গল্পদাদু বন্দে আলী মিয়া

মেহেদী বাবু বন্দে আলী মিয়া। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর। তবে তার পরিচিতি মূলত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে। আরও স্পষ্ট করে বললে ছোটদের ‘গল্পদাদু’ হিসেবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2013, 08:41 AM
Updated : 23 July 2013, 08:50 AM

বন্দে আলী মিয়া। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর। তবে তার পরিচিতি মূলত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে। আরও স্পষ্ট করে বললে ছোটদের ‘গল্পদাদু’ হিসেবে।

আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠভরা ধান আর জলভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আমগাছ জামগাছ বাঁশঝাড় যেন,
মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।

খুব পরিচিত এই কবিতাটি লিখেছেন বন্দে আলী মিয়া। তার পরিচিতি মূলত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে। আরও স্পষ্ট করে বললে ছোটদের ‘গল্পদাদু’ হিসেবে। ২৭ জুন এই গল্পদাদুর মৃত্যুবার্ষিকী।

বন্দে আলী মিয়া ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর। তার সাহিত্যক্ষেত্রের বিচরণই শুধু এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল না, বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল তার পেশাগত জীবনও। তিনি শিক্ষকতা করেছেন, বেতারে কাজ করেছেন এমনকি নাটকেও কাজ করেছেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক হিসেবে। ছোটদের জন্য পাঁচটা-দশটা নয়, মোট বইয়ের সংখ্যা ১০৫। আর সে সময়ে ছোটদের জন্য লেখা তার ছড়া-কবিতাগুলো এখনও জনপ্রিয়। উপরের কবিতাটাই তো এর বড় প্রমাণ।

১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি, পাবনা জেলার রাধানগর। উমেদ আলী মিয়া ও নেকজান নেছার ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করে একটি শিশু। নাম রাখা হয় বন্দে আলী মিয়া। কবির শৈশব আর কৈশোরও কাটে রাধানগরেই।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কবি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন রাধানগর মজুমদার একাডেমি থেকে। এরপর ভর্তি হন কলকাতা আর্ট একাডেমিতে। ১৯২৭ সালে সেখান থেকে চিত্রকলায় ১ম বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

অবশ্য বন্দে আলী মিয়া তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পড়াশোনা শেষ করার আগেই। সাংবাদিক হিসেবে। ১৯২৫ সালে তিনি ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। পরে, ১৯৩০ সালে যোগ দেন কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে, সহকারী শিক্ষক হিসেবে। এখানে দীর্ঘ ২০ বছর চাকরি করে ১৯৫০ সালে অবসর গ্রহণ করেন বন্দে আলী মিয়া। ষাটের দশকে প্রথমে ঢাকা বেতারে ও পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেন।

পাশাপাশি কবি বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য পালাগান ও নাটিকাও রচনা করেন। সেগুলো রেকর্ড আকারে বের হলে বেশ জনপ্রিয়ও হয়।

এতকিছু করেও অবশ্য বন্দে আলী মিয়া খুব একটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখেননি। সত্যি বলতে কি, তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে দারিদ্র্যে। তাতে কী, কবি কিন্তু কখনও সাহিত্যচর্চায় আপোষ করেননি। লিখে গেছেন অবিরাম। লিখেছেন বাংলার জীবন ও প্রকৃতির রূপ নিয়ে। আর লিখেছেন ছোটদের নিয়ে, ছোটদের জন্য, ছোটদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।

কবি যখন বেতারে কাজ করতেন, তখন ছোটদের জন্য একটা অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন তিনি। নাম ছিল ‘সবুজ মেলা’। বেতারে ছোটদের জন্য আরও একটা অনুষ্ঠান হত তখন-- ‘ছেলে ঘুমাল’। সে অনুষ্ঠানের জন্য প্রায়ই নিত্যনতুন গল্প লিখে দিতেন তিনি। আর এসব করতে করতেই তিনি গল্পদাদু হয়ে গেলেন।

বন্দে আলী মিয়া সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শ’র মতো বই লিখেছেন। যার মধ্যে ১০৫টি বই-ই ছোটদের জন্য। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে-- ‘ময়নামতির চর’, ‘অরণ্য’, ‘গোধূলী’, ‘ঝড়ের সংকেত’, ‘নীড়ভ্রষ্ট’, ‘জীবনের দিনগুলো’, ‘অনুরাগ’। আর ছোটদের জন্য লেখা বইগুলোর মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল চোর জামাই, মেঘকুমারী,  মৃগপরী, বোকা জামাই, কামাল আতাতুর্ক, ডাইনি বউ, রূপকথা, কুঁচবরণ কন্যা, ছোটদের নজরুল, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা ইত্যাদি।

বন্দে আলী মিয়া সাহিত্যকীর্তির জন্য পুরস্কার-সম্মাননাও কম পাননি। শিশুসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে পান বাংলা একাডেমী পুরস্কার। ১৯৬৫ সালে পান প্রেসিডেন্ট পদক। মৃত্যুর পরও তিনি পেয়েছেন দুটো মরণোত্তর পদক-- ১৯৮৮ সালে একুশে পদক, ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা পদক।

বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম/বাবু/এনজে/সাগর/আরএস/ জুন