ভ্রমণ কাহিনি
আজ থেকে আড়াইশ বছর পূর্বে এই বাড়িটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থ যা এখনকার ‘ওয়ার্ডসওর্থ হাউজ’।
Published : 12 Sep 2024, 01:23 PM
গ্রীষ্মের মধ্যলগ্নে ব্রিটেনের বৃক্ষমঞ্জরি সবুজ পত্র-পল্লবের শোভা আর নানা রঙের উজ্জ্বল ফুলের আলোকচ্ছটায় মাতিয়ে দেয় প্রকৃতির রূপ।
ট্রেনে কিংবা হাইওয়েতে এসময় ভ্রমণে মাইলের পর মাইল লংড্রাইভে এমন নয়ন মনোহর নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখলে প্রকৃতির প্রেমে পড়বেন যে কেউই। চোখে পড়বে সবুজ মাঠে ঘাস খাচ্ছে ভেড়ার পাল, ঘোড়া কিংবা গরু। কখনো দেখবেন ফসলের মাঠে ছড়িয়ে রয়েছে সোনালি ফসল।
যান্ত্রিক আশীর্বাদে ফসলের মাঠ থেকে কৃষক কিংবা কৃষানি কায়িক পরিশ্রমে নিজেদের ফলন আর সংগ্রহ করেন না। যেমনটি আগে করতেন নিতান্তই আনমনে নিরলসভাবে, কখনো গুনগুন করে গান গেয়ে। ফসলের মাঠে কাজের সমান্তরালে কৃষকের আপন মনে গেয়ে যাওয়া মিষ্টি সুর কখনো কখনো আমাদের মনে ভীষণ আলোড়ন তোলে।
তেমনি আলোড়ন তুলেছিল আজ থেকে আড়াইশ বছর আগে জন্ম নেওয়া ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থের চিত্তে। ছাত্রজীবনে পাঠ্যপুস্তকে ‘দ্য সলিটারি রিপার’ কিংবা ‘ড্যাফোডিল’ কবিতা দুটি যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। এই ইংরেজ কবি প্রকৃতির নৈসর্গিক শোভায় বিমুগ্ধ জীবন ও রোমান্টিকতাকে অনবদ্য কাব্যে বর্ণনা করে অমর হয়ে আছেন। পরিচিতি পেয়েছেন ‘প্রকৃতির কবি’ হিসেবে।
প্রথমোক্ত কবিতাটি ওয়ার্ডসওর্থ লিখেছিলেন স্কটল্যান্ড ভ্রমণকালে কাল্পনিক এক পাহাড়ি কৃষানির শস্য আহরণকালের গান নিয়ে। যে গানের ভাষা তিনি বোঝেননি, তার সুরে মুগ্ধ হয়েছিলেন। যে সুর পাপিয়া কিংবা কোকিলের সুমধুর কুহতানের মতোই সুরেলা ছিল।
গ্রীষ্মে কোথাও ঘুরে বেড়ানো হয়নি। হঠাৎ একটি বিশেষ কাজে দরকার পড়ল ম্যানচেস্টার যাবার। এডিনবরা থেকে ম্যানচেস্টার প্রায় চার ঘণ্টার ড্রাইভ। পথে অবশ্য সুযোগ আছে কিছু আকর্ষণীয় জায়গা ঘুরে বেড়ানোর। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত লেক ডিস্ট্রিক্ট এবং ব্ল্যাকপুল এর অন্যতম। লেক ডিস্ট্রিক্টের ককার মাউথ নামক জায়গায় উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থের বাড়ি।
সেখানে যাচ্ছি শুনে যেতে আগ্রহী হলেন এডিনবরায় বসবাসরত টিভি সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী হুমায়ুন কবির। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে। দুই দেশের সীমান্ত পেরোলেই ঘরবাড়ির নকশা ও কারুকাজের পার্থক্য সহজেই বোধগম্য হয়। মোটর ওয়েতে অনেকক্ষণ গাড়ি চালানোর পর বাড়িঘরের দৃশ্যমান পার্থক্যে আমরা সহজেই বুঝে গেলাম ইংল্যান্ডে চলে এসেছি।
ঝকঝকে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। ক্রেতাদের আনাগোনায় মধ্য প্রহরে এখানকার পাব আর রেস্তোরাঁগুলো চেয়ার টেবিলে পসরা সাজিয়ে রেখেছে তাদের বারান্দায়। রৌদ্রস্নানের সঙ্গে পানাহার ব্রিটিশদের চিরায়ত ঐতিহ্য। বাংলাদেশ কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে গরমের তীব্রতার কারণে দূরের সৌরলোক উপেক্ষা করতে বলা হয়। এখানে তার উল্টো। একে সূর্যের আলো মিষ্টি, দ্বিতীয়ত এখানে ঝলমলে সূর্যের আলো পাওয়া যায় এমন হাতেগোণা দিন শুধু গ্রীষ্মেই মিলে।
গুগল ম্যাপ আমাদের নিয়ে গেল একেবারে ওয়ার্ডসওর্থ হাউজের দোরগোড়ায়। ছোট একটি গলি দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেলাম। কারণ নির্দিষ্ট পাস ছাড়া গাড়ি রাখার জায়গা নেই এবং ঘোরানোরও সুযোগ নেই। অগত্যা পার্শ্ববর্তী একটি ভবনের আঙিনায় গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে আসলাম পার্কিংয়ের তালাশে। কিছুটা দূরে গিয়ে পেলাম বিশাল এক পার্কিং।
সেখানে পার্কিংয়ের জন্য যখন টিকিট কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই এক দম্পতি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন তাদের টিকিটে এখনও ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে। যেহেতু তারা চলে যাচ্ছেন আমরা চাইলে তাদের টিকেট নিতে পারি। যদিও টিকিটের ঘণ্টা প্রতি রেট খুব বেশি ছিল না তবুও তাদের এমন উদারতায় আমরা ধন্যবাদ সহকারে টিকিটটি নিয়ে নিই।
মাত্র কয়েক মিনিট হেঁটেই আমরা পৌঁছে গেলাম ওয়ার্ডসওর্থের বাড়ির সামনে। একপাশে ‘ওয়ার্ডসওর্থ হাউজ’ নামে একটি স্মারক সামগ্রী বিক্রির দোকান। আপাতত খোলা নেই। বাড়ির মূল প্রবেশদ্বারও বন্ধ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আজ থেকে আড়াইশ বছর পূর্বে এই বাড়িটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থ যা এখনকার ‘ওয়ার্ডসওর্থ হাউজ’। বাড়িটি নির্মিত হয় ১৭৪৫ সালে এখানকার কাম্বারল্যান্ড প্রদেশের প্রধান বিচারপতি জশোয়া লুককের জন্য। পরবর্তীতে স্থানীয় একজন জমিদার জেমস লাওদার বাড়িটি কিনে নেন।
তিনি এখানে বিনা ভাড়ায় থাকতে দেন জন ওয়ার্ডসওর্থকে যিনি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থের পিতা এবং লাওদারের প্রতিনিধি। এই বাড়িতে অবশ্য কবি বাস করেছিলেন শৈশবে। ৮ বছর বয়সে মাকে হারালে তারা আর এই বাড়িতে থাকেননি। আরো পাঁচ বছর পর কবির বাবাও মারা যান। তখন খালি হয়ে যায় এই বাড়ি।
পরের দেড় বছর বাড়িটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বসতভিটা ছিল। এর অবস্থান শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হওয়ায় ১৯৩০ সালে স্থানীয় একটি বাস কোম্পানি সেটি কিনে নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাড়ি ভেঙ্গে সেখানে একটি বাস-স্টেশন নির্মাণ করবে। একই সময়ে স্থানীয় একটি লাইব্রেরিও চেষ্টা করেছিল বাড়িটি কিনে নিতে, কিন্তু তাদের ফান্ডে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না।
বিষয়টি রেডিও ও সংবাদপত্রে ব্যাপক প্রচার পায়। ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা অনুদান প্রদান করলে বাড়িটি কিনে নেওয়া হয় লাইব্রেরির পক্ষ থেকে। প্রদান করা হয় জাতীয় ট্রাস্টে। তাদের তত্ত্বাবধানে ১৯৩৯ সালের ৩০ জুন থেকে এটি ‘ওয়ার্ডসওর্থ মেমোরিয়াল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছে।
২০০৪ সালে বাড়িটিতে আরও সংস্কার করা হয় এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থের ছোটবেলায় যেরকম ছিল সেভাবেই সাজানো হয়। অষ্টাদশ শতকের প্রথায় বিন্যস্ত রান্নাঘর, বাচ্চাদের শয়নকক্ষ, কবির পিতার অফিসকক্ষ এবং পরিবারের ব্যবহার্য অন্যান্য কক্ষগুলোও অতীতের সাজশয্যায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
বাড়ির পেছনের বাগান যা ডারউইন্ট নদীর তীরে অবস্থিত সেটিকেও অষ্টাদশ শতকের সৌষ্ঠবে রাখা হয়েছে। নদীর কলকল কলরবে সেখানে অপূর্ব এক নৈসর্গিক আবহ বিরাজ করছে। এ বাড়িটির অপরূপ প্রাকৃতিক শোভাই হয়তো কবির অবচেতন মনে নিসর্গ প্রেমকে তার কাব্যের অন্যতম এক অনুপ্রেরণা হিসেবে উদ্দীপ্ত করেছে।
ওয়ার্ডসওর্থ হাউজের বিপরীত দিকেই রয়েছে নানা বৈচিত্র্যময় ফুলের সমারোহে সাজানো একটি বাগান। মনোরম পরিবেশের এই বাগানটি ওয়ার্ডসওর্থ মেমোরিয়াল নামেই পরিচিত। ভেতরে কবির একটি আবক্ষ ভাস্কর্য, যেন একান্ত নিভৃতে নিসর্গকে অবলোকন করছেন কবি। দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে- ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি?’
লেখক পরিচিতি: লেখক ও ব্লগার, যুক্তরাজ্যের এডিনবরায় বসবাসরত।