‘একটা ভালো বই সবচেয়ে দামি উপহার’

‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কথাসাহিত্যিক মৌলি আজাদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।

কিডজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2023, 06:49 PM
Updated : 13 Feb 2023, 06:49 PM

মৌলি আজাদ কথাসাহিত্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উপ-পরিচালক। প্রকাশিত বই: ‘হুমায়ুন আজাদ আমার বাবা’ (স্মৃতিকথা), ‘রূপালি জোছনায় ভেজা জীবন’ (গল্প), ‘রক্তজবাদের কেউ ভালোবাসেনি’ (গল্প), ‘বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে’ (শিশুসাহিত্য), ‘প্রিয়ানা, চোখ ও ঝরনার জলে স্নাত এক প্রপাতের ফোয়ারা’ (উপন্যাস) ও ‘যেখানে জীবন সেখানেই আইন’ (আইন)। তিনি কবি হুমায়ুন আজাদের বড় মেয়ে।

অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনিয়েছেন মৌলি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।

বইমেলায় এসে কেমন লাগছে? অটোগ্রাফের জন্য যখন কেউ বই বাড়িয়ে দেয় তখন?

ভালো লাগছে। বেশ কয়েক বছর পর আবারও পুরনো তারিখে অর্থাৎ পহেলা ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু হওয়ায় বেশ লাগছে। আর অটোগ্রাফ দিতে ভালোই লাগে, তবে অনেকে আমার বাবার লেখা বইতেও আমার অটোগ্রাফ চায়, তখন বেশ বিব্রতবোধ করি।

প্রত্যেক লেখকের আলাদা জগৎ আছে? আপনার জগতটি কেমন?

যারা আমাকে চেনেন তারা জানেন আমি সর্ম্পূণ একা থাকি, একা ঘুরি। এর ফলে হঠাৎ ধরুন কোথাও গেলাম তখন চারপাশের সবকিছুর সঙ্গে নিজে নিজে কথা বলি ও লেখার আইডিয়া পাই।

এবারের মেলায় আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে আপনার গল্পের বই ‘ইগলের চোখ’, বইটি নিয়ে পাঠকদের বিস্তারিত বলবেন?

বইটিতে নয়টি গল্প আছে। যেমন বইয়ের নামে যে গল্পটি তার নাম ‘ইগলের চোখ’। কেন ইগলের চোখ? পুরো বাংলাদেশকে কে দেখেন ইগল পাখির চোখে? কার দৃষ্টি ইগলের মতো তীক্ষ্ণ? তাকে নিয়েই প্রথম গল্প ‘ইগলের চোখ’, অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা। ‘ভেঙ্গে পড়ছি আমরা ধীরে ধীরে’ গল্পে চারপাশের ঘুণে ধরা সম্পর্কগুলোরই দেখা পাওয়া যাবে। সাহসী ছোটগল্পের নাম ‘মেনোপজ’। ‘মা’ ও ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’- এ দুটি গল্পই সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। ‘মূর্খ মেয়েটি অধ্যাপককে ভালবেসেছিল’ একজন অধ্যাপকের ব্যক্তিগত জীবনের কথা। সমাজের উঁচু থেকে নিচুতলার নারীদের ইচ্ছে অবদমনের গল্প ‘অপরাধবোধ’। আয়েসি শহুরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত আমাদের কি সময় হয় শরণার্থীদের কথা স্মরণে! এ নিয়েই গল্প ‘পত্রিকার হেডলাইন’। একজন নিভৃত লেখক ও তার তরুণ পাঠকের মনস্তাত্ত্বিক গল্প ‘লেখিকা তোমায় ভালোবাসি’।

কবি হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতা আছে ‘আমাদের মা’- ‘আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো/ আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি; সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো’। আপনার গল্পের ‘মা’-ও কি তাই?

না। আমার গল্পের যিনি মা- তার কোন রক্তমাংসের সন্তান নেই। তার সন্তান হলো তার রোপন করা গাছপালা।

কিশোরদের জন্য আপনার লেখা বই ‘বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে’, বইটি উৎসর্গ করেছেন আপনার বাবাকে। লেখালেখিতে কোনো ঘটনা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে কি, আর কীভাবে?

বই লিখলেই যে মা-বাবাকে উৎসর্গ করতে হবে– আমি তেমনটা মনে করি না। তবে কিশোরদের জন্য লিখতে গিয়ে বারবার বাবার লেখা ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটির কথা মনে পড়ছিল। কিশোর বয়সে ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটি পড়ে জেনেছিলাম গ্রামের কথা। সে গ্রামের নাম রাড়িখাল। বইয়ের পাতায় কালো অক্ষরে লেখা গ্রামের সৌন্দর্যের নিখুঁত বর্ণনা শহরে বেড়ে ওঠা এই আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে রাড়িখাল গ্রামকে। আজ ঢাকা শহরে বসেও রাড়িখাল গ্রামকে, এমনকি গ্রামের খয়েরি মাটিকে আমি বড্ড অনুভব করি, বাবা যে সেই রাড়িখালের মাটিতেই মিশে আছেন! কিশোরদের জন্য যখন নিজে বই লিখতে বসলাম, বারবার বাবার কথাই মনে পড়ছিল। বইটি তাই বাবাকেই উৎসর্গ করলাম।

‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটি হুমায়ুন আজাদ আপনাকে উৎসর্গ করেছেন। বইটি শুরুও করেছেন আপনাকে সম্বোধন করে ‘মৌলি, তোমাকে বলি...’। বইটি যখন প্রথম হাতে পেলেন, সেসময়ের অনুভূতি বলবেন?

তখন খুব ছোট ছিলাম, তাই বুঝতে পারিনি কী দামি উপহার তিনি আমাকে দিলেন। মূলত আমাদের দেশে লেখকেরা ঘরের বাইরে মূল্যায়িত হলেও ঘরে বোধহয় তেমনটা হন না। একটা ভালো বই সবচেয়ে দামি উপহার, এ ব্যাপারটা আমাদের শেখানো হয় না বলেই হয়তো আমরা এমনটা করি।

আপনার বাবা একজন শিক্ষক। শৈশব-কৈশোরের বিশেষ কোন ঘটনা মনে পড়ে কী?

আমার সব কাজ আমি নিজেই করি। চাকরির পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি– একাই যাচ্ছি, আমার নিজের অপারেশন, অপারেশন টেবিলে ওঠার আগে নিজেই সম্মতিপত্র দিয়ে যাই, একা একা বাজারঘাট-বিদেশভ্রমণ– এসব আমার কাছে মামুলি ব্যাপার মনে হয়। এর কারণটা হলো আমার বাবা। তিনি সব কাজ আমাদের নিজে করতে দিতেন। কখনো আমাদের সঙ্গে যেতেন না। শুধু গাইড করতেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, উনার কাছ থেকে এভাবে ট্রেনিং না পেলে হয়তো আমি এ মধ্যবয়সে এসে সামান্য চুলের ফিতে কিনতেও কোন পুরুষের সাহায্য নিয়ে শপিং সেন্টারে যেতাম।

হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬০-এরও বেশি। কোন বইটি বা বইগুলো বিশেষ ভালো লাগে আপনার? কেন?

‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’। এই বইটি না পড়লে– গ্রামের প্রতি এতটা টান আমার হতো না। বাবার কিশোর বইগুলো ভালোলাগার কারণ হলো– তিনি কিশোরদের ভূতের গল্প বলেন না, ফ্যান্টাসির জগতে নেন না। গল্পের ছলে কিশোরদের আমাদের সমাজ সর্ম্পকে বলেন। ‘গাড়লস্থানে এক বিকেল’ যখন পড়ি তখন হা হয়ে যাই। ‘লাল নীল দীপাবলি’ পড়ে সহজভাবে জেনেছি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। তার লেখা কবিতা আমার ভীষণ প্রিয়। বারবার পড়ি তার ‘শুভেচ্ছা’ কবিতাটি।

হুমায়ুন আজাদের কিশোর উপন্যাস ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ আর মৌলি আজাদের ‘হুমায়ুন আজাদ আমার বাবা’। পাঠক হিসেবে কোনটি পড়তে বেশি আনন্দ পান? কেন?

‘আব্বুকে মনে পড়ে’ বইটি আমি এখন আর পড়ি না। ভীষণ কান্না পায়। ওই যে ছেলেটি ডোরবেল শুনলে মনে করে তার বাবা আসবে, কিন্তু বাবা আসে না। রকমারিতে দেখলাম ‘হুমায়ুন আজাদ আমার বাবা’ বইটি ৩ তারকা চিহ্নিত বই। পাঠকদের হয়তো বাবাকে নিয়ে জানার আগ্রহ থেকে বইটি কেনেন। আমি নিজে যখন পড়ি তখন মনে হয় আরও কিছু লেখা যেতো, পরক্ষণেই মনে হয় কী হবে, তাকে তো আর ফিরে পাবো না!

আপনার প্রিয় লেখক কে বা কারা এবং কেন? প্রিয় কোন বই?

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। সবাই তার উপন্যাস পড়ে, আমার পছন্দ তার ছোটগল্প। অপ্রকাশিত বেশ কিছু ছোটগল্প আছে, বারবার পড়ি। তার লেখা ভালো লাগার কারণ গভীর জীবনবোধ, অন্ধকার আর জীবনের ধ্রুবসত্য মৃত্যুকে তিনি বারবার লেখায় আনেন। তার একটা গল্প ‘মৃত্যু’, ইন্টারেস্টিং। ওয়ালীউল্লাহর বেশিরভাগ গল্পেই নারীচরিত্রগুলো হঠাৎ করেই যেন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, গল্পে তৈরি করে নতুন বাঁক। ‘মৃত্যু’ গল্পের সেকেলে উকিল খান সাহেব বদরুউদ্দিনের স্ত্রী আমেনা খাতুনের প্রতিবাদটি ছিল অভিনব। ভালো লাগে ‘লালসালু’ উপন্যাস। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সময় পেলেই পড়ি। একসময় হুমায়ূন আহমেদের লেখা রীতিমত গিলতাম।

বই পড়া হয় কখন?

সময় বের করে প্রতিদিনই যা ভালো লাগে পড়ি। আমার নিজের লেখার জন্য যা যা দরকার তা পড়ার চেষ্টা করি। আমাদের সিস্টেমে যেহেতু চাকরি করেই লিখতে হবে- সেহেতু যারা লিখছেন তারা বোধকরি এভাবেই সময় বের করে নেন।

কবি হাইনরিখ হাইনের একটা কথা আছে, ‘পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বোকার সংখ্যা বেশি’। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?

হা হা (হাসি)। একদমই নয়।

ভবিষ্যতে আর কী নিয়ে লেখার বা করার পরিকল্পনা আছে আপনার?

এবারের মেলায় পাঠকরা বেশ উৎসাহী- মেলায় স্টলে বসে থেকে দেখেছি। পাঠকরা বই দেখছেন- কিনছেন, তাই লেখা চালিয়ে যাবো। আমি বেশকিছু সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত, বিশেষত তৃতীয় লিঙ্গরা আমার কাজ করার একটা জায়গা। তাদের নিয়ে আমার অনেককিছু করার পরিকল্পনা আছে। আমি কোন ফাউন্ডেশন বা সংঘ করে কারও জন্য কাজ করি না। আমার নিজের সামর্থ অনুযায়ী নিতান্ত নিজের জন্য যা প্রয়োজন তা রেখে বাকিটা যাদের জন্য কাজ করি তাদের দিয়ে দিই। আমার বাবা আমাদের জন্য কোন বস্তুগত সম্পদ রেখে যাননি, আমারও নিজের সন্তানের জন্য তেমনকিছু রাখার পরিকল্পনা নেই। যা আছে তা বর্তমানের, ভালো কিছু করার জন্য।