রাসেল রায়হানের গল্প: কিচির মিচির

কিচির আর মিচির দুটি চড়াই পাখি। একটি ভাঙাচোরা ঘরের ঘুলঘুলিতে তারা থাকে।

রাসেল রায়হানরাসেল রায়হান
Published : 9 March 2024, 03:23 PM
Updated : 9 March 2024, 03:23 PM

কিচির আর মিচির দুটি চড়াই পাখি। একটি ভাঙাচোরা ঘরের ঘুলঘুলিতে তারা থাকে। ঘরটা খুব ভালো। কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই। নিজেদের মতো থাকা যায়। খুব সুখে দিন কাটাচ্ছে তারা।

হঠাৎ একটা সাপ সেই সুখে হানা দিল। মাটিতে বড় একটা গর্ত ছিল, ইঁদুরের, থাকতে শুরু করল সেখানে এসে। সবার আগে গর্তে বাস করা ইঁদুরগুলোকে খেয়ে নিল টপাটপ। এটা দেখে খুব ভয় পেয়ে গেল মিচির। ইঁদুরগুলো সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল খুব। মাঝেমধ্যেই গল্পগুজব করত।

অবশ্য ইঁদুরগুলোর বেশি খাতির ছিল কিচিরের সাথে। কিচিরের কাছ থেকেই ইঁদুরের ভাষা শিখেছে মিচির। কিচির ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে। অনেক জীবের ভাষা সে জানে। একটু চাইলেই বুঝতে পারে যে কারও ভাষা। সে বলে, সবারই কথা বলার একটা প্যাটার্ন আছে। একটু খেয়াল করলেই সেটা বোঝা যায়। তখন আর কষ্ট হয় না ভাষা বুঝতে। তুমিও চাইলে বুঝতে পারবে। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।

সমস্যা হলো, কিচিরটা বড় অলস। কোনো পরিশ্রম করতে চায় না। শারীরিক পরিশ্রম তো না-ই, মাথার পরিশ্রমও না। সে শুধু ঘুমাতে চায়, আর মিচিরের সাথে গল্পগুজব করতে চায়। এজন্যই ভালো কোনো চাকরি পর্যন্ত পেল না। কিচিরের চাকরি না পাওয়া নিয়ে অবশ্য মিচিরের কোনো আক্ষেপ নেই। দিনে সামান্য খাবার লাগে দুজনের। একসাথে মিলেই সেটুকু জোগাড় করে ফেলতে পারে তারা। কিচিরকে পাশে পাওয়া যায় সব সময়। এতেই মিচির অনেক খুশি।

সেদিন দুপুরে একা ঘরে ছিল মিচির। কিচির গেছে খাবার আনতে। কী ভেবে নিচে তাকিয়েছিল মিচির। দেখে, সাপটা কেমন বাজেভাবে তাকিয়ে আছে তাদের বাসার দিকে। মিচির বুঝে গেল, এর উদ্দেশ্য ভালো নয় মোটেই। কিচির ফেরার সাথে সাথেই তাকে বলল, চলো, আমরা অন্য কোথাও যাই। সাপটা কেমন কেমন করে তাকায়। খুব ভয় লাগে আমার। কিচির হো হো করে হাসতে থাকে। বলে, তুমি বড় ভিতু। সাপ কি আর এত ওপরে উঠতে পারবে? মিচির বলে, পারবে পারবে। ওরা

সব পারে। তবু কিচির নড়তে চায় না। অলস সে। এক জায়গায় থাকলে আর নড়তে চায় না। মিচির বারবার একই কথা বলতে থাকে তাকে। শুনেও না শোনার ভান ধরে কিচির উড়ে যায় অন্য কোথাও।

মিচির বলে, তুমি শুধু শুধু মানুষকে ভয় পাও। মানুষ খুব ভালো জীব। কিচির বলে, ছাই ভালো!

দুই

কদিন ধরে কিছুই ভাল্লাগছে না মিচিরের। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে কার ভালো লাগে! তাছাড়া তার ডিম পাড়ার সময় হয়ে এসেছে। এখন তো এই সাপ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে। নিজের জন্য না ভাবলেও চলবে। কিন্তু আসন্ন বাচ্চাদের কথা ভেবে তার উৎকণ্ঠা বেড়েই চলে। আবার একদিন কিচিরকে সে বলে, কিচির, আর নাহ! সাপটা খুব বাজেভাবে তাকায় আমাদের দিকে। তুমি তো খেয়ালই করো না একদম।

এই অবস্থায় শান্তিমতো ডিমও পাড়তে পারব না আমি। ডিমে তা দিতে পারব না। এমন মানসিক অশান্তিতে থাকলে আমার বাচ্চারাও অসুস্থ হবে। তুমি কি তা-ই চাও? এতদিন কিচিরকে সে বলেনি ডিম পাড়ার কথা। এটা শুনে খুব খুশি হয় কিচির। আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে থাকে সে। দুই পা দিয়ে তিড়িং বিড়িং নাচ। নাচে আর বলে, আমি বাবা হব। আমি বাবা হব। মিচির তাকে কপট ধমক দেয়। বলে, আগে বাসা পাল্টাও। নইলে আমি কিন্তু ডিম পাড়ব না।

এবার কিচিরও একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। মিচিরের জেদ সম্পর্কে সে জানে। মিচির যদি একবার বেঁকে বসে, পেট ফেটে গেলেও সে ডিম পাড়বে না। তাছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে তার দুশ্চিন্তাও অমূলক নয়। সে মিচিরকে বলে, তুমি তো জানোই, এই বাড়িতে কোনো মানুষ থাকে না বলেই আমরা বেশি নিরাপদ। মানুষ ভয়ানক জীব।

মিচির বলে, তুমি শুধু শুধু মানুষকে ভয় পাও। মানুষ খুব ভালো জীব। কিচির বলে, ছাই ভালো! মিচির অবাক হয়ে যায়। বলে, কী বলো! তুমিই না বলেছিলে, মানুষ খুব ভালো জীব। তারা আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি। এখন এসব বলছ কেন? কিচির ডান পায়ের নখ দিয়ে মাথা চুলকায়। বলে, বলেছিলাম নাকি? মিচির মনে করিয়ে দেয়, হ্যাঁ। ওহ। কিন্তু মানুষগুলো নিয়ে আমার আসলে একটু ঝামেলা হয়। একশজনে দুজন মানুষ হয়তো খারাপ। সমস্যা হলো, মানুষদের সবার চেহারা কেমন এক রকম। প্রত্যেকের এক রকম বড় বড় চোখ, একরকম উঁচু উঁচু নাক, এক রকম চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা কান, লম্বা লম্বা হাত-পা, একই রকম শরীরের রং, সবকিছু এক। আমি তো ওদের একদম আলাদা করতে পারি না। কে যে খারাপ কে যে ভালো, যদি আলাদাই না করতে পারি, তাহলে সাবধান থাকব কী করে?

একনাগাড়ে এত কথা বলে কিচির কেমন হাঁপিয়ে যায়। তারপর মিচিরের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমিই বলো, এটা সমস্যা না? এর চেয়ে একটা সাপ সামলানো আরও সহজ। কী বলো? মিচির কিছু বলতে পারে না। তারপর কী ভেবে সে বলে, কিন্তু অনেক মানুষ আছে বড়, অনেক মানুষ ছোট। কিচির তাকে ধমক দেয়, কী সব বোকার মতো কথা বলো। কোটি কোটি ছোট মানুষ আছে, কোটি কোটি বড় মানুষ আছে।

ধমক খেয়েও এবার আর চুপ করে না মিচির। সে বলে, কই, আমাদেরও তো একই রকম ছোট ছোট চোখ, সুচালো সুচালো ঠোঁট, ঠোঁটের ওপর ছিদ্র ছিদ্র নাক, চিকন চিকন পা, একই রকম শরীরের রং, সবকিছু এক। তবু আমরা আমাদের সবাইকে চিনি কীভাবে? কিচির বলে, তোমার তো দিনদিন বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। আমরা সবাই কীভাবে একরকম? আমাদের সবার আলাদা আলাদা চেহারা। আমরা কেন আমাদের চিনব না? তখন মিচির বলে, তার মানে ওদেরও সবার চেহারা আলাদা। ওরাও ওদের চেনে। দেখো না কেমন তিন-চারজন একসাথে থাকে সব সময়। না চিনলে তো যে যার মতো যেকোনো ঘরে এসে থাকত। একেক দিন একেকজনের সাথে ঘুরত। কিন্তু দেখো, এরা সবাই কেমন একদল হয়ে ঘোরে।

গভীর সমস্যায় পড়ে যায় কিচির। সে একটা মানুষ থেকে অন্য মানুষ আলাদা করতে পারে না- এটা সত্যি। কিন্তু মিচিরের যুক্তিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার মনে হতে থাকে, মিচির সত্যি কথাই বলেছে। এখন থেকে সে মানুষকে আরও গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করবে বলে ঠিক করে। নিশ্চয়ই কোনো একটা ব্যাপার আছে মানুষের মধ্যে, যেটা দেখে অন্য মানুষরা বুঝতে পারে, কে কোন দলের? তারপর কিচির আরও ভাবে, সেসব নাহয় পরে দেখা যাবে। কিন্তু নতুন ঘরের কী হবে! মিচির যখন বলেছে তখন ঘর তো তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

পরদিন খুব ভোরে, সূর্যটা যখন মাত্র উঁকি দেবে দেবে করছে, কিচির দেখে, মিচির গাঢ়ভাবে ঘুমিয়ে আছে। ঘুলঘুলিতে থাকা খড়কুটোগুলো সে একটা নির্দিষ্ট ধরনে সাজায়। এটাই তাদের লেখার প্রক্রিয়া। মিচির যখন এটা দেখবে, সে বুঝতে পারবে যে কিচির বলে গেছে:

মিচির,

আমি চললাম। যেদিন তোমার জন্য সুন্দর একটা ঘুলঘুলি খুঁজে আনতে পারব, সেদিনই  ফিরব এখানে। এই কদিন সতর্ক থেকো। বাসা ছেড়ে যেয়ো না কোথাও। তোমার জন্য পাশের ঘুলঘুলিতে অনেক খাবার রাখা আছে। ঠিকমতো খেয়ো।

ইতি

তোমার কিচির। 

তোমার জন্য খুব ভালো একটা বাসা খুঁজে এনেছি আমি। একতলা সাদা বাড়িটা। সেখানে চকচকে নতুন একটা ঘুলঘুলি আছে। আমাদের দুজনের থাকার জন্য খুব ভালো হবে ওটা।

তিন

ঠিক চারদিন পর উড়তে উড়তে এসে মিচিরের পাশে বসে কিচির। দেখে, খুব মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়ে পাখিটা। উদাস। কিচিরকে দেখেই আনন্দে লাফিয়ে ওঠে সে। চিৎকার করে বলে, তুমি এসেছ? আমাকে না বলে কেন চলে গেলে? আর কখনো যাবে না, প্লিজ। তোমার কাছে আর কিছু চাইব না কখনো। আমার পুরোনো বাড়িতেই হয়ে যাবে। কিচির তার মাথায় পা বুলিয়ে দেয়। বলে, আহা, অমন কাঁদছ কেন? তোমার জন্য খুব ভালো একটা বাসা খুঁজে এনেছি আমি। একতলা সাদা বাড়িটা। সেখানে চকচকে নতুন একটা ঘুলঘুলি আছে। আমাদের দুজনের থাকার জন্য খুব ভালো হবে ওটা।

মিচির তাকে থামিয়ে দেয়। বলে, আমার আর অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। এই যে চারদিন তুমি ছিলে না, তবু আমি একা একা থাকতে পেরেছি। সবকিছু চেনা আমার। নতুন বাসায় একদম থাকতে পারব না। কিচির অবাক হয়ে বলে, তাহলে? এত কষ্ট করে তোমার জন্য সুন্দর একটা বাসা ঠিক করে আনলাম! তাছাড়া ওই বাসায় সাপের কোনো ভয় নেই। মিচির বলে, থাক। আমরা এখানেই থাকব। একটা কাজ করবে? কিচির জিজ্ঞেস করে, কী কাজ? মিচির বলে, তুমি সাপটার সঙ্গে কথা বলো। একটু বুঝিয়ে বলো, সে যেন অন্য কোথাও চলে যায়।

হাসতে হাসতে কিচির বলে, সাপ তো কথা বলতে পারে না। মিচির খুব অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে, তাহলে? ওরা একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে? কিচির হতাশ ভঙ্গিতে বলে, আমি ঠিক জানি না। এই নিয়ে আমাদের বিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা করছেন। জিরাফও কথা বলে না। জিরাফ নিয়েও গবেষণা করছেন তারা। মিচির বিরক্ত হয়। বলে, এর মধ্যে আবার জিরাফ এল কোত্থেকে? তুমি সাপ তাড়ানোর ব্যবস্থা করো। কিচির বলে, একটা বুদ্ধি আছে। মিচির উৎসাহী হয়ে ওঠে। আনন্দে লাফাতে লাফাতে বলে, কী বুদ্ধি? কী বুদ্ধি? কিচির বলে, যে বাড়িটা আমি তোমার জন্য ঠিক করেছিলাম, সে বাড়িতে একটা বাচ্চা মানুষ আছে। সে তার বই থেকে একটা গল্প পড়ছিল। ঈশপ নামের এক লোকের গল্প। মিচির বলে, ঈশপ কে? কিচির বিরক্ত হয়। বলে, ঈশপ কে, তা দিয়ে তুমি কী করবে? সাপ মারার গল্প শোনো। একদিন একটা সাপ এক...

মিচির থামিয়ে দেয় তাকে। বলে, না ওই গল্প শুনব না। কিচির বিরক্ত হয়। অবাকও হয়। জিজ্ঞেস করে, কেন? মিচির বলে, তুমি যে বললে, সাপ মারার গল্প। কিচির বলে, হ্যাঁ। কী হয়েছে তাতে? নরম গলায় মিচির বলে, আমি কাউকে মারতে চাই না। তুমি সাপ তাড়ানোর কোনো গল্প জানলে বলো? সাপ মারার গল্প না। ঈশপ নামের ওই ভদ্রলোক সাপ তাড়ানোর কোনো গল্প লেখেননি? কিচির মাথা চুলকে বলে,

তেমন কোনো গল্প তো পড়তে শুনলাম না বাচ্চা মানুষটাকে। তবে তোমাকে যে বললাম, ওই বাসায় সাপের কোনো ভয় নেই, কেন বলো তো? মিচির জানতে চায়, কেন? কিচির বলে, বাচ্চা মানুষটার মা-ও সাপ খুব ভয় পায়। সে বাচ্চাটার বাবাকে বলছিল, বাসায় আসার সময় যেন কার্বলিক অ্যাসিড নিয়ে আসে। সেটা ছিটালে নাকি ঘরে সাপ আসে না। মিচির কৌতূহলে ফেটে পড়ে, আনল? কার্বলিক অ্যাসিড কী জিনিস? কিচির বিরক্ত হয়। বলে, কার্বলিক অ্যাসিড কী জিনিস, আমি কি জানি নাকি? তাছাড়া বাচ্চা মানুষের বাবাটা কার্বলিক অ্যাসিড আনেইনি। দোকানে নাকি পাওয়া যায়নি।

মিচিরের মুখ শুকিয়ে যায়। তাহলে? কিচির বলে, সালফারের গুঁড়া নিয়ে এসেছে। এনে সারা ঘরে ছিটিয়ে দিল। মিচির জানতে চায়, সালফারের গুঁড়া কী? কিচির আবার বিরক্ত হয়। বলে, আহা! আমি কি চিনি নাকি সালফারের গুঁড়া? দেখলাম কাগজে করে আনল। ঘরে ছিটিয়ে আবার রেখে দিয়েছে আলমারির ওপরে। মিচির বলে, তুমি এক কাজ করো না, সালফারের গুঁড়া নিয়ে আসো খানিকটা। কিচির বলে, খানিকটা কী করে আনব? পুরো কাগজটা নিয়ে আসতে হবে। আমি একা পারব না। মিচির বলে, তাহলে? কিচির বলে, তোমাকেও যেতে হবে আমার সাথে। দুজন মিলে নিয়ে আসব।মিচির বলল, চলো তাহলে। এখনই যাই। কিচির বাধা দিল তাকে। না, রাতে যাব।

চার

অবশেষে কিচির আর মিচির দুই চড়াই মিলে সেই নতুন বাড়িতে গেল। তারপর কাগজের প্যাকেটের দুই দিক ঠোঁটে ধরে নিজেদের বাসায় নিয়ে এল। কাগজে মোড়ানো অনেকটা সালফারের গুঁড়া। তার সবটাই ঢেলে দিল সাপের সেই গর্তের চারপাশে। তারপর? তারপর আর কী? সাপটাকে আর কোনোদিন দেখা যায়নি কিচির মিচিরের ডেরায়। মিচির ডিম পেড়েছে অনেকগুলো। এখন সে ডিমে তা দিচ্ছে। কিচিরও গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বাচ্চা ফোটার।