রাজকন্যার ধাঁধা

লরেন থম্পসন যুক্তরাষ্ট্রের একজন শিশুসাহিত্যিক। তার কিছু বই হলো- ‘লিটল কোয়াক সিরিজ’, ‘পোলার বিয়ার নাইট’, ‘দ্য অ্যাপল পাই দ্যাট পাপা বেকড’ ও ‘ব্যালেরিনা ড্রিমস: অ্যা ট্রু স্টোরি’।

সাজিদ মোহনসাজিদ মোহন
Published : 25 March 2024, 07:03 PM
Updated : 25 March 2024, 07:03 PM

অনেকদিন আগের কথা। পারস্যে বাস করতেন এক সুলতান। তার ছিলো অনেক পুত্র, কিন্তু কন্যা মাত্র একজন। আজিজা। রাজকন্যার নাম। সুলতান চাইতেন, কন্যা যেন জ্ঞানী ও সুখী হয়।

রাজ্যসেরা পণ্ডিতের কাছে আজিজা শিখল তাবৎ জ্ঞান। তবে তার প্রিয় বিষয় সংখ্যা, প্রিয় খেলা ধাঁধা। দেখতে দেখতে বড় হলো আজিজা। ঘনিয়ে এলো বিয়ের সময়। উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে লাগলেন সুলতান। কে হবে এ তল্লাটে আমার মেয়ের উপযুক্ত পাত্র? সুলতান উপদেষ্টাদের জিজ্ঞেস করলেন। আমার বড় ছেলেটা খুব সুদর্শন জনাব। বলে উঠলেন একজন উপদেষ্টা। লোভে চকচক করে উঠল তার চোখ।

ছোট ছেলেটা আমার খুবই চালাক চতুর। বললেন আরেকজন উপদেষ্টা। লোভে লকলক করে উঠল তার জিহ্বা। সুলতানের পরামর্শদাতারা কেবল নিজের ছেলেদেরই সুপারিশ করছিলেন। রাগে সুলতান গর্জে উঠলেন। যথেষ্ট পরামর্শ দিয়েছেন। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন সবাইকে।

বাবার পাশে বসলো আজিজা। বলল, আমার কাছে বর পছন্দ করার আরেকটি ভালো উপায় আছে। সুলতান জানেন, মেয়ে তার বুদ্ধিমতী-লক্ষ্মী এবং তিনি চান মেয়ের সুখ। বল মা, তোর পরিকল্পনাটা শুনি। সুলতান জানতে চাইলেন। মনে মনে আজিজা এমন কাউকে চায়, যে হবে মনের মতো। পছন্দ-অপছন্দ দুজনেরই হবে কাছাকাছি। দুজন হবে একই ধ্যান ধারণার, একজন আরেকজনকে যাতে বুঝতে পারে সহজে। মনের মানুষ খুঁজে পাওয়ার উপায় কিন্তু আজিজার জানা। সে ভীষণ বুদ্ধিমতী।

আমাকে একটা ধাঁধা বানাতে দাও। বলল আজিজা। ধাঁধার হবে শুধু একটি উত্তর। যে দিতে পারবে ধাঁধার উত্তর, তাকেই বিয়ে করলে আমি হবো সবচেয়ে সুখী। ধাঁধা! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন সুলতান। হ্যাঁ, আজিজা ধাঁধাটি শোনালো- ‘উপরে বসাও, বড় জিনিসকে ছোট করে ফেলবে। পাশে বসাও, ছোট জিনিসকে বড় করে ফেলবে, গণনার ক্ষেত্রে সবসময় এটি প্রথমে আসে যেখানে অন্যরা বাড়ায়, সেখানে এটি রাখে অপরিবর্তনীয়।’

অন্য শহরের একজন সৈনিক তার উত্তর নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। যুদ্ধ, অস্ত্র, রক্ত, উল্লাস, ক্রন্দন- এসব নিয়েই তার পৃথিবী।

কী এটি? সুলতান অনেকক্ষণ ভাবলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ধাঁধাটা আমার জন্যও ভীষণ কঠিন। এই রাজ্যে মনে হয় না এমন কেউ আছে, যে এর সমাধান করতে পারবে। থাকতেও তো পারে! বলল আজিজা। এবং ওই একজনকেই আমার প্রয়োজন।

রাজকন্যার প্রস্তাবে রাজি হলেন সুলতান। পরদিন ক্যারাভানে চেপে আজিজা বের হলো মনের মানুষের খোঁজে। প্রতিটা গ্রামে, গঞ্জে, শহরে রাজকন্যার ধাঁধার খবরটি ছড়িয়ে দিলো বার্তাবাহক। ‘এক ধাঁধা, এক উত্তর। চেষ্টা করুন।’ উচ্চস্বরে বলতে লাগলো বার্তাবাহক। মাত্র একজনই জয় করে নিতে পারবে রাজকন্যার মন।

জায়গায় জায়গায় থামল তারা। যুবক থেকে বৃদ্ধ, চেষ্টা করলো সবাই। দিতে পারলো না সঠিক উত্তর। এক গ্রামে এগিয়ে এসে উত্তর দিলেন এক জ্যোতির্বিদ। পণ্ডিত মানুষ। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রের গতিবিধি নিয়ে তার গবেষণা। ধ্যানজ্ঞান জুড়ে তার ছায়াপথ, মহাকাশ, নীহারিকা। এর বাইরে কিছুই ভাবতে পারেন না তিনি। ভাবার সময় নেই।

ধাঁধাটির উত্তর হবে- সূর্য। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন তিনি। ধাঁধাটি ছায়ার কথা বলে। সূর্য যখন আমাদের উপরে থাকে সবচেয়ে বড় মানুষটিকেও তখন ছোট মনে হয়, কারণ তার কেবল একটি ছোট ছায়া থাকে। কাজেই উত্তর হবে সূর্য। তিনি ব্যাখ্যা করলেন। বুঝতে পেরেছি, বলল আজিজা। কিন্তু ধাঁধার সঠিক উত্তর এটি নয়।

অন্য শহরের একজন সৈনিক তার উত্তর নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। যুদ্ধ, অস্ত্র, রক্ত, উল্লাস, ক্রন্দন- এসব নিয়েই তার পৃথিবী। এসবের বাইরে তিনি কিছুই বোঝেন না, বুঝতে পারেন না। তরবারি! জ্বলজ্বল করা বাঁকা তরবারিটি দেখিয়ে চিৎকার করে উঠলো সৈনিক। ধাঁধাটি যুদ্ধের কথা বলে। অবশ্যই উত্তর হবে তরবারি। যুদ্ধে একজন দুর্বল ব্যক্তির পাশে একটি তরবারি থাকলে সে খুব শক্তিশালী। ব্যাখ্যা করলো সে।

উত্তরটি চমৎকার, বলল আজিজা। কিন্তু ধাঁধার সঠিক উত্তর এটি নয়। আরেক শহরের পথ আগলে দাঁড়ালো এক ব্যবসায়ী। সম্মানীয় রাজকন্যা! নরম গলায় বললো সে। আপনার ধাঁধার উত্তর মিলে গেছে। ধাঁধাটি পৃথিবীতে বেঁচেবর্তে থাকার উপায় সম্পর্কে বলে। এর উত্তর ‘টাকা’। প্রত্যেকেই জানে মূল্যায়ন করার সবক্ষেত্রে টাকা সবসময় প্রথমে আসে। সে ব্যাখ্যা করতে করতে আজিজার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসলো যেন তাকে জুয়া খেলায় জিতেছে।

আরেকটি উত্তর কি শুনবেন? বলল আহমেদ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আজিজা বলল, শুধু একটি?

টাকাই পৃথিবীর সব। লাভ, ক্ষতি, সুদ, মুনাফা এসব নিয়ে ব্যবসায়ীর জীবন। সে মনে করে টাকাই পৃথিবীকে অনুভব করার একমাত্র মানদণ্ড। আপনার উত্তর ধাঁধার চেয়েও চাতুর্যপূর্ণ। ক্লান্ত হয়ে বলল আজিজা। কিন্তু উত্তরটি ভুল।

আমি কি আরও একবার চেষ্টা করতে পারি? প্রশ্ন করলো ব্যবসায়ী। আজিজা বলল, না। এক ধাঁধা, এক উত্তর। হতাশা ঘিরে ধরল রাজকন্যাকে। বাবার অনুমানই সম্ভবত সঠিক। রাজ্যের কেউই জানে না ধাঁধার উত্তর। ক্যারাভানকে সে বলল প্রাসাদে ফিরে যেতে। কাফেলা যখন ফিরে যাচ্ছে, সামনে এসে হাজির হলো অপরিচিত এক যুবক। একজন কৃষক। নাম আহমেদ এবং আজিজার মতো সেও সংখ্যা ভালোবাসে।

আরেকটি উত্তর কি শুনবেন? বলল আহমেদ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আজিজা বলল, শুধু একটি? ধাঁধাটি সংখ্যা নিয়ে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল আহমেদ। আর এর উত্তর হবে ‘১’। ভগ্নাংশের জন্য, একটি বড় সংখ্যার উপর স্থাপন করা ‘১’ একটি ছোট সংখ্যা তৈরি করে। ১০০ সংখ্যাটি বড়, কিন্তু এক শতাংশ ছোট। ব্যাখ্যা করলো সে।

হ্যাঁ, এটাই। বলল আজিজা। বলে যাও। ১ যখন আরেকটি সংখ্যার পাশে বসে সংখ্যাটি বড় হয়ে যায়, বলল আহমেদ। ৯ এর বাম পাশে ১ বসলে হয় ১৯। অথবা ডান পাশে বসে হয় ৯১, হেসে বলল আজিজা। আহমেদ বলে চলল, গণনার সময় ১ সবসময় প্রথমে বসে। যেমন- ১, ২, ৩। সত্যি অপূর্ব! আনন্দে আজিজা আত্মহারা। গুণের ক্ষেত্রে ১ অন্য সংখ্যাগুলোর মান ধরে রাখে, যখন অন্যান্য সংখ্যা মান বাড়িয়ে দেয়। দশ এক-এ দশ। কিন্তু দশ দুগুণে বিশ, তিন দশ-এ ত্রিশ। এবং এসব কারণেই, আহমেদ বলল, আপনার ধাঁধার উত্তর হলো ‘১’।

চমৎকার উত্তর! বলল রাজকন্যা। এটাই সঠিক। এ উত্তরের মাধ্যমে তুমি আমার হৃদয় জিতে নিলে। এই ধাঁধার মাধ্যমে তুমিও আমার হৃদয় জিতে নিলে, বলল আহমেদ। আহমেদকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরল আজিজা। বিয়ে হলো তাদের। আহমেদকে কৃষিবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা বানালেন সুলতান। আজিজাকে বানালেন গণনাবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা।