নজরুলের মজার কাণ্ড

কাজী নজরুল এসেছেন সিরাজগঞ্জে। খেতে বসেছেন আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর ঘরে। আসাদউদ্দৌলা নিজেই ইলিশ ভাজা দিচ্ছেন সবার পাতে। পাতে ইলিশ পড়া মাত্র নজরুল সেটা খেয়ে ফেললেন। তখনই কে যেন আরও কয়েক টুকরো ইলিশ দিতে যাচ্ছিলেন কবির পাতে। কবি তাকে বাধা দিয়ে বললেন, আরে করছ কী?

>> আহমেদ রিয়াজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2014, 10:38 AM
Updated : 25 May 2014, 11:03 AM

ইলিশভাজা দিচ্ছি!

আমাকে এত ইলিশ দিও না। শেষকালে বিড়াল কামড়াবে তো?

ইলিশ ভাজা খেলে বিড়াল কামড়াবে কেন? কেউ কিন্তু কবির কথা বুঝতে পারলেন না। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কবির মুখের দিকে। কবি বুঝলেন কেউ তাঁর কথা বোঝেননি।

হঠাৎ ঠা-ঠা শব্দে হাসতে হাসতে কবি বললেন, আরে বুঝলেন না! ইলিশমাছের গন্ধ মুখে লালা ঝরায়। বিড়াল মাতাল হয়ে যায় এর ঘ্রাণে। বেশি খেলে কি আর রক্ষে আছে? সারা দেহ থেকে গন্ধ ছুটবে আর সে গন্ধ পেয়ে বিড়াল তেড়ে আসবে।

কবির ব্যাখ্যা শুনে কি কেউ না হেসে পারে? হাসির ফোয়ারা ছুটল আসরে।

খাবারের পর দই পরিবেশন হচ্ছে। কবির পাতেও দেওয়া হল। খানিকটা দই মুখে দিয়েই কবি আসাদউদ্দৌলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, কী হে! তুমি কি এই দই তেঁতুল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি?

আবারও হাসির জোয়ার উঠল খাবার আসরে।

কবি তখন মোসলেম ভারত নামের পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা তখন আকাশছোঁয়া। কলকাতার এক বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ী এলেন কবির কাছে। আবদার জানালেন কবিকে একটি বিজ্ঞাপন লিখে দিতেই হবে। কোম্পানির নাম ডোয়াকিন অ্যান্ড সন্স। হারমোনিয়াম কোম্পানি। কবিও তক্ষুনি কাগজ-কলম নিয়ে লিখে ফেললেন--

কী চান? ভালো হারমোনি?

কাজ কি গিয়ে-জার্মানি?

আসুন দেখুন এইখানে,

যেই সুর যেই গানে,

গান না কেন, দিব্যি তাই,

মিলবে আসুন এই হেথাই,

কিননি কিন, ডোয়ার কিন..

নজরুলের লেখা বিজ্ঞাপন। জনপ্রিয় না হয়ে পারে? তো ডোয়াকিন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের জনপ্রিয়তা দেখে ছুটে এল আরেকটা কোম্পানি। কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকার-বাহাদুর কোম্পানি। এটিও হারমোনিয়াম কোম্পানি। তারাও আবদার জানাল নজরুলের কাছে-- আমাদেরও একটা বিজ্ঞাপন লিখে দিন না।

নজরুল লিখলেন--

মিষ্টি বাহা বাহা সুর,

চান তো কিনুন ‘বাহাদুর’।

দুদিন পর বলবে না কেউ-- ‘দূর দূর’,

যতই বাজান ততই মধুর মধুর সুর!!

করতে চান কি মনের প্রাণের আহা দূর?

একটি বার ভাই দেখুন তবে ‘বাহাদুর’,

যেমন মোহন দেখতে তেমনি শিরীন ভরাট,

বাহা সুর, চিনুন, কিনুন বাহাদুর।

কেবল হারমোনিয়াম বা বাদ্যযন্ত্রের বিজ্ঞাপনই নয়, নজরুল ইসলাম আরও নানা পণ্যের বিজ্ঞাপনও লিখে দিয়েছিলেন। আর এসব বিজ্ঞাপন লিখে দেওয়াটাই প্রমাণ করে-- কতটা জনপ্রিয় ছিলেন আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অসাধারন ক্ষমতা ছিল নজরুলের। সেই ছোটবেলা থেকেই দুঃখ আর দুঃখ। যষ্ঠ শ্রেণি অবধি লেখাপড়ার পর স্কুল ছাড়তে হল অভাবের কারণে। নেমে গেলেন টাকা-পয়সা রোজগারে। প্রথমে কিছুদিন বাসুদেবের দলে গান গেয়ে বেড়ালেন। পরের কিছুদিন খানসামা হিসেবে কাজ করলেন রেলওয়ের এক গার্ডের। এরপর গেলেন আসানসোল। সেখানে রুটির দোকানে কাজ নিলেন। রুটি বানানোর কাজ।

কিন্তু জাত কবি বলে কথা। রুটি বানাতে বানাতে মুখে মুখে ছড়া কাটতেন। আটা মাখছেন আর কিশোর নজরুলের গা বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। আর মুখে ফুটছে ছড়ার খই--

মাখতে মাখতে গমের আটা

ঘামে ভিজল আমার গা-টা।

বড় হয়ে যখন বিখ্যাত হলেন, ছোটদের কিন্তু মোটেই হেলাফেলা করতেন না। ছোটরা ভীষণ গুরুত্ব পেত কবির কাছে। এই যেমন কুমিল্লার কথাই ধরা যাক। কবি তখন এসে উঠেছেন কুমিল্লায় ইন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের বাড়িতে।

এক সকালে হঠাৎ তাঁর কানে এল এক ছোট্ট মেয়ের কণ্ঠ। জানালা খুলে তাকিয়ে দেখলেন, ওই বাড়িরই একটি মেয়ে পেয়ারাডালে বসে কাঠবেড়ালির সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। কখনও কাঠবিড়ালিকে ভয় দেখাচ্ছে, কখনও আদুরে গলায় কথা বলছে। ব্যাপারটা বেশ মজা লাগল কবির। তখনই কাগজ কলম নিয়ে লিখে ফেললেন-- কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও?

তো একবার ছোট্ট ফুটফুটে এক মেয়েকে বলেছিলেন, খুকি তোমাকে কলকাতার এ মোড় থেকে ও মোড় সব দেখাব।

ছোট্ট মেয়েটি কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেনি কবির এ কথা। বড়রা তো কত রকম কথাই বলে। ছোটদের কত রকম প্রলোভনই দেয়। সব কথা রাখে না। কিন্তু তিনি যে কাজী নজরুল ইসলাম।

সত্যি সত্যি একদিন বেরিয়ে পড়লেন মেয়েটিকে নিয়ে। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে। শিশুর সঙ্গে সঙ্গে তিনিও কলকাতা দেখতে থাকলেন। সারাদিন কলকাতা টো-টো করে ঘুরে বেড়ালেন। বিকেলের দিকে ট্যাক্সি ভাড়া দিতে গিয়ে দেখেন-- পকেটে একটা পয়সাও নেই। এখন উপায়! কবি নজরুল বলে কথা। সেই ট্যাক্সি নিয়েই ছুটলেন বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি। এর উপর কাছ থেকে ধার করে করে মেটালেন ট্যাক্সি ভাড়া।

কাজী নজরুল ইসলাম ধূমকেতু নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনাও করতেন। ধূমকেতু অফিসে সবসময় চলত হাসি আর আনন্দের বন্যা। মাটির ভাঁড়ে চা চলত খানিক বাদে বাদে। কবি যখন চায়ে চুমুক দিতেন কিংবা কোনো হাসির কথা মনে পড়ত কিংবা কোনো রসিক বন্ধু অফিসে ঢুকত, অমনি কবি অট্টহাসি দিতেন। মাটির পেয়ালা ছুঁড়ে মারতেন। আর মুখে বলতেন, ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’।

কবির এমন আচরণে হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন সঙ্গীরা। তবু কবির মধ্যে থামাথামি নেই। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তেন।

তো একদিন গোপীনাথ নামে একজন ধূমকেতুর অফিসে এসে এমন কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেলেন। জানতে চাইলেন, দেশ পরাধীন। সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সবাই। এমন জ্বালার মধ্যে আপনাদের মনে এত আনন্দ আসে কোত্থেকে?

ভরাট গলায় নজরুল জবাব দিলেন,  প্রতিটি ইংরেজ নয়, সমগ্র ইংরেজ সমাজ আমাদের শত্রু। এ শত্রুদের ভাসিয়ে দিতে হলে চাই প্রাণবন্যা। এরই আবাদ করছি আমরা এখানে।’

নজরুলের কথা শুনে গোপীনাথ লা জওয়াব।

আনন্দের সময় কাজী নজরুলের মুখে সবসময় থাকত-- দে গরুর গা ধুইয়ে।

দে গরুর গা ধুইয়ে নামে একটি রম্য গানও লিখেছেন কবি। কবির চন্দ্রবিন্দু কাব্যগ্রন্থে আছে গানটি।

‘দে গরুর গা ধুইয়ে’

কোরাস্ :----- দে  গরুর গা ধুইয়ে !!

উলটে গেল বিধির বিধি আচার বিচার ধর্ম জাতি,

মেয়েরা সব লড়ূই করে, মদ্দ করেন চড়ুই ভাতি !

পলান পিতা টিকেট করে----

খুকি তাহার পিকেট করে!

গিন্নি কাটেন চরকা, কাটেন কর্তা সময় গাই দুইয়ে!

কোরাস : ... দে  গরুর গা ধুইয়ে!

চর্মকার আর মেথর চাঁড়াল ধর্মঘটের কর্ম-গুরু !

পুলিশ শুধু করছে পরখ কার কতটা চর্ম পুরু !

চাটুয্যেরা রাখছে দাড়ি,

মিঞারা যান নাপিত-বাড়ি !

বোটকা-গন্ধি ভোজপুরী কয় বাঙালিকে---- ‘মৎ ছুঁইয়ে !’

কোরাস : …   দে  গরুর গা ধুইয়ে !!

মাজায় বেঁধে পৈতে বামুন রান্না করে কার না বাড়ি,

গা ছুঁলে তার লোম ফেলে না,  ঘর ছুঁলে তার ফেলে হাঁড়ি !

মেয়েরা যান মিটিং হেদোর,

পুরুষ বলে, ‘বাপ্ রে দে দোর !’

ছেলেরা খায় লাপ্ সি-হুড়ো, বুড়োর পড়ে ঘাম চুঁইয়ে !

কোরাস্ : …  দে গরুর গা ধুইয়ে  !!

ভয়ে মিঞা ছাড়ল টুপি, আঁটল কষে গোপাল-কাছা,

হিন্দুসাজে গান্ধী-ক্যাপে, লুঙ্গি পরে ফুঙ্গি চাচা !

দেখলে পুলিশ গুঁতোয় ষাঁড়ে !

পুরুষ লুকায় বাঁশের ঝাড়ে !

নাক কাটা হয় রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর কান খুইয়ে !

কোরাস্ : …   দে  গরুর গা ধুইয়ে !!

খঞ্জ নেতা গঞ্জনা দেয়, ‘চ’লতে নারে দেশ যে সাথে !’

‘টেকো বলে, ‘টাক ভালো হয় আমার তেলে, লাগাও মাথে !’

‘কি গানই গায়’, বলছে কালা,

কানা কয় ‘কি নাচ্ ছে বালা !’

কুঁজো বলে, ‘সোজা হয়ে শুতে যে সাধ, দে শুইয়ে!”

কোরাস্ : …    দে  গরুর গা ধুইয়ে !

সস্তা দরে দস্তা-মোড়া আসছে স্বরাজ বস্তা-পচা,

কেউ বলে না ‘এই যে লেহি’ আস্ লে ‘যুদ্ধ দেহি’র খোঁচা’ ।

গুণীরা খায় বেগুন- পোড়া

বেগুন চড়ে গাড়ি ঘোড়া,

ল্যাংড়া হাসে ভেংড়ো দেখে ব্যাঙের পিঠে ঠ্যাং থুইয়ে !

কোরাস: …   দে গরুর গা ধুইয়ে!