তার মতো আর কেউই নেই। এতোটা দূরত্ব থাকে শুধু মানুষ আর নক্ষত্রের।
Published : 27 Aug 2023, 03:05 PM
হাল আমলের কয়েকজন ক্রিকেটারকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, ‘তোরা টি-টোয়েন্টি খেলতে পারিস না কেন বাপু?’ তারা সেই শেখানো বুলিটিই আওড়াবে, ‘গেইল-রাসেলদের মতো ছক্কা হাঁকানোর শক্তি নেই আমাদের।’ মানে গায়ের জোরের ক্রিকেটেই পিছিয়ে থাকাটা তাদের বাজে খেলার কারণ!
অথচ ডন ব্র্যাডম্যান (২৭ অগাস্ট ১৯০৮ - ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০১) শরীরের মাপে ক্যারিবিয়ানদের মতো ছিলেন না। বরং গড় অস্ট্রেলিয়ানদের তুলনায় বেঁটেই ছিলেন। মাত্র ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির একটা শরীর নিয়েই ঘটিয়েছেন হুলস্থুল কাণ্ড, তাকে বলা হয় ‘বিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার’।
তিনি হয়তো দুর্দান্ত টি-টোয়েন্টি ব্যাটার হতে পারতেন। যদিও ২৩৪ ম্যাচের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি একটিও ছক্কা মারতে পারেননি। ৫২ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে ছক্কা মাত্র ৬টি, এর মধ্যে পাঁচটিই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আর একটি ভারতের বিরুদ্ধে। হালের মারকুটে ব্যাটাররা তো এক ম্যাচেই এর চেয়ে বেশি হাঁকান। তবুও বলতে হচ্ছে, ব্র্যাডম্যান তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতেন আধুনিক ক্রিকেটেও।
ক্রিকেটে সে যুগটা ছিল টাইমলেস টেস্টের। মানে ফল না আসা পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যেত খেলোয়াড়রা, ঢিমেতালে চলত খেলা। ব্যাটারদের ধৈর্যের চরম পরীক্ষা নিতেন বোলাররা। উইকেটে টিকে থেকে বিন্দু বিন্দু বালুকণার মতো রান জমিয়ে স্কোরকার্ড সমৃদ্ধ করাটাই ছিল দস্তুর।
কিন্তু ব্র্যাডম্যান তো আর বাকি সবার মতো নন, তিনি সবার চেয়ে আলাদা, সবার চেয়ে আগানো। হালের আক্রমণাত্মক মানসিকতার ‘বাজবল’ তো টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে ধারণাটাই বদলে দিচ্ছে। টি-টোয়েন্টিতে মারকাটারি ক্রিকেটের যুগে টেস্ট ক্রিকেট হারিয়ে ফেলেছে রং। দর্শকের রক্ত আর ব্যাকরণসিদ্ধ ব্যাটিংয়ে নাচে না। উদ্ভাবনী সব শটে চার-ছক্কার ফুলঝুরিই তাদের চাওয়া।
বাজবল এসে টেস্টেও সেই চাহিদা মেটাচ্ছে ক্রিকেটামোদীদের। ইংল্যান্ড এখন একদিনেই চারশো রান তুলছে। বেন স্টোকসের অভিধানে ড্র বলে কিছু নেই- হয় জয়, নয়তো হার। টেস্ট ক্রিকেটের সেই টাইমলেস যুগেই ব্র্যাডম্যান খেলতেন সময়ের চেয়ে আগানো ক্রিকেট। এই একুশ শতকেও টেস্টে তার মতো দ্রুত রান তুলতে পারাটা বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের জন্য স্বপ্ন।
বাজবল যুগের আগেই সেই ক্রিকেটের পথটা দেখিয়ে গেছেন এই মায়েস্ত্রো। ক্রিকেটের অভিজাত এই সংস্করণে ৫২ ম্যাচ খেলেছেন ব্রাডম্যান। ৮০ ইনিংসে সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৬৮৪টি বল মোকাবেলা করে ৬ হাজার ৯৯৬ রান করেছেন তিনি। সেই অতিমানবীয় ৯৯.৯৪ গড়ের পাশে ৭২ ছাড়ানো স্ট্রাইকরেটটার কথা ভাবুন একবার। টি-টোয়েন্টি আসার আগে ওয়ানডে ক্রিকেটেও কোনো ব্যাটারের এই স্ট্রাইকরেট থাকলে তাকে আক্রমণাত্মক ব্যাটারই বলা হতো।
টেস্টে লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরির রেকর্ড আছে ব্র্যাডম্যানের। তাও একবার নয়, একাধিকবার টেস্টে ব্যাট করতে নেমে লাঞ্চের আগেই সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন এই অজি গ্রেট। চোখ কপালে তোলার মতো খবর আছে আরও। দিন শেষের আগেই ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকানোর ঘটনাও আছে ব্র্যাডম্যানের। ১৯৩০ সালে অ্যাশেজে টেস্টের প্রথম দিনই ৩০৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। আজকের দিনেও এই কাণ্ড চোখ কপালে তোলার মতো। ট্রিপল সেঞ্চুরিই যেখানে বড় ঘটনা!
ব্র্যাডম্যান যদি আজকের ক্রিকেট খেলতেন বা তার যুগেও টি-টোয়েন্টি থাকতো তবে কি সফল হতেন? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। তবে যার ব্যাটিংয়ে দুর্বলতা নেই তার জন্য আসলে ব্যর্থ হওয়াটা কঠিন। এ ক্ষেত্রে বডিলাইন সিরিজকেই আমলে নেওয়া যাক। ১৯৩২-৩৩ অ্যাশেজে ব্র্যাডম্যানকে আটকাতে ইংলিশ ক্যাপ্টেন ডগলাস জার্ডিন বডিলাইন বোলিংয়ের পরিকল্পনা করেন। মূলত আগের আসরে লেগস্ট্যাম্পে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা বলে ব্র্যাডম্যানের অস্বস্তির কারণেই এই পরিকল্পনা। বডিলাইন সিরিজে অধিনায়কের তুরুপের তাস ছিলেন হ্যারল্ড লারউড, প্রাক্তন এই খনিশ্রমিক প্রচণ্ড গতিতে বল ছুড়তে পারতেন।
যাই হোক, সেই সিরিজ ইংল্যান্ড ৪-১ এ জেতে। ইংলিশরা ব্র্যাডম্যানকে বাঁধতেও সক্ষম হন। লারউড চারবার ব্র্যাডম্যানকে ড্রেসিংরুমে ফেরান। এতকিছুর পরও ব্র্যাডম্যানের ঐতিহাসিক ব্যর্থতার সিরিজে তার গড় ছিল ৫৬.৫৭! যা কুমার সাঙ্গাকারার ক্যারিয়ার গড়ের চেয়ে ১ কম এবং জ্যাক ক্যালিসের চেয়ে বেশি!
তাই তো ফুটবলে পেলে-ম্যারাডোনা-মেসির মধ্যে কে সেরা তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলে। টেনিসে কারও চোখে রোজার ফেদেরার সেরা তো কারও সেরা আবার নাদাল-জকোভিচ। সেরার বিতর্ক চলে মাইকেল ফেলপস বা মার্ক স্পিৎজকে নিয়েও। কিন্তু ক্রিকেটের বাইশ গজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান। তার মতো আর কেউই নেই। এতোটা দূরত্ব থাকে শুধু মানুষ আর নক্ষত্রের। ব্র্যাডম্যান তো ক্রিকেট নামের খেলাটার সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রই।