খোকা ও আপেল গাছ

যুক্তরাষ্ট্রের কবি, কার্টুনিস্ট ও কথাসাহিত্যিক শেল সিলভারস্টেইন (১৯৩০-১৯৯৯)। তার লেখা ও অলঙ্করণে এ বইটির মূল নাম ‘দ্য গিভিং ট্রি’। ১৯৬৪ সালে ‘হার্পার অ্যান্ড রো’ প্রকাশনী থেকে বের হওয়ার পর এটি পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ বইটির প্রচ্ছদ দিয়ে ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়।

মাজহার সরকারমাজহার সরকার
Published : 1 Nov 2017, 02:10 PM
Updated : 1 Nov 2017, 02:41 PM

সে অনেকদিন আগের কথা। এক বনে ছিলো এক আপেল গাছ।

গাছটি ছোট্ট একটা ছেলেকে ভালোবাসে। ছেলেটা রোজ গাছের তলে খেলতে আসে। ঝরে পড়া পাতা একসঙ্গে করে তা দিয়ে মাথার মুকুট বানায়, নিজেকে বনের রাজা বানিয়ে খেলে। গাছের ডাল বেয়ে উঠে আপেল পেড়ে খায় ছেলেটি। এ ডাল থেকে ও ডালে ঝুলে মনের আনন্দে দোল খায়। গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ধরে কানে কানে কী যেন সব কথাও বলে।

গাছটা ঘিরে ছোট্ট ছেলেটা রোজ এসে লুকোচুরি খেলে। সবুজের আড়ালে ছেলেটি যেখানে লুকিয়ে থাকে গাছটি কীভাবে যেন তার পাতাভরা ডাল নুয়ে নুয়ে তাকে ঠিকই খুঁজে নেয়। বনের সবুজে খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে যায় ছেলেটি, গাছের গুঁড়িতে শুয়ে পড়ে। আর গাছটি তার শরীরে শীতল ছায়া বিছিয়ে দেয়।

ছেলেটি এভাবে রোজ আসে গাছটির কাছে। আর গাছটি এতে বড়ই সুখ পায়। এভাবে দিন যায়, দিন গিয়ে রাত আসে। আবার রাত শেষে দিন। ছেলেটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। গাছের কাছে ছেলেটি এখন আগের চেয়ে কম আসে। এতে আপেল গাছটির প্রায়ই একা একা লাগে।

বেশ কিছু বছর পর ছেলেটি আবার আসলো। ততোদিনে সে কিশোর। ছেলেটিকে দেখে গাছ খুব খুশি হলো। বললো, এসো খোকা, এসো। আমার ডালে ঝুলে ঝুলে দোল খাও। চারদিকে দৌড়ে বেড়াও, আমার গুঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আপেল খাও। আনন্দ করো।

কিন্তু ছেলেটি বললো, আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। আমার এখন খেলতে ভালো লাগে না। গাছ বললো, কী করলে তোমার ভালো লাগবে খোকা? খোকা বললো, আমার এখন অনেক টাকা দরকার। অনেক খেলনা কিনতে চাই। আছে টাকা তোমার কাছে?

না খোকা, টাকা তো নেই। আমার আছে শুধু পাতা আর আপেল। আপেল গাছটি বলতে থাকলো, আমার আপেলগুলো তুমি শহরের বাজারে নিয়ে বেচতে পারো। এতে তুমি অনেক টাকা পাবে, আনন্দ করতে পারবে।

কিশোরটি তখন গাছের ডালে ঝুলে সবগুলো আপেল পেড়ে নিয়ে চলে গেলো। এতে খুশি হলো গাছটি। কিন্তু সেই যে ছেলেটি গেলো আর অনেকদিন এলো না। গাছটি তার ডাল নেড়ে পথের দিকে চেয়ে থাকে। খোকা আর আসে না। এতে আপেল গাছটি আবার একা হয়ে গেলো।

অনেক বছর পর আবার ছেলেটি এলো গাছের কাছে। এখন সে বয়সে যুবক। তাকে দেখে আনন্দে ডালপালা নিয়ে নড়ে উঠলো গাছটি। বলল, এসো খোকা, এসো। আমার ডালে ঝুলে ঝুলে দোল খাও। চারদিকে দৌড়ে বেড়াও, আমার গুঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আপেল খাও। আনন্দ করো।

কিন্তু যুবকটি বললো, আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। এখন আমার গাছে চড়ার সময় নেই। গাছ বললো, এখন তুমি কী করতে চাও খোকা? খোকা বললো, আমি একটা ঘর বানাতে চাই। বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকতে চাই। কিন্তু তোমার কাছে কি ঘর আছে?

খোকা, আমার কাছে তো ঘর নেই। এ বনই আমার ঘর। কিন্তু তুমি আমার ডালপালাগুলো কেটে নাও। এগুলো দিয়ে ঘর বানাতে পারো। আনন্দ করতে পারো।

যুবকটি তার ঘর বানানোর জন্য গাছের সব ডাল কেটে নিয়ে চলে গেলো। এতে খুশি হলো গাছটি। কিন্তু সেই যে যুবক গেলো আবার অনেকদিন এলো না। গাছটি তার ডাল নেড়ে পথের দিকে চেয়ে থাকে। গাছের প্রিয় খোকা আর আসে না। এতে আপেল গাছটি আবার একা হয়ে গেলো।

আরও অনেক অনেক বছর পরের কথা। ছেলেটি এলো গাছের কাছে। তার এখন বয়স অনেক বেড়ে গেছে, প্রায় বুড়ো। এতোদিন পর তাকে দেখে খুশির চোটে কথাই বলতে পারছিলো না গাছটি, আনন্দে ডাল-পাতাসহ দুলে ওঠলো। বলল, এসো খোকা, এসো। আমার ডালে ঝুলে ঝুলে দোল খাও। চারদিকে দৌড়ে বেড়াও, আমার গুঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আপেল খাও। আনন্দ করো।

খোকা বললো, আমি এখন বুড়ো। আমার মনে অনেক কষ্ট। গাছ বললো, কী পেলে তোমার কষ্ট দূর হবে খোকা?

আমি নৌকা চাই। নৌকায় চড়ে আমি অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে চাই। আছে তোমার কাছে নৌকা?

আমার কাছে তো নৌকা নেই। কিন্তু আমার এ গুঁড়িটা তুমি কেটে নিয়ে যাও। এটা দিয়ে নৌকা বানাতে পারবে। নিয়ে যাও আর খুশি থাকো।

বুড়ো লোকটি নৌকা বানাবার জন্য গাছের গুঁড়ি কেটে নিয়ে চলে গেলো। আপেল গাছটি এতে খুশি হলো। কিন্তু সেই যে বুড়ো গেলো আবার অনেকদিন এলো না। গাছটি তার ডাল নেড়ে পথের দিকে চেয়ে থাকে। গাছের প্রিয় খোকা আর আসে না। এতে আপেল গাছটি আবার একা হয়ে গেলো।

অনেক অনেক দিন কেটে গেলো। থুড়থুড়ে বুড়োর বেশে সেই ছেলেটি এসে দাঁড়ালো গাছের কাছে। তাকে দেখে গাছ বললো, তোমাকে দেওয়ার মতো আর কিছুই আমার কাছে নেই। আপেলও নেই যে তোমাকে খেতে দেবো প্রিয় খোকা!

খোকা বললো, আমার প্রায় একটিও দাঁত নেই। আমি কী করে আপেল খাবো? গাছ বললো, আমার ডালপালাও নেই যাতে তোমাকে দোল খাওয়াবো।

তোমার ডালে ঝুলে দোল খাওয়ার ইচ্ছে আর নেই আমার, আমি এখন অনেক বুড়ো।

আমার গুঁড়িও আজ নেই যা বেয়ে তুমি উপরে উঠতে পারো।

আমার শরীরে চড়বার সেই শক্তিও বাকি নেই আজ।

গাছ বলতে থাকলো, খোকা! প্রিয় আমার, আমি খুবই দুঃখিত। তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই বাকি নেই। আমি এখন কেবলই একটা মরা গাছের শেকড়। খোলা বললো, একটু শান্তিতে বসার জায়গা ছাড়া এখন আর কিছুই চাই না। আমি খুব ক্লান্ত।

সামান্য মাথা বেরিয়ে থাকা গাছটি নড়েচড়ে সোজা হওয়ার চেষ্টা করলো। বলল, এসো খোকা, একটা পুরনো গাছের গুঁড়ি বসবার জন্য ভালো জায়গা। তুমি আরাম করে বসো।

বুড়ো লোকটি গাছের গুঁড়িতে বসলো। এতে খুশি হলো আপেল গাছটি।