টেসলা বলতেন, “আমি ও আমার পাখি মনে মনে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারি।”
Published : 14 Jan 2025, 12:06 AM
১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারির এক সকাল। বিভ্রান্ত হয়ে একটি পোষা কবুতর হোটেল নিউ ইয়র্কারের খালি ঘরের জানালা দিয়ে উড়ে এলো। তার এক পায়ে ফিতা বাঁধা, তবে সে কোথা থেকে এসেছে বা কোথায় যাওয়ার কথা, তা কেউ বলতে পারে না।
হোটেল কর্তৃপক্ষ যখন এই বিষয়ে আলোচনা করছে, তখন এক পরিচারিকা দৌড়ে ৩৩ তলায় গিয়ে হোটেলের সবচেয়ে বিখ্যাত বাসিন্দা নিকোলা টেসলার (১৮৫৬-১৯৪৩) দরজায় কড়া নাড়লেন। ৭৮ বছর বয়সী এই উদ্ভাবক দ্রুত সেই অসহায় কবুতরটিকে নিজের দায়িত্বে নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন।
“ড. টেসলা… তার একটি নতুন বৈদ্যুতিক প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিলেন, যেন তার অতিথির সামান্য যত্নের প্রয়োজন পড়লে তিনি তা করতে পারেন,” দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন প্রকাশ করে বসলো। “যিনি সম্প্রতি এমন একটি বৈদ্যুতিক ডেথ-বিম আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন, যা একসঙ্গে ১০ হাজার বিমান ধ্বংস করতে পারে, তিনি জানালার ধারে তোয়ালে বিছিয়ে দিলেন এবং ছোট একটি বাটিতে খাবার দিয়ে রাখলেন।”
নিকোলা টেসলা — আধুনিক প্রযুক্তি ও বিদ্যুৎ বিপ্লবের স্থপতি, বিখ্যাত সার্বিয়ান-আমেরিকান বিজ্ঞানী — বছরের পর বছর ধরে নিয়মিত ম্যানহাটনের মধ্যরাতের রাস্তায় কবুতরদের খাবার দিতে দেখা যেত। অন্ধকারে নিচু সুরে তিনি একটি শিস দিতেন, আর অন্ধকার থেকে ঝাঁক ঝাঁক কবুতর বুড়ো লোকটির দিকে উড়ে আসত, তার প্রসারিত হাতে বসতো।
তিনি তার ঘরে ঝুড়ি রাখতেন কবুতরের বসবাসের জন্য, পাশাপাশি নিজের তৈরি খাবারের মিশ্রণ মজুদ রাখতেন, আর জানালাগুলো সবসময় খোলা রাখতেন যেন কবুতরগুলো আসতে ও যেতে পারে। একবার, তিনি সেন্ট প্যাট্রিক ক্যাথেড্রালের প্লাজায় একটি আহত পোষা কবুতরকে ধরার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। থানার একটি সেলে বসে অবশেষে পুলিশ কর্মকর্তাদের বোঝাতে পেরেছিলেন যে, তিনি বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত উদ্ভাবক ও গবেষক, টেসলা!
টেসলা বলতেন, “আমি ও আমার পাখি মনে মনে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারি।”
বহু বছর ধরে তিনি কোনো সফল উদ্ভাবন তৈরি করেননি। তিনি তখন ছিলেন শীর্ণকায় ও দেউলিয়া, ঋণ করে আর কিছু মানুষের সহায়তায় বেঁচে ছিলেন। একের পর এক হোটেল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়, পেছনে ফেলে গিয়েছিলেন কবুতরের বিষ্ঠা ও বকেয়া ভাড়ার এক দীর্ঘ তালিকা। তার কোনো পরিবার বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না, একমাত্র বন্ধু ছিল তার পাখিরা।
তিনি নিজেই তার জীবনীকার জন ও’নীলকে এই গল্পটি বলেছিলেন। “আমি বহু বছর ধরে কবুতরদের খাবার দিচ্ছি, হাজার হাজার কবুতর,” টেসলা বলেছিলেন। “কিন্তু একটি বিশেষ কবুতর ছিল, একটি সুন্দর পাখি, যার ডানা ছিল হালকা ধূসর প্রান্তবিশিষ্ট সাদা। সেই পাখিটি ছিল অন্যরকম। এটি ছিল একটি মেয়ে পাখি। আমি যেখানেই থাকি না কেন, সেই পাখিকে আমি চিনতে পারতাম। আমি যেখানে থাকতাম, সে আমাকে খুঁজে বের করত; আমি যখন তাকে ডাকতাম, বা মনে মনে চাওয়া মাত্রই, সে উড়ে এসে আমার কাছে আসত। সে আমাকে বুঝত এবং আমিও তাকে বুঝতাম। আমি সেই পাখিটিকে ভালোবাসতাম।”
“হ্যাঁ,” তিনি আবারও নিশ্চিত হয়ে বললেন, “আমি সেই কবুতরটিকে ভালোবাসতাম।” টেসলা বলেছিলেন, তিনি এবং তার পাখি একে অপরের সঙ্গে মানসিকভাবে কথা বলতে পারতেন। কখনও কখনও, যখন তারা নীরব কথোপকথন করত, তখন তার চোখ থেকে আলোর রশ্মি বের হতো।
টেসলার জীবনের এই কবুতর অধ্যায়টিকে অদ্ভুত এক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কালের মহান প্রকৌশলী, যিনি বৈদ্যুতিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিশ্বকে মুগ্ধ করেছিলেন, যার উদ্ভাবন শহরের বিদ্যুৎ প্রবাহের ধরনকে রূপ দিয়েছিল এবং বাসা-বাড়িগুলো আলোকিত করেছিল, তিনি একাকিত্ব বা পাগলামির মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্বাস করেছিলেন যে, তিনি একটি টেলিপ্যাথিক পাখির সঙ্গে মধুর সম্পর্ক তৈরি করেছেন।
টেসলার পছন্দের মধ্যে ছিল: তিনবার করে কোনো কাজ করা। এ কারণেই সম্ভবত তার হোটেল রুমটি ছিল ৩৩ তলায়। শৈশবে তার প্রিয় অভ্যাসগুলোর মধ্যে ছিল সিঁড়ির ধাপ গোনা, তিনি তার আত্মজীবনীতে স্মরণ করেছেন, “যদি কোনোটা মিস করতাম, বাধ্য বোধ করতাম আবার সবকিছু করতে, এমনকি এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লেগে যেত।” টেসলার ইন্দ্রিয়গুলো অতিরিক্ত সংবেদনশীল মনে হতো। “আমি ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে পেতাম... একটি মাছি যদি ঘরে টেবিলে বসত, তার শব্দ আমার কানে একটি নিস্তব্ধ আওয়াজের মতো শোনাত।”
নিকোলা টেসলার জন্ম ১৮৫৬ সালে। তিনি থমাস আলভা এডিসন ও জর্জ ওয়েস্টিংহাউসের সঙ্গে কাজ করলেও স্বাধীন গবেষণা বেশি পছন্দ করতেন। তার উদ্ভাবনগুলো বিকল্প প্রবাহ বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন এবং বিতরণ সম্ভব করেছিল। ১৯৪৩ সালে নিউ ইয়র্কে মারা যান টেসলা। অর্থের অভাবে তার অনেক ধারণা শুধু নোটবুকে রয়ে গিয়েছে, যা এখনও উদ্ভাবনী সূত্র খুঁজতে আগ্রহীরা পরীক্ষা করছেন।