গোলাপী পরীদের ইশকুল

এখনও বরিশাল গেলে স্কুলের রাস্তার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। ঢং ঢং শব্দে ঘণ্টা পড়লো ৷ প্রহরীর কাছে আবদার, আমি এই স্কুলের ছাত্রী ছিলাম, একটু ঢুকতে চাই!

আফরিদা জিননুরাইন উর্বীআফরিদা জিননুরাইন উর্বী
Published : 16 Sept 2022, 07:32 AM
Updated : 16 Sept 2022, 07:32 AM

হীরক রাজার আদেশ এলো, ‘কাল থেকে পাঠশালা বন্ধ’। শেকলবন্দী ছন্দের বাইরে কথা বলা উদয়ন পণ্ডিত তার শিষ্যদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতদিন যা পড়িয়েছি তা ভুলে যাওনি তো?’ সুব্রত থেকে রশীদ, নিমাই একে একে সব ছাত্রের নাম ধরে একই প্রশ্ন করলেন গুরুমশাই । তারপর উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘পাঠশালা একদিন খুলবে’।

১৮৭৩। বরিশাল শহরের কয়েকজন পাদ্রী ও সিস্টার সর্বপ্রথম বালিকাদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। নাম হলো ‘বরিশাল সদর বালিকা বিদ্যালয়’। শুরু থেকে পাশে ছিলেন বরিশালের কাঁচাবালিয়ার স্বনামধন্য গুহ পরিবার, রহমতপুরের জমিদার পরিবার এবং সমাজসেবী বিজয় সেন। গুহ পরিবারের সম্পত্তিতে ও সম্মতিতে প্রাথমিকভাবে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্ব থেকেই ছাত্রী সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এগিয়ে আসেন শরৎচন্দ্র গুহ। তিনিই ছিলেন বরিশাল সদর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান উদ্যোক্তা। বিদ্যালয়টি আজ কবি জীবনানন্দ দাশ সড়কের যেখানে অবস্থিত সেখানের সবটুকু ভূমির মালিক ছিলেন তিনি। তিনি তার সম্পত্তি নিঃশর্তভাবে শুধু নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য রেজিস্ট্রি করে দান করে গেছেন । এছাড়া মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের ভ্রাতুষ্পুত্র সরল কুমার দত্ত, বাহাদুর হেমায়েত উদ্দিন, মৌলভী মফিজ উদ্দিন অ্যাডভোকেট, আইনজীবী অবনীনাথ ঘোষ, মোফাজ্জেল হক প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিরা এই মহাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে বরিশাল সদর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে মিস ডরোথি দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপর মিস মার্থা ও মিস ফ্রান্সিস প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৫ সালে স্নেহলতাদাশ গুপ্ত (কবি জীবনানন্দ দাশের পিসি) প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে তিনি দেশত্যাগ করেন। এ পর্যায়ে বিদ্যালয়ের মূল উদ্যোক্তা শরৎচন্দ্র গুহের মেয়ে শান্তি সুধা গুহ প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পান। তার তত্ত্বাবধানে বিদ্যালয়ের উন্নতি বেগবান হয়ে ওঠে। ১৯৬৮ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ত্রিশ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সে সময়ে তিনি ‘তমযা-ই পাকিস্তান’ উপাধি পেয়েছিলেন। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল সরকার বরিশাল সদর বিদ্যালয়টিকে সরকারি বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করে। নতুন নামকরণ করা হয় ‘বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম সচিবালয় ছিলো আমার বিদ্যামন্দির।

২০০৪ সালে দিবা শাখায় চতুর্থ শ্রেণিতে এ স্কুলে ভর্তি হই আমি। আমাদের শ্রেণি-শিক্ষিকা প্রথম ক্লাসেই ঘোষণা করলেন একজন ক্লাস ক্যাপ্টেন নিযুক্ত করা হবে। বেশ উৎসাহ নিয়ে ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচনে অংশ নিলাম আর বড় ব্যবধানে ফার্স্ট ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হয়েও গেলাম, দায়িত্ব পালন করেছি নবম শ্রেণি পর্যন্ত। ক্লাস শুরুর আগে উপস্থিত-অনুপস্থিত ছাত্রী সংখ্যা গণনা, টিফিন বিতরণ, বেতন উত্তোলনের দিন শ্রেণি-শিক্ষিকার সঙ্গে প্রতিটি পাই পয়সার হিসাব সূক্ষ্মভাবে মেলানো, কোলাহলপূর্ণ ক্লাস শান্ত রাখার ভার নেওয়া, পরীক্ষার খাতা দেখানোর দিন সবার হাতে খাতা পৌঁছানো, উত্তোলন, চক ফুরিয়ে গেলে অফিসরুমে গিয়ে ছুটে হিসাব বুঝিয়ে নিয়ে আসা, এসব টুকিটাকি কাজের কাজী- জীবনে প্রথম নেতৃত্বের শিক্ষা, স্বচ্ছতার শিক্ষা।

কিছুটা যে পাজিও ছিলাম না তা কিন্তু নয়, প্রায়ই ক্লাস শান্ত রাখতে সহপাঠীদের নাম বোর্ডে টুকে রাখতে হতো৷ যারা বেশি বকবক করতো তাদের নামের পাশে তারকা চিহ্নও জুড়ে দিতাম। সহপাঠীদের বহু শাপশাপান্ত কুড়িয়েছি, আবার একইসঙ্গে তাদের সমর্থনও পেয়েছি।

বছরের শেষ দিন ওই সবুজ মাঠে তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি সারিবদ্ধ বসে দুরুদুরু বক্ষে ফলাফল ঘোষণার জন্য অপেক্ষা। আতঙ্কময় দিনই বলা যায়। প্রথম দশজনকে বই আর রজনীগন্ধার স্টিক পুরস্কার দেওয়া হতো। নাহ! জীবনে কখনোই প্রথম হইনি। তবে ওই দশের মাঝে থাকার কারণে মাঠ থেকে এক দৌড়ে পুরস্কার আনবার স্মৃতি বেশ মনে পড়ে। একইসঙ্গে মনে পড়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে নাম দিয়ে কোনমতে ৫০ মিটার দৌড়ে বিশাল দূরত্বে পিছিয়ে পড়ে ‘আর পারিনে বাপু’ বলে মাঠে হেসে লুটোপুটি খাওয়া৷ বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল সবসময় খুব মনঃপুত হতো তা কিন্তু নয়। কিন্তু পরেরদিন নতুন বছর শুরু, নতুন উদ্যোমে নতুন বই হাতে ক্লাস শুরু করা।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম সচিবালয় ছিলো আমার বিদ্যামন্দির। চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ডিসপ্লেতে নাম লেখালাম। শুরু হলো অনুশীলন। আমার ভূমিকা সামান্য- যুদ্ধের শরণার্থী। খোলামাঠে হাজার মানুষের মাঝে শুয়ে থাকবো। রাতে মিলিটারি হামলা হবে। চিৎকার করে দিকভ্রান্তের মতো ছুটবো। তারপর দলবেঁধে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবো।

কিন্তু আমার মধ্যে ব্যাপারটা এতটুকুর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। মনে হতো আমি সত্যিই দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। সত্যি সত্যি আমি হারিয়ে গেছি পরিবার থেকে, অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছি। কোথায় যাবো জানি না। কী খাবো ঠিক নেই। সঙ্গে শুধু শুকনো মুড়ি আর পানি। রাজাকাররা আমার পাশ থেকে একটি সদ্যবিবাহিত মেয়েকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা চিৎকার করছে। আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখছি, কিছু করার নেই। ছেড়ে যাবার সময় প্রিয় মাতৃভূমির দিকে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। চোখ ফেটে আসা অশ্রুবিন্দু ছাড়া আর কিছুই নেই সম্বল।

২০০৬, আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলের নিয়মে ইউনিফর্ম ফ্রক ছেড়ে গোলাপী সাদা সালোয়ার কামিজ পরলাম। জোরালো কণ্ঠস্বর আর বাবরি চুলের বদৌলতে পেয়ে গেলাম মেজর এম এ জলিলের ভূমিকা। এর পরবর্তী প্রতিটি বছর ডিসপ্লেতে স্টেনগান হাতে নিয়ে ছুটেছি। মুক্তিফৌজকে কমান্ড করিয়েছি। ‘আমাদের সংগ্রাম চলবে...জনতার সংগ্রাম চলবে’ এ গানের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী নিয়ে মিলিটারিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে পালিয়েছি। এগুলো প্রতীকী প্রদর্শনী হলেও আমি অনুভব করতে পারতাম। দেশ স্বাধীনের পর লাল সবুজের বিজয় নিশানটা নিয়ে ওই মাঠটাতে ছুটেছি আনন্দে।

বান্ধবীরা মিলে ‘সাত বিচ্ছু ও গেছো মামা’ নামে সম্মিলিত উপন্যাস রচনার স্মৃতি মনে পড়ে। সেই উপন্যাস আমরা নিয়ম করে সহপাঠী, আত্মীয়-স্বজনদের পড়তে দিতাম, আবার একটা মন্তব্য খাতায় খুব গম্ভীরভাবে তাদের মন্তব্য সংরক্ষণ করতাম।

দশম শ্রেণিতে উঠে মনে হয়েছিলো শেষবেলাটা শেষ বেঞ্চে বসেই কাটিয়ে দিই। তখন আবার ব্ল্যাকবোর্ডে চকের হরফে আমার নামের পাশে তারকাচিহ্ন। মনে পড়ে ক্লাসের ফাঁকে পড়ার বইয়ের ভাঁজে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই লুকিয়ে পড়ার অপরাধে শাস্তির স্মৃতি, আবার বান্ধবীরা মিলে ‘সাত বিচ্ছু ও গেছো মামা’ নামে সম্মিলিত উপন্যাস রচনার স্মৃতি। সেই উপন্যাস আমরা নিয়ম করে সহপাঠী, আত্মীয়-স্বজনদের পড়তে দিতাম, আবার একটা মন্তব্য খাতায় খুব গম্ভীরভাবে তাদের মন্তব্য সংরক্ষণ করতাম।

উপন্যাস রচনা চলতো টিফিন ছুটিতে। টিফিন ছুটি মানেই আনন্দ! টিফিনে হয়তো থাকতো বেকারির গরম বিস্কুট, গরম কেক, প্যাটিস, ড্যানিশ, আর যেদিন সিঙারা দিতো সেদিন সবার আনন্দ জ্যামিতিক হারে বেড়ে যেতো। গরমের দিনে একদিন টিফিন থাকতো আম। সেই আমের গায়ে কলম দিয়ে সবার চিত্রকর্ম আঁকা চলতো।

এখনও বরিশাল গেলে স্কুলের রাস্তার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। আমার ছোট্ট বেলার পকেট গেট আজ বন্ধ, এখন বড় গেট। দারোয়ান আতাহার দাদু আর বেঁচে নেই। গেটের বাইরে দাঁড়িয়েই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সাদা ফিতায় দুই ঝুঁটি ছোট্ট গোলাপি রঙের উর্বী মাঠ জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, বাবা নিতে আসবে বলে গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করছে। ঢং ঢং শব্দে ঘণ্টা পড়লো ৷ প্রহরীর কাছে আবদার, আমি এই স্কুলের ছাত্রী ছিলাম, একটু ঢুকতে চাই!

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!