ম্যারাডোনা মেসিকে নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন- সে বার্সার হয়ে যেভাবে খেলে, সেভাবে দেশের হয়ে খেলে না। অধিনায়ক হিসেবেও অযোগ্য মনে করেছিলেন।
Published : 19 Dec 2022, 05:34 PM
বাংলা গান যারা শুনেন তারা কবীর সুমনের কণ্ঠে শুনে থাকবেন, ‘ডানপিটে লোকটাকে কারা কোন যুদ্ধে হারাবে?’ লড়াইটা সেই ছোট্ট বেলাতেই শুরু, নিজের শরীরের সঙ্গে। তারপর বিশ্বমঞ্চে বাঁ পায়ের যুদ্ধ। কিন্তু সেই ডানপিটে লোকটাকে কোন যুদ্ধে হারানো যায়নি।
টানা তিন ফাইনালে হার, ভেঙ্গে পড়ারই কথা। বারবার টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়, কিন্তু অধরাই থেকে যাচ্ছে স্বপ্নের ট্রফি। তবে হাল ছাড়েননি লিওনেল আন্দ্রেস মেসি; অভিমান ভেঙ্গে ফিরে এসেছেন জাতীয় দলে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পঙক্তি ‘তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি’ পাঠকের মনে স্মৃতি ও হাহাকার ছড়ালেও আর্জেন্টিনার ছত্রিশ বছরের খরা কাটালেন মেসি, দর্শক ও ভক্তদের বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দেওয়ার কথা রাখলেন তিনি।
আমার প্রথম বিশ্বকাপ দেখা ২০০২ সালে, নিতান্তই বয়স কম থাকায় রোনালদিনহো, জিদানকে ছাড়া আর কোন স্মৃতি মনে পড়ছে না। সেই বিশ্বকাপে মেসি ছিলেন না, আমারও কোন দল ছিল না। অবশ্য দল বোঝার বয়সই হয়নি তখন। পরের বিশ্বকাপে অভিষেক হলেও সেভাবে আলো ছড়ানোর সুযোগ আসেনি মেসির। আমাদের আগের প্রজন্মের নায়ক ম্যারাডোনা হলেও, চে গুয়েভারার জন্যই আর্জেন্টিনার প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল সেবার৷
‘পঁয়ত্রিশের বুড়ো’ কোন গানওয়ালার মতই সুরের অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে গেছেন বিশ্বকাপ জুড়ে৷ এ বয়সেও তিনি কি দুর্দান্ত খেলে যাচ্ছেন!
তবে ২০১০ বিশ্বকাপের আগেই মেসি মহাতারকা। তার ম্যাজিকে বিভোর বহু ফুটবলপ্রেমি। সঙ্গে কোচ ম্যারাডোনা৷ স্বাভাবিকভাবেই আর্জেন্টিনা ‘ফেভারিট’ দল। কিন্তু জার্মানির সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে স্বপ্নভঙ্গ। স্পেন চেয়েছিল মেসি তাদের হয়ে খেলুক। কিন্তু তিনি আন্তর্জাতিক মাঠে নেমেছিলেন নীল- সাদা জার্সি পরেই। যদি তার উল্টোটা করতেন, শিরোপার স্বাদ তিনি সেবারই পেতেন। আরেকটি বিশ্বকাপের অপেক্ষা করতে হতো না সোনালি ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখার।
আলবিসেলেস্তেদের ভরসার নায়ক হয়ে আবার একটি বিশ্বকাপ। এতদিনে তিনি অনেক অভিজ্ঞও। ৮ থেকে ৮০ বছর বয়সী সবাই মেসিতে মুগ্ধ। সেই বিশ্বকাপটি ছিল, আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের বছর। রমজান মাস তখন, তবুও সবার রাত জেগে খেলা দেখার ঝোঁক। ব্রাজিল- আর্জেন্টিনা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেই দ্বৈরথ সমর্থকদের মধ্যেও। তাই রাতের ম্যাচের আলোচনা, সমালোচনা, দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে চায়ের কাপেও।
সেই আঁচ আমার ক্লাসে এসেও লাগত। আমাদের যুক্তি-তর্কে এসে যোগ দিতেন আমিনুল ইসলাম স্যার, আর্জেন্টিনার কঠিন সমর্থক। বন্ধুর মতো ছাত্রদের সঙ্গে খেলার আলোচনা করলেও, তিনি লিওনেল স্কালোনির মতোই আমাদের সেরা একাদশ বেছে নিয়েছিলেন।
সেবার মেসি প্রায় একার প্রচেষ্টায় দলকে নিয়ে গেছেন ফাইনালে। সেই বিশ্বকাপেও জার্মানির কাছে হার। সেই ক্ষত আর্জেন্টিনার সমর্থকরা মনে হয় না সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলতে পেরেছে। তার চেয়ে বেশি কষ্ট নিশ্চয় মেসির হয়েছে, সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার আনতে যাওয়ার দৃশ্য দেখে কেউ বলবে না- সময়ের সেরা খেলোয়াড় হেঁটে যাচ্ছে, যেন নিষ্প্রভ এক প্রাণ।
সেই বিশ্বকাপ ছাড়াও আর্জেন্টিনার সামনে শিরোপা জেতার আরও দুটো সুযোগ এসেছিল। দুইবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে নীল-সাদার দল, কিন্তু কোনটাতেই সফল হলো না আলবিসেলেস্তারা। শিরোপা খরা দূর করতে না পারার কষ্টে অবসর নিলেন, অভিমান ভেঙ্গে ফের দলের হাল ধরেন মেসি।
২০১৮ সালে বিশ্বকাপ থেকে আবারো বিদায়, ফ্রান্সের কাছে হেরে। কিন্তু ২০২২ সালে টানা সাড়ে তিন বছর না হারা দলটি শক্তিশালীই ছিল। তবে শুরুর ম্যাচেই হোঁচট, সৌদি আরবের কাছে ৷ ফলে অগুনতি সমর্থকের কেউ কেউ হতাশ হলেও, বেশিরভাগই আশাবাদী ছিলেন বলা যায়। কারণ আর্জেন্টিনা সেদিন খারাপ খেলে হারেনি, যেটি ছিল আশার বাতি।
তবে অনেক ক্রীড়া বিশ্লেষকই হয়ত ভেবে বসেছিলেন, যে দল সৌদি আরবের মতো দলের সঙ্গে হারে সে দল টিকতে পারলেও বেশি দূর এগোতে পারবে না। কিন্তু আর্জেন্টিনা দেখিয়ে দিয়েছে, এভাবেও ফিরে আসা যায়! ‘পঁয়ত্রিশের বুড়ো’ কোন গানওয়ালার মতই সুরের অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে গেছেন বিশ্বকাপ জুড়ে৷ এই বয়সেও তিনি কি দুর্দান্ত খেলে যাচ্ছেন, যেটা তাজ্জব বনবার মতোই ঘটনা। কারণ জীবনের জন্য খুব বেশি না হলেও, ফুটবলের জন্য যে ৩৫ অনেক বড় সংখ্যা!
ম্যারাডোনা নেই, তবে না থেকেও সবকিছুতেই আছেন। হয়ত ‘এক আকাশের তারা’ হয়ে দেখছেন, আজকের আকাশটা শুধুই আর্জেন্টিনার।
মেসি না এলে ফুটবলের কী ক্ষতি হয়ে যেত- এটা কি প্রতিপক্ষও অস্বীকার করতে পারবে এবার? তিনি ফুটবল পায়ে একের পর এক মহাকাব্য রচনা করেছেন। এবারের বিশ্বকাপেও চোখ ধাঁধানো গোল করেছেন, করিয়েছেন৷ বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে করা অ্যাসিস্ট স্মরণীয় হয়ে থাকবে ফুটবলের ইতিহাসে, যেটি কবিতার মতোই সুন্দর৷ কোন প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা তার নিজের মানুষকে নির্দ্বিধায় বলতেই পারে- ‘তুমি মেসির অ্যাসিস্টের মতই সুন্দর’।
অবশেষে, জীবনের একমাত্র অপূর্ণতা ঘুচিয়ে নেওয়ার সুযোগ আরও একবার এলো তার সামনে; যেটি সমস্ত বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারে। বিশ্বকাপে জীবনের দ্বিতীয় ফাইনাল, মুখোমুখি ফ্রান্স। মেসিভক্ত হিসেবে এ কয়েকদিনের প্রার্থনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কেবল আর্জেন্টিনা কাপ জিতুক। সেই কাপ মেসির হাতে উঠে নিজের শোভা বাড়াক। যে লুসাইলে পঁচা শামুকে পা কেটেছিল, সেই লুসাইল স্টেডিয়ামেই নিজের মুকুটে আরও একটি সাফল্যের পালক লাগালেন মেসি।
সত্যিইতো লিওনেল স্কালোনির আর্জেন্টিনা হাল ছাড়েনি। ডানপিটে মেসি হেরে যায়নি। সমস্ত শিরোপা জিতে নিয়েছেন তিনি, তারপরও টিকে থাকবে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের বিতর্ক? উত্তরটা সময়ের কাছেই ছেড়ে দেওয়া যাক।
তবে যারা মেসিকে নিয়ে উদ্ভট মন্তব্য করেন, তারা খেলা না বুঝে থাকলে পড়ে নিতে পারেন রোজারিওর সেই ছোট্ট লিও মেসির ‘এলএম১০’ হয়ে উঠার রেকর্ডগুলো; বুঝবেন ও কত বড় মাপের একজন প্লেমেকার। সমালোচনা নেওয়া যায়, গালাগাল নয়।
আর্জেন্টিনার গ্যালারিতে দর্শক এতদিন সবচেয়ে বেশি মিস করেছেন যাকে তিনি হলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। স্কালোনি আর্জেন্টিনার কোচ হওয়ার পর তিনি সেটা মেনে নিতে পারেননি। মেসির এক সময়ের সতীর্থ লিওনেল স্কালোনির, খেলোয়াড় হিসেবে অবস্থান ছিল তলানির দিকে। তিনি এত সফল কোচ হবেন, সেটা ভাবনার উদ্বেগ ঘটাবে- সেটাই স্বাভাবিক। ম্যারাডোনা মেসিকে নিয়েও অভিযোগ করেছিলেন, সে বার্সার হয়ে যেভাবে খেলে; সেভাবে দেশের হয়ে খেলে না। অধিনায়ক হিসেবেও অযোগ্য মনে করেছিলেন।
বেঁচে থাকলে লিওনেল মেসি এবং লিওনেল স্কালোনিকে নিয়ে তার যে অভিযোগ কিংবা আক্ষেপ ছিল, তা নিশ্চয় তিনি উড়িয়ে দিয়ে তাদের ঝাপটে ধরতেন বুকে। তিনি নেই, তবে না থেকেও সবকিছুতেই আছেন। হয়ত ‘এক আকাশের তারা’ হয়ে দেখছেন, আজকের আকাশটা শুধুই আর্জেন্টিনার। তার উত্তরাধিকারী পেরেছে, উত্তর দায়িত্ব সামলাতে।
সবকিছুর পরও ফুটবলের অনুসারী হিসেবে লুকা মদ্রিচের মলিন মুখ, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নেইমার জুনিয়রের কান্না বিষাদের জন্ম দিয়েছে। আমাদের সময়কে রাঙানো এ তারকাদের হাতেও কাপ দেখতে চেয়েছিলাম, যদিও নেইমারকে নিয়তি আরেকটা সুযোগ দিতে পারে। আসলে বিশ্বকাপের ময়দান এক নিষ্ঠুর জায়গা, যেখানে সবার একসঙ্গে জেতা সম্ভব নয়। আর হ্যাঁ, আমাদের সৌভাগ্য- আমরা বেঁচেছিলাম লিও মেসির সময়ে।
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!