স্কুলের মাঝখানে ফাঁকা, কিন্তু একটা নারকেল গাছ দাঁড়ানো খুব লম্বা! পশ্চিমপাশে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ইট বিছানো রাস্তা রামপাল থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত গিয়েছে। সেখানে দু'একটা সাইকেল চলে।
Published : 17 Sep 2022, 11:02 AM
বাগেরহাটের রামপাল থানার ভাগা, মালীডাঙ্গা এবং বেতকাটা পাশাপাশি তিনটি গ্রাম। তিন গ্রামের চার বন্ধু ছিলেন। সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পর এলাকার পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন খারাপ, তখন তারা পড়াশোনা করার জন্য চলে গেলেন কলকাতা।
‘চলে গেলেন’ খুব সহজে বলেছি, কিন্তু বাস্তবে তা ছিল প্রায় কল্পনাতীত! কারণ ওই সময় ওরকম অজপাড়াগাঁ থেকে কেউ কলকাতায় পড়তে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতো না। কারণ লেখাপড়া করার প্রয়োজন আছে এটাই জানতো না তাদের মা-বাবা।
বন্ধুদের একজন রসিকলাল সরকার। ভাগা বাসস্ট্যান্ডের পাশেই বাড়ি। তিনি দুই বাংলার প্রথম সারির বিখ্যাত কবিয়াল। দ্বিতীয়জন আমার একমাত্র মামা কালিপদ বিশ্বাস মালীডাঙ্গা গ্রামের। তিনি কলকাতায় পড়াশোনা করে আর দেশে ফেরেননি। পশ্চিমবাংলার রেলের পদস্থ অফিসার হয়েছিলেন।
তৃতীয়জনও আমার মামা এবং একই বাড়ির নিশিকান্ত বিশ্বাস। কলকাতার নীলরতন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে বিখ্যাত চিকিৎসক হয়েছিলেন। শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা রেখেছেন রাজেন্দ্রনাথ পাল। তিনি ১৯৩৬ সালে বেতকাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এলাকার বিখ্যাত রাধাকান্ত পাল। তিনি রাধা কবিরাজ নামে সুপরিচিত ছিলেন।
আমার সহপাঠী ছেলেমেয়ে কারও গায়ে জামা নেই। দু’একজনের গায়ে ছেঁড়া-ময়লা গেঞ্জি, তার আসল রঙ বোঝা যায় না। প্যান্ট পরা কেউ ছিল মনে পড়ে না।
লেখাপড়া করে রাজেন্দ্রনাথ পাল দেশে ফিরে আসেন এবং শিক্ষাবিস্তারের জন্য নিজের গ্রামে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বেতকাটা ফ্রি প্রাইমারি স্কুল'। স্কুল প্রতিষ্ঠা করা মুখের কথা নয়; অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে, নিজের টাকা খরচ করে, রাতদিন পরিশ্রম করার পর তবেই তৈরি হয় একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
মালীডাঙ্গা গ্রামে আমার মামাবাড়ি এবং আমাদের জন্ম সেখানে। বাবাকে শ্বশুরবাড়ি থাকতে হয় ফলে আমি ওই বেতকাটা ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রথম বাদ দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলাম ১৯৬৯ সালে। তখন সেখানে জুনিয়র হাই স্কুলও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরে আমি নিজবাড়ি মোংলার কাইনমারী গ্রামে থেকে বিখ্যাত সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। কিন্তু স্মৃতি বললে ওই বেতকাটা স্কুলই প্রথম মনে আসে।
খোলা একটা বড়ভিটের চারপাশে বড় বড় তেঁতুল, জাম, নারকেল ইত্যাদি গাছ। তার উত্তর পাশে দক্ষিণমুখো এবং পূর্বপাশে পশ্চিমমুখো লম্বা দুটো ঘর। দুই ঘরের মাঝখানে ভিটের কোণের দিকে আমাদের ক্লাস হতো গাছতলায়। স্কুলের মাঝখানে ফাঁকা, কিন্তু একটা নারকেল গাছ দাঁড়ানো খুব লম্বা! পশ্চিমপাশে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ইট বিছানো রাস্তা রামপাল থেকে বাগেরহাট পর্যন্ত গিয়েছে। সেখানে দুই-একটা সাইকেল চলে। কদাচিৎ একটা মোটরসাইকেল গেলে শিক্ষকের হম্বিতম্বি উপেক্ষা করে দলবেঁধে দৌড়ে চলে যাই তা দেখতে। যতক্ষণ দেখা যায়, দাঁড়িয়ে থেকে দেখি। পেট্রোলপোড়া গন্ধ অদ্ভুত একটা নতুনত্ব দিয়ে যায়। আরোহী এক বা দুজনকে মনে হয় ভিন্নগ্রহের!
আমাদের বসার জন্য লম্বা দুটো তক্তা আছে। সেখানে অভিজাত ঘরের ছেলে-মেয়েরা বসার সুযোগ পায়। বাকিরা মাটিতে বা নিজেদের নিয়ে আসা তালপাতার চাটকোল-এ বসে। আমার সহপাঠী ছেলেমেয়ে কারও গায়ে জামা নেই। দু’একজনের গায়ে ছেঁড়া-ময়লা গেঞ্জি, তার আসল রঙ বোঝা যায় না। প্যান্ট পরা কেউ ছিল মনে পড়ে না। একটা ময়লা চাদর বা গামছা মালকোঁছা দিয়ে পরা ছেলেদের, মেয়েদের ঘটিপ্যান্ট, কিন্তু তাতে দড়ি নেই। গামছার মতো প্যাঁচ দিয়ে পরা।
টিফিনের সময় বলতে আমরা খেলাধুলা বুঝতাম। খাওয়ার জন্য বিরতি হয় তা জেনেছি বহু পরে। কিন্তু এলাকায় একমাত্র কাঙালের দোকানে আমরা যেতাম এবং চানাচুর, লজেন্স, চিনাবাদাম কিনতাম।
লেখাপড়ার জন্য তালপাতা, কঞ্চির কলম এবং বাড়িতে কাঠ-কয়লা ঘষে বানানো কালি। সম্ভবত আমারই একখানা শ্লেট ছিল যাতে চক দিয়ে লিখতাম। শিক্ষক ছিলেন খুবই বৃদ্ধ এবং রাগী। মারামারি, স্কুলে না আসা এবং ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পালানোর মতো নানান অপকর্ম আর লেখাপড়া না করার বিচার করতে করতেই শিক্ষকের সময় চলে যেতো। শুরু সকালে হলেও অনেকে স্কুলে এসে উপস্থিত হতো দুপুরে বা ছুটির একটু আগে। শিক্ষক রেগে বলতেন, এই দেরি কেন?
- ছার, গরুরে ঘাস খায়াতি গেইলাম।
এরকম আরও অজুহাত ছিল- মাছ ধরতে যাওয়া, বিক্রির জন্য হাড়ি-পাতিল বাবার কাছে হাটে পৌঁছে দেওয়া, ছোট ভাই বা বোনকে রাখা অর্থাৎ দেখাশোনা করা, পরিধান করে আসার জন্য চাদর বা গামছা ধুয়ে দেওয়া ইত্যাদি। চিত্ত নামে একজন ছিল খুব লম্বা সাদাসিধে অনুগত ছাত্র যে একদিন ভিজে চাদর পরে চলে এসেছে স্কুলে, কারণ আর কিছু ছিল না পরার! শিক্ষক তাকে ছুটি দিয়ে দেন।
আমার পরিচ্ছন্নতা এবং পায়ে চটি ছিল বলে তিনি আমাকে গোত্রহীন মনে করতেন। পছন্দও করতেন না। দিনেরবেলা পায়ে জুতো বা চটি থাকায় বন্ধুরা আমাকে বলতো ‘দুফরে বাবু।’ আরও একটা পার্থক্য ছিল- আমার বাড়ি মোংলায় এবং আমি সবার মতো পাল সম্প্রদায়ের নই! বেতকাটা গ্রামের সব পরিবার কুমোর বা পাল সম্প্রদায়ের। ফলে অঘোষিত কিছু বিভেদ যে থাকে, সেই বয়সে তা বুঝতে পেরে গেছি।
টিফিনের সময় বলতে আমরা খেলাধুলা বুঝতাম। খাওয়ার জন্য বিরতি হয় তা জেনেছি বহু পরে। কিন্তু এলাকায় একমাত্র কাঙালের দোকানে আমরা যেতাম এবং চানাচুর, লজেন্স, চিনাবাদাম কিনতাম। বহু পুরনো এই দোকানের চৌকাঠ-বেড়ায় তেলের কালো আবরণ পড়েছিল। কেরোসিন এবং সরিষার তেলের একটা মিশেলে পচা গন্ধ বের হতো। কিন্তু চানাচুর ছিল অপূর্ব! সেইসময় প্লাস্টিকের মোড়ক প্রথম দেখলাম। ছোট লম্বা একটা প্যাকেটে খাঁটি ঘিয়েভাজা চানাচুর এলো যার স্বাদ এখনও চোখ বুজলে অনুভব করি। আমরা বলতাম, বস্তার চানাচুর দাও। দাম ছিল এক আনা। চিনাবাদাম দিতো শটি বা কাঠবাদামের পাতায়।
কাঙালের দোকানের কাছে রাস্তার দুপাশে দাঁতন, শটি এবং নানান আগাছা ছিল। তার মধ্যে একখানা মসলাবাটা শিল উলটো করে পোতা দেখতাম যেটা ছিল মাইলস্টোন। ওটা তো জানতাম না কী! পরে যখন পড়লাম বিদ্যাসাগর ওরকম মাইলস্টোনে ইংরেজিতে লেখা ১-২ থেকে অংক শিখেছেন তখন ভীষণ কৌতুহল নিয়ে দেখতাম ওটা। বাবার সঙ্গে হাটে যেতে এবং স্কুলে গিয়ে বহুবার ওই মাইলস্টোনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম আর দেখতাম! সেই বিস্ময় আমার এখনও কাটে না।
সরস্বতী পূজায় অঞ্জলি দিতে বই-খাতার সঙ্গে নিতে হবে হারমোনিয়াম-তবলা। কেউ যে বয়ে নেবে তা না, আমাকে মাথায় করে হারমোনিয়াম নিতে হবে সবার সামনে আর তবলা অন্য কেউ।
আমাদের মূল পড়াশোনা ছিল বাড়িতে। গৃহশিক্ষক ছিলেন, দাদা-দিদি, মা-বাবা যখন খুশি পড়াতেন। ফলে স্কুলে নিয়মিত হইনি এবং বিষয়ভিত্তিক শেখার সমন্বয় ছিল না। এর ফলে বাংলা লেখাপড়ায় যতটা পাকা হলাম অংক-ইংরেজিতে ঠিক ততটাই থাকলাম দুর্বল। ওই অবস্থায় পরের বছর তৃতীয় শ্রেণিতে উঠলাম এবং ঘরে ঠাঁই হলো। আমাদের শ্রেণিটা পূর্বপাশে পশ্চিমমুখো ঘরের দ্বিতীয় কক্ষে। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন বিমলকৃষ্ণ পাল, নির্মল বাবু, শাহজাহান আলী, লেফাজ স্যার প্রমুখ। অনেকের নাম মনে নেই।
একজন ছিলেন অল্প বয়সের সুন্দর চেহারার; কাছে ডেকে মুখ খুলে জোরে হা হা করতে বলতেন, বিড়ি টেনেছি কিনা পরীক্ষা করতেন নিয়মিত। শিক্ষকবৃন্দ ধুতি এবং লুঙ্গি পরে আসতেন স্কুলে। ছাত্রদের তখন গর্ব করার পোশাক ছিল ক্যারোলিনের জামা। এই সময় আমার সহপাঠী ছিল লিভা, বীথি, রণজিৎ, শুধাংসু, নূরুল ইসলাম, নমিতা, বিষ্ণু, রমেশ, রবীন, মায়া আরও অনেকে। তারা আমাকে মনে রেখেছে কিনা জানি না, কিন্তু আমি তাদের কখনও ভুলতে পারি না! সব সময় তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু মনে হয় আজও!
আমি তখন গান শেখা শুরু করেছি। আমার গুরু মোংলার মাখনলাল বিশ্বাস নামকরা ওস্তাদ ভাড়–বাবুর ঘরানায় দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং তাল-মানে ছিলেন দক্ষ। সবে সা-রে-গা-মা শিখছি এবং তবলায় বাজাতে পারি দাদরা-কাহারবা, একতাল ইত্যাদি। বাবা আমাদের নিয়ে একটু অতিরিক্ত আবেগে ভোগে। এলাকায় সংগীতের কেউ বেশি কিছু জানে না, এটা একটা সুযোগ। ফলে সরস্বতী পূজায় অঞ্জলি দিতে বই-খাতার সঙ্গে নিতে হবে হারমোনিয়াম-তবলা। কেউ যে বয়ে নেবে তা না, আমাকে মাথায় করে হারমোনিয়াম নিতে হবে সবার সামনে আর তবলা অন্য কেউ। বাবার কড়া শাসন ছিল, ফলে লজ্জা-কষ্টে মরমে মরে গেলেও কিছু বলতে বা আপত্তি করতে পারলাম না।
পুজোর দিন সকালে শুভ্রবসনে মনের দুঃখ মনে চেপে হারমোনিয়াম মাথায় নিয়ে চলেছি স্কুলে। বাবা গদগদ চিত্তে আমার পেছনে চলেছে আরও কয়েকজন সঙ্গে নিয়ে। স্কুলের কাছে গেলে সে এক এলাহি কাণ্ড শুরু হলো! সবাই দলবেঁধে ঘিরে ধরলো আমাদের আর উৎসাহ নিয়ে নিজেদের মতো মন্তব্য করে চললো অবিরাম। তাতে আমার লজ্জা সামান্য কমে গেল আর সবার সঙ্গে বসে অঞ্জলি দিলাম। বিড়ম্বনা দেখা দিল যখন শিক্ষকরা গান শুনতে চাইলেন। তারা উৎসাহ নিয়ে কী করবেন, কোথায় শুনবেন, তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন খুব। পরে আমার ক্লাসরুমে ঠিক হলো আসর আর আমি একেবারে শামুকের মতো খোলে ঢুকে গিয়ে চোখ বন্ধ করে শুধু সা- রে-গা-মা, সারেগা, রেগামা বা সাগা, রেমা, গাপা বাজিয়ে গলাসাধার মতো গাইলাম জড়তাভরা গলায়।
পরের দিন স্কুলে যাইনি। কতদিন পরে গেলাম মনে পড়ে না কিন্তু যেদিন গেলাম আমাকে কেউ চিনতে পারলো না! চোখ গোল গোল করে তাকালো সবাই একটু দূর থেকে।
তখন হাতির ইঁদুরবাচ্চা প্রসবের মতো একটা আশাভঙ্গের হতাশার রব শুনতে পেলাম শিক্ষকদের মুখে। চেয়ে দেখার শক্তি নেই! বন্ধুরা চারপাশে বসে আছে, তাদের দিকেও দেখতে পারছি না। আসলে চোখে অন্ধকার দেখছি তখন। তারা কেউ কিছু বলছে না, কিন্তু বুঝতেও পারছে না আমি কী করছি। এটা কী গান না-কী আর কিছু মহান বা অভিনব কোনো কসরত!
পরের দিন স্কুলে যাইনি। কতদিন পরে গেলাম মনে পড়ে না কিন্তু যেদিন গেলাম আমাকে কেউ চিনতে পারলো না! চোখ গোল গোল করে তাকালো সবাই একটু দূর থেকে। যারা বেশি ডেঁপো তারা নিজেদের বেড়ার এবং গাছের আড়ালে রেখে বলে উঠলো ‘পাদা পাদা, নিদা নিদা’। কেউ তো মনে রাখেনি সারেগামাপাধানিসা। তাই যা মনে আসে তাই বলে আমাকে ক্ষেপাতে শুরু করলো। অন্য কেউ বললো, ‘গা-দা-নি পা-দা-নি!’ তার সঙ্গে সে কী কেঁপে কেঁপে ওঠার অট্টহাসি!
কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!