পাতার খস খস শব্দ কানে ঝংকার তোলে। ছাপার অক্ষরের সারি কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয়।
Published : 29 Nov 2023, 12:00 PM
মোড়কটি খুলতেই বেরিয়ে এলো। কী আর বেরুবে! টাটকা নিপাট এ বছরের শারদীয় ‘দেশ’। প্রেরক স্নেহভাজন সমীর ভট্টাচার্য, নিউ জার্সির ‘পরবাসের' স্বত্বাধিকারী। বইটি দু’হাতে তুলে লম্বা শ্বাস নিলাম। নতুন পত্রিকার কাগজের গন্ধ, মলাটের রংয়ের গন্ধ, বাঁধাইয়ের আঠার গন্ধ। আহা! ‘দেশের’ স্বাদই আলাদা।
মনে পড়ল প্রথম শারদীয় ‘দেশ’ কিনি ১৯৬৯ সালে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র আমরা তখন। সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে পরিচয়ও সে বছর। নিউ মার্কেটের আজিমপুরের ফটক পেরিয়ে একটু ভেতরে ছিল ‘নলেজ হোম’, পত্র-পত্রিকার গুদামখানা বলা চলে। কী পত্রিকা ছিল না সেখানে?
সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে নলেজ হোমে যেতাম। তুলে নিতাম ‘দেশ’। ধারাবাহিক কতো লেখা তো ‘দেশেই’ পড়া- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একা এবং কয়েকজন’, প্রতিভা বসুর ‘স্মৃতি সততই সুখের’, শিবরাম চক্রবর্তীর ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’ ও ‘ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর’, কিংবা বুদ্ধদেব বসুর ‘মহাভারতের কথা’। আরো ভালো লাগত সমরজিৎ করের ‘বিজ্ঞান বিচিত্রা’ ও মৌলিনাথের (বুদ্ধদেব তনয় শুদ্ধশীল বসুর কলমি নাম) ‘পশ্চিমবঙ্গের পথে-ঘাটে’। সত্যি কথা যদি বলি, তবে প্রতি সপ্তাহের ‘দেশ’ খুলেই চলে যেতাম শেষ পাতায় ‘অরণ্যদেব’ পড়তে।
কি যে ভালো লাগত সেসব লেখা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম প্রথম পাতা থেকে শেষতক। পড়ে ফেলতাম চিঠিপত্রও। সাহিত্যের কত বিতর্ক, কত মতানৈক্য, তা-ও তো জেনেছি ওই ‘দেশ’ পড়েই। পত্রিকাটির মাঝামাঝি জায়গায় থাকতো কবিতাগুচ্ছ। শেষদিকে সঙ্গীত, শিল্প, চলচ্চিত্র ও নাটক বিষয়ক সমালোচনা। এসব কিছু ছাপিয়ে ভালো লাগত ছাপার গন্ধ, পাতা উল্টানোর শব্দ, দু’করতলের মধ্যে একটি পুরো পত্রিকার স্পর্শ।
পাশেই ছিল ‘মহিউদ্দীন অ্যান্ড সন্স’ এর দোকান, ‘পেঙ্গুইন’ আর ‘পেলিকান’ বইয়ের স্বর্গ। তখন মার্কিন ১ ডলার পাকিস্তানি ৪ টাকা ৭৫ পয়সার সমান ছিল। ফলে আমার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও ওইসব বই কিনতে পেত। মহিউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে একটা হৃদ্যতা গড়ে ওঠেছিল। আশির দশকে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তখন প্রায়ই যেতাম সেখানে সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশনা কিনতে। কখনো কখনো মহিউদ্দীন সাহেব আমাকে নতুন প্রকাশনার সন্ধান দিতেন।
আশির দশকে নিউ মার্কেটে গেছি, কিন্তু ‘জিনাত বুক সাপ্লাইয়ের’ ফয়সালের (সৈয়দ আবে সালেহ মোহাম্মদ ফয়সাল) সঙ্গে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে গল্প করিনি তেমনটা হয়নি। কী থাকতো না সে গল্পে! বিশ্ব রাজনীতি থেকে বই ব্যবসা, লেখক থেকে ‘দারুল আফিয়া’ পর্যন্ত। প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর পৈত্রিক বাড়ির অনেককেই ফয়সাল চিনতো। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে আমাদের কনিষ্ঠা কন্যা মেখলা থাকতো। আমাদের গাল-গল্পের কালে সে দোকানের মেঝেতে গাদা করা বইয়ের ওপর বসে ‘নন্টে-ফন্টে’ পড়তো। প্রায়ই ফয়সাল ঠাট্টা করে বলতো, ‘মেখলা! প্রতিদিন তুমি এসে বইয়ের পর বই পড়ে শেষ করে যাবে, কিন্তু কোন বই কিনবে না, সেটা তো হয় না’। মেখলা হাসতো।
মনে পড়ে শৈশবে প্রতিবছরের শুরুতেই সেতারের তারের মতো টান টান উত্তেজনা নতুন শ্রেণির নতুন বইয়ের জন্য। বইয়ের তালিকা পাওয়ার পরই বাবাকে অস্থির করে মারতাম, কবে বই কিনতে যাওয়া হবে!
কোন কোনদিন সেখানে দেখা হয়ে যেতো জনাব সাঈদুজ্জামান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. মশিউর রহমান বা প্রয়াত ড. ফসিহউদ্দীন মাহতাবের সঙ্গে, বইপাগল অনন্যসাধারণ একদল মানুষের সঙ্গে। সম্ভবত ‘বুকমার্টের’ স্বত্বাধিকারী ছিলেন কিশোর সাহিত্যিক জনাব গোলাম রহমান। চিনতাম তাকেও। আমার কৈশোরে তার ‘রকমফের’ বইটি পুরস্কার পেয়েছিলাম। পড়ে পড়ে হদ্দ হয়ে গিয়েছিলাম। ‘জিনাত বুক সাপ্লাই’ ভিন্ন ইংরেজি বইয়ের জন্য যেতাম ‘ওয়ারসি বুক সেন্টার’ বা ‘মল্লিক ব্রাদার্সে’। তবে বইয়ের ব্যাপারে আমার একটি বড় প্রিয় জায়গা ছিল স্টেডিয়ামের দোতলায় ছোট্ট দোকান ‘ম্যারিয়েটা’। দোকান ছোট্ট, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বহু বই পাওয়া যেত সেখানে। আশির দশকে আমার কেনা বহু বইয়ের উৎস ‘ম্যারিয়েটা’। আজও আমার পড়ার ঘরের তাক থেকে বই নামালে দেখতে পাই, বহু বইয়ের প্রথম পাতাতেই সেই মুদ্রিত নাম ‘ম্যারিয়েটা’।
ম্যারিয়েটার মালিক খুব ভালোবাসতেন আমাকে। গেলে পরেই নানা গল্প করতেন। কখনো কখনো তার ছোট্ট মেয়েটি তার পাশে বসে থাকতো। বহু বছর বাদে আজিজ সুপার মার্কেটের একতলায় একটি শিল্পকর্মের দোকানে গেলে তার তরুণী মালিকটি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে জানালেন যে আমি তার পরিচিত, ‘ম্যারিয়েটার’ সেই ছোট মেয়েটিই তিনি। বললেন যে, আমি তার বাবার প্রিয় মানুষ ছিলাম, আমার কোন টেলিভিশন অনুষ্ঠান তিনি বাদ দিতেন না।
‘ম্যারিয়েটার’ পাশেই ছিল ‘স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স’, রাশিয়ার প্রগতি প্রকাশনীর আড়ত বলা চলে। ম্যাক্সিম গোর্কিসহ বহু রুশ সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মের বাংলা অনুবাদ সেখান থেকেই কিনেছি। পুরনো বইয়ের জন্য ঢুঁ মারতাম দু’জায়গায়। প্রথমত: বাংলা বাজার, আর দ্বিতীয়ত: শহীদ মিনারের পাশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক অট্টালিকার পাশের দেয়াল ঘেঁষা দুটো পুরনো বইয়ের দোকান। তার একটির মালিকের কথা মনে আছে, উর্দুভাষী ভীষণ ভদ্র মৃদুকণ্ঠ একজন মানুষ। বহু বই কিনেছি তার কাছ থেকে।
মনে পড়ে শৈশবে প্রতিবছরের শুরুতেই সেতারের তারের মতো টান টান উত্তেজনা নতুন শ্রেণির নতুন বইয়ের জন্য। বইয়ের তালিকা পাওয়ার পরই বাবাকে অস্থির করে মারতাম, কবে বই কিনতে যাওয়া হবে! তারপর যাওয়া যেত ‘স্টুডেন্ট লাইব্রেরি’। তালিকা ধরে ধরে বই মেলানো হত। প্রতিটি বই আমাদের সামনে রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। প্রথমেই প্রচ্ছদে হাত বুলাতাম। তারপর ভারি সতর্কতার সঙ্গে পৃষ্ঠা ওল্টানোর পালা। নাকের কাছে নিয়ে পৃষ্ঠা শুঁকতে গেলেই লাইব্রেরির মালিক হারান কাকা বলতেন, ‘ওটা কোর না হে, ছাপাতে সিসে থাকে’।
তারপর বইগুলো কাগজে মুড়িয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে আসা হতো বাসায়। বাবা সুন্দর করে বইগুলোতে মলাট লাগিয়ে নাম লিখে দিতেন। তারপর আরেকবার স্পর্শ, শোঁকা এবং এক টানে পড়ে ফেলা, বিশেষ করে বাংলা আর দ্রুত পঠনের বইগুলো। বই পড়ার মজা তো ওখানেই। শুধু তো পড়া নয়, তার সঙ্গে বইয়ের স্পর্শ, গন্ধ, হাতের মধ্যে ধরা। পৃষ্ঠা ধরে চলে যাওয়া যায় সামনে পেছনে অনায়াসেই। পাতার খস খস শব্দ কানে ঝংকার তোলে। ছাপার অক্ষরের সারি কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দেয়। হস্তস্তিত জিনিসটি কেমন যেন আপনার মনে হয়।
আজকের নব্য প্রযুক্তির যুগে বই আর বই পড়া ক্রমেই কমে আসছে। আমাদের পড়া এখন অনেকটা যান্ত্রিক উপায়েই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে জলজ্যান্ত বইয়ের জায়গা নেই। প্রয়োজন কি স্পর্শ, গন্ধ বা হস্তস্থিততার? পড়া হলেই হলো। তাই হয়তো এক মা ক’দিন আগে তার মেয়েকে লিখেছেন, ‘প্রযুক্তি তোমাদের বেশি টানে। অথচ বই পড়া, বইয়ের ঘ্রাণ অন্য রকম’। টেবিলের ওপর শারদীয় ‘দেশ’টির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো, একদিন হয়তো এর পাঠকও থাকবে না, কিংবা ওই পত্রিকাটিই হয়তো বিলীন হয়ে যাবে।