আসলে কাজকর্ম বেশি করতাম না। আমার বড় দুই বোন আর আম্মুই শুধু কাজ করতো। আমি শুধু খেতাম আর স্কুলে যেতাম। খেলাধুলা করতাম, এটাই নেশা ছিল।
তো মেঝো বোন বলতো আমি কোন কাজ করি না, শুধু ঘুরিফিরি খাই। তখন তারাও ছোট, আমিও ছোট। মায়ের কাছে নালিশ দিতো- তোমার মেয়ে ফুটবল খেলে, কাজ করে না, ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ায়, তাকে কিছু বলো না! আমাকে দিয়ে শুধু কাজ করাও, শুধু আমরাই কাজ করি! এগুলো বলতো। তখন আম্মু বলতো, সে তো ছোট্টই, বড় হয়ে কাজ করবে। এখন তোরা কর, সে বড় হয়ে কাজ করবে। এমন করেই বলতো।
আমাকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে প্রথম মাঠে নামায় কলসিন্দুর স্কুলের মফিজ উদ্দিন স্যার। মফিজ স্যারের হাত ধরে মাঠে নামা, সবুজ ঘাস স্পর্শ করা। আসলে ফুটবল কী কেন আমি তো তখন কিছুই জানতাম না বা বুঝতাম না। ফুটবলে আসলে ভর্তি হওয়া যায়, টাকা পয়সা পাওয়া যায়, ন্যাশনাল টিমে আমি খেলতে পারবো, দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারবো, তখন এসব বুঝতাম না। দেশের মানুষের জন্য ট্রফি আনতে পারবো, এগুলো আমি কিছুই জানতাম না।
২০১১ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে আমার খেলা শুরু হয়। ওইখানে আমাদের যে দলটা ছিল তারা অনেক ভালো খেলেছে সবাই। আমরা সব জায়গায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে গিয়ে আমরা পরপর দুইবার হেরে গিয়েছি। হেরে যাওয়ার পরও হাল ছাড়িনি। তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আমাদের যে কলসিন্দুরের দল ছিল এমন শক্তিশালী হয়েছি যে বাংলাদেশের যে কোন দল আমাদের কাছে হেরেছে, এমন কোন দল নেই যে আমাদের কাছে হারেনি, এমন কোন জেলার দল বাদ নেই যে আমাদের কাছে হারেনি।
আসলে আমি যদি ফুটবল না খেলতাম তাহলে হয়তোবা এতোকিছু পেতাম না। দেশের বাইরে যাওয়া, তারপর হচ্ছে এই যে ধরেন এতো মজা করি আমরা, এগুলো কিছুই পেতাম না। ফুটবলে যে এসেছি এটা না-ও হতে পারতো, পরিবার না-ও খেলতে দিতে পারতো। চাইতো না যে ফুটবল খেলি। তারপরও আমাদের স্যার-ম্যাডামরা আমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।
প্রথম যখন আমি ন্যাশনাল ক্যাম্পে আসি, সুজন স্যারদের কাছে আসি। তখন আমার কোন ফোন ছিল না। বাসায় একটা ফোন ছিল, কিন্তু আমার কাছে কোন ফোন ছিল না। এখানে আসার পর প্রতি শুক্রবার স্যাররা তাদের ফোন দিয়ে কথা বলিয়ে দিতো বাসায়। স্যারদের ফোন দিয়ে আমি কথা বলতাম। অনেক খারাপ লাগতো যে পরিবার ছাড়া হঠাৎ করে এভাবে এসে থাকা, অনেক কষ্ট লাগতো। আড়ালে অনেক সময় কান্না করতাম যখন মনে পড়তো। তো ধীরে ধীরে মানিয়ে নিই ওই পরিবেশে।
২০১৪ সালে আমি ক্যাম্পে আসি অনূর্ধ্ব-১৬ খেলতে। তখন প্রথম ঈদ আমাকে এখানে করতে হয়েছে। ওইসময় প্রথম আমি পরিবার ছাড়া এখানে ঈদ করেছি। আর ওই ঈদে ম্যাডাম সুন্দর সুন্দর জামা এনে দিয়েছিল। ‘কিরণমালা জামা’ বা ‘জিপসি জামা’ ওই রকম ড্রেস বের হয়েছিল তখন। ম্যাডাম আমাকে কিরণমালার একটি ড্রেস দেয়, আমি তো মহাখুশি। প্রথম একটু খারাপ লাগছিল যে বাসার সবাইকে ছাড়া প্রথম ঈদ করছি। যখন কিরণমালা ড্রেস পরেছিলাম আমার সে কি আনন্দ!
আসলে আমাদের দেশে কখনও তো এমনটা হয়নি। আর আমরা ওইরকম কোন ট্রফি এনে দিতে পারিনি বাংলাদেশকে। দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল যে, সিনিয়র পর্যায়ে আমরা তাদের কিছু একটা করে দেখাই। একটা ট্রফি নিয়ে আসি। তো আমরা এবার ফাইনালে যেহেতু গিয়েছি তারপর সুযোগ ছিল যে করে দেখাতে পারবো, একটা এনার্জি পেয়েছি অন্যরকম যে আমরা পারবো এবার।
সেই থেকে আমি ছাদখোলা বাসের কথা ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়ায় দর্শক যারা আছেন তারা বললো, তোমরা আমাদের মন জয় করে নিয়েছো। তোমরা যদি ট্রফি নিয়ে না-ও আসতে পারো তাও তোমাদের আমরা সেভাবে বরণ করে নেবো।
আমি দেখেছি যে অনেক দল জেতার পর তারা ছাদখোলা বাসে ট্রফি নিয়ে ঘোরে। অনেক আনন্দ করে। তারপর দেশবাসীর কাছে তারা ট্রফিটা ওইভাবে নিয়ে আসে। আমার ইচ্ছে হয়েছিল যে যদি আমরা চ্যাম্পিয়ন যদি হই ওইভাবে যদি আমরাও ট্রফি নিয়ে আসি দেশবাসীর কাছে, এটা অন্যরকম একটা ইতিহাস সৃষ্টি হবে বাংলাদেশে, এই আর কি!
বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট যেভাবে সার্পোট করে ফুটবলও যে একইভাবে সার্পোট করবে ভাবিনি, ওইভাবে কল্পনাও করিনি। তো যখন ছাদখোলা বাসে উঠলাম, উঠার পর এতো মানুষ দেখলাম, তখন বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমাদেরও সার্পোট করে, আমাদেরও ভালোবাসে দেশের মানুষ। তখনও আমি কল্পনা করছিলাম, সত্যি কি এটা বাস্তব নাকি আমি স্বপ্নের মধ্যে আছি! এই রকম মনে হচ্ছিলো ওই সময়।
আমি চাই সবাই ফুটবল ভালোবাসুক, আমাদের সঙ্গে থাকুক, মেয়েদের ফুটবল খেলা সবাই সমর্থন করুক। যারা আমাদের মতো সানজিদা, কৃষ্ণা, মারিয়া, মনিকা হতে চায়, যারা খেলতে চায়, তাদের যেন খেলতে দেওয়া হয়। ওদের যেন বাধা দেওয়া না হয়। দেশের জন্য অনেক ভালো হবে। আমাদের মতো আরও অনেক ফুটবলার উঠে আসতে পারবে।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!