একাত্তরের লালচিঠি

ফেরদৌসী হক লিনুর মতো মেয়েবিচ্ছুরা একাত্তরে যা করেছেন তা ছিল অন্যরকম এক মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে জানান দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে সাহসী করে তোলার কাজটি তারা করেছিলেন গেরিলাদলের মতোই।

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 10 Jan 2023, 00:33 AM
Updated : 10 Jan 2023, 00:33 AM

গল্পটা ফেরদৌসী হক লিনুর। তার বাবার নাম কাজী ইউসুফ আলী এবং মা জোহরা কাশেম। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে, পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়নপুরে।

বাবা চাকরি করতেন পাকিস্তান সরকারের এস্টাবলিশমেন্ট ডিপার্টমেন্টে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আজিমপুর স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্রী।

১৯৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। তবু বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তান সরকার। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেও স্থগিত করে ইয়াহিয়া খান। ফলে সারা দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।

ওই সময় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। প্রতিবাদে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান তারা। এছাড়া এ সংগ্রাম পরিষদ থেকে প্রতিটি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কমিটি করে দেওয়া হয়। আজিমপুর এলাকায় কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শহীদুল ইসলাম সানু। মূলত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থেকেই একাত্তরে নানা কাজ করেছেন ফেরদৌসী হক লিনু।

তাদের কাজ কী ছিল? লিনু বলেন, ‘একটা কিছু ঘটবে – এটা নিশ্চিত ছিলাম। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করানো শুরু হয়। ৭ মার্চের পর আমিসহ শিরীন আপা, শামসুন্নাহার ইকু আপা, ফোরকান আপা, সাকি আপা, রাবেয়া আপা, মমতাজ আপা ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে আসা ছাত্রীরা ওই ট্রেনিংয়ে অংশ নেন। আমরা ট্রেনিং করি দুদু ভাই ও পেয়ারু ভাইয়ের কাছে। ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলে এ ট্রেনিং।' 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাস থেকেই আজিমপুর কলোনির ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যেতে থাকে। লিনুরাও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য গোপনে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কথা ছিল সহপাঠী রোজী ও তার ছোট বোন বেবীর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার। তাদের নিয়ে যাবেন ছাত্রলীগের রফিক ভাই (‘লিটল কমরেড’ বলে পরিচিত)। কিন্তু সেটি আর সম্ভব হয় না। নেতাদের কাছ থেকে খবর আসে, দেশে থেকেই কাজ করতে হবে তাদের। শুনে কয়েকদিন খুব মন খারাপ থাকে লিনুদের।   

কী কাজ করবেন – এমন কোনো নির্দেশনা ছিল? লিনুর ভাষায়, ‘সেটা ছিল না। এর মধ্যে শিরিন আপাদের নিচতলায় আসে ফৌজিয়া খালাম্মারা। তিনি প্রবলভাবে স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। আমাদের নানা কাজে যুক্ত থাকেন খালাম্মাও। পাশের বাসাতেই ছিলেন আফজাল সাহেব। আমার খালাতো ভাই আলী হায়দার তখন পুলিশে চাকরি করেন। আমাদের বাসায় থেকেই লেখাপড়া করে মানুষ হয়েছেন। উনিও তখন পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেন। পাকিস্তানপন্থী পরিবারগুলো ক্রমেই কলোনিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। যেসব বাসা থেকে ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তাদের বাড়িতে দু-একজন দালাল গিয়ে হুমকি ও ভয় দেখানো শুরু করে। ঠিক তখনই আমরা কলোনির পাকিস্তানপ্রেমী ও দালালদের শায়েস্তা করার পরিকল্পনা আঁটি।’

কীভাবে? ‘নিজেরা মিলেই চিঠি লিখলাম। লালচিঠি। লেখা থাকত – ‘তোমরা যে দালালি করছ, এ খবর চলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তোমাদের শায়েস্তা করা হবে।’ শিরীন আপা, আমি আর ফৌজিয়া খালাম্মা চিঠিগুলো লিখি। শিরিন আপার ছোট বোন বেবী ও ভাই নিলুর বয়স তখন বারো বা তেরো বছর হবে। ওদেরসহ বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেটারবক্সে চিঠি ফেলে আসতাম। পরদিন সকালে নানা অজুহাতে ওইসব বাসায় ঘুরতে যাই। তখন দেখতাম চিঠি পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে তাদের রান্না হয়নি, নাওয়া-খাওয়াও বন্ধ। এটা আমাদের খুব আনন্দ দিত। মনে হতো শায়েস্তা করতে পেরেছি। বিচ্ছুদের মতো এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা শুরু হয়।

এর মধ্যে সানু ভাই ট্র্রেনিং থেকে ফিরে আসেন। উনি সেক্টর টু-এর অধীনে কাজ করতেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সজীব ভাইদেরও। সানু ভাই চিঠির কথা শুনে বললেন, ‘এভাবে তো হবে না, লিফলেট করতে হবে।’

লিফলেট কেন? 'বাড়ি বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের খবর পৌঁছাতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধজয়ের খবর, পাকিস্তানিদের গণহত্যার খবর মানুষকে জানাতে হবে। আজিমপুর কলোনির বেশিরভাগই তখন সচিবালয়ে চাকরি করেন। তাই কলোনির বাড়ি বাড়ি লিফলেট পৌঁছাতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগের খবরগুলো দ্রুত সচিবালয় হয়ে পাকিস্তান সরকারের কানে পৌঁছাবে। শুনে আমরা রাজি হয়ে যাই।' 

তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারীকে দিয়ে গোপনে সাইক্লোস্টাইল করে লিফলেট বানিয়ে আনেন। কলোনির কাছের বিল্ডিংগুলোতে বেবী ও নিলু আর দূরের বাড়িগুলোতে আমি, লিটু (শিরীন আপার ভাই) আর শিরীন আপা সন্ধ্যায় হাঁটার নাম করে দরজার নিচ দিয়ে লিফলেট ফেলে আসতাম। এ কাজে ভয় ছিল; কিন্তু ভয়কে জয় করেই কাজ করেছি আমরা। 

একবার পরিকল্পনা করি আজিমপুরের রাস্তায় পোস্টারিং করার। কারণ ওখানকার সড়কে পাকিস্তানি আর্মিদের চলাচল ছিল বেশি। ফৌজিয়া খালার পরামর্শে রংতুলি দিয়ে পাকিস্তানি সেনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি এঁকে পোস্টারে লেখা হয় – ‘পাক আর্মি সারেন্ডার করো।’ লিটু ও সানু ভাই মিলে পাইওনিয়ার প্রেস থেকে গোপনে পোস্টার ছাপিয়ে আনে।

ওই পোস্টার গোপনে দেয়ালে লাগাতে হবে। কীভাবে সেটা করব? সে চিন্তাতেই রাত পার। তারপর আমি আর শিরীন আপা ফজরের আজানের পরপরই আটা দিয়ে আঠা তৈরি করে পোস্টার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কলোনির গেটের বাইরের রাস্তায় পোস্টার লাগিয়ে দৌড়ে গেটের ভেতর ঢুকে যেতাম। মসজিদে যাওয়ার মানুষ যেন না দেখে, এ-কারণে বিল্ডিংগুলোর সিঁড়িঘরে লুকিয়ে যেতাম। সকালে দেয়ালে পোস্টার দেখে কলোনির সবাই অবাক হয়। তারা আলোচনা করতে থাকে, কলোনিতেই মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি রয়েছে।

পোস্টারিং হওয়ার কিছুদিন পর আজিমপুর কলোনির রাস্তার পাশের বাড়িগুলোতে পাকিস্তানি আর্মিরা তল্লাশি চালায়। ওরা বুঝে যায়, কলোনির ভেতর থেকেই কেউ এটা করছে। কিন্তু কেউ চিন্তাও করেনি, এগুলো কলোনির মেয়েদের কাজ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কাজ করেছি আমরা। স্বাধীনতালাভের পর ওই পোস্টারের একটি কপি বাংলা একাডেমির আর্কাইভে জমা ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

একাত্তরে ঈদ উদযাপন না করার নির্দেশ দিয়ে রমজানের সময় আজিমপুরের মেয়েবিচ্ছুর দল কলোনির বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করেছিলেন। কীভাবে তা করেছিলেন তারা? সেই পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত শুনি মেয়েবিচ্ছু ফেরদৌসী হক লিনুর মুখে।

‘বান্ধবী মলি থাকত ধানমণ্ডি ৫ নম্বরে। তার বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা খুব ভালো ছিল। ওকে ডেকে এনে শিরিন আপার বাসায় বসিয়ে চিঠি লেখাই। চিঠির মূল বিষয় ছিল এমন – ‘দেশের মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করছে। তাই জাঁকজমক করে ঈদ উদযাপন করা যাবে না, নতুন জামাকাপড় পরা থেকে বিরত থাকতে হবে, পরলে তার কাপড় নষ্ট করে দেওয়া হবে। পশ্চিম পাকিস্তানি পোশাক বর্জন করতে হবে, মুক্তিবাহিনীকে সব রকম সহযোগিতা করতে হবে। তা না হলে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।’

শেষে লেখা হলো – জয় বাংলা, জয় শেখ মুজিব। বিনীত – স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংগ্রামী বোনেরা।

কিন্তু ওই চিঠিতে ছবি আঁকতে হবে। সেটা কীভাবে করি? সানু ভাইকে বলতেই তিনি চারুকলার অধ্যাপক শামসুল ইসলামকে দিয়ে ডাস্টবিনে খাবার খাচ্ছে মানুষ, দেশের অবস্থা মুমূর্ষু এবং অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকিয়ে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ওই চিঠি তৈরি করে দেন। একাত্তরের পুরো রোজার মাস আজিমপুর কলোনির বাড়িগুলোতে গোপনে আমরা ওই চিঠি বিলি করেছি। সানু ভাইদের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়ও এ চিঠি বিলি করা হয়েছিল।

চিঠিতে কী কাজ হয়েছিল? লিনু বলেন, ‘অবশ্যই। শুধু চিঠি বিলি করেই আমরা থেমে থাকিনি। কেউ যদি ঈদে নতুন কাপড় পরে তাহলে তার কাপড় নষ্ট করতে হবে। সানু ভাই অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের ল্যাব থেকে সালফিউরিক অ্যাসিড চুরি করে এনে দেন। সিরিঞ্জ কেনা হয় ফার্মেসি থেকে। সিরিঞ্জে অ্যাসিড নিয়ে কাপড় নষ্ট করার অস্ত্র তৈরি করেছিলাম আমরা। সাতাশ রমজানের সময় নতুন কাপড় পরে ঈদে আনন্দ প্রকাশের কথা বলেছিল কলোনির কয়েকজন। অ্যাসিড দিয়ে গোপনে ওদের কাপড়গুলো ছিদ্র করে দিই। এ-খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কলোনিতে। ফলে ভয়ে ঈদের দিনও নতুন কাপড় পরে কেউ আর বের হয়নি।’

ফেরদৌসী হক লিনুর মতো মেয়েবিচ্ছুরা একাত্তরে যা করেছেন তা ছিল অন্যরকম এক মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে জানান দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে সাহসী করে তোলার কাজটি তারা করেছিলেন গেরিলাদলের মতোই। তাদের কাজে জীবনের ঝুঁকি ছিল অনেক বেশি। তবু বুকের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্নকে লালন করে একাত্তরে এমন যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন আজিমপুরের মেয়েবিচ্ছুরা। তাই একাত্তরে তাদের অবদান অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

কিডজ ম্যাগাজিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!