ভ্রমণ কাহিনি
ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ দরবার, অসংখ্য সিপাহী-মন্ত্রী আর বিলাসিতা- এসবই তো প্রাসাদে দেখা যায়!
Published : 05 Sep 2024, 11:04 PM
রেশমের তৈরি রাজকীয় পোশাক পরা এক ব্যক্তি সুন্দরভাবে দরবার কক্ষে প্রবেশ করছেন, তার মাথায় জ্বলজ্বল করছে হীরাখচিত মুকুট। উপস্থিত সবাই সম্মান ও প্রশংসার ভঙ্গিতে তার সামনে মাথা নত করলো। লোকটার কমনীয়তা, শরীরের ভাষা এবং মুখ যেন উজ্জ্বল সূর্য। তিনি সিংহাসনে উঠে গেলেন, বসলেন এবং সামান্য মাথা নত করে সবাইকে বসতে বললেন।
কোন ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র বা নাটকে এমন দৃশ্য আমরা কোথাও নিশ্চয়ই দেখেছি। ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ দরবার, অসংখ্য সিপাহী-মন্ত্রী আর বিলাসিতা- এসবই তো প্রাসাদে দেখা যায়! তেমনই একটি প্রাসাদে আমরা উঁকি দিতে যাচ্ছি, জোসেন রাজাদের রাজ্যে এর নাম ‘খিয়ংবোকগুং প্রাসাদ’।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে অবস্থিত এ প্রাসাদ আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। কোরিয়রা একে ‘পবিত্র প্রাসাদ’ হিসেবেই চেনে। ‘খিয়ংবোকগুং’ শব্দের অর্থ হলো ‘স্বর্গ থেকে পাওয়া মহান প্রাসাদ’, এর পেছনে রয়েছে বুগাকসান পর্বত এবং সামনে নমসান পর্বত।
এ প্রাসাদের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। প্রাচীন কোরিয়া এবং এর স্থাপত্য সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে এর প্যাভিলিয়ন, গেইট, ব্রিজ এবং প্রাচীরঘেরা মাঠ। ভেতরে ঢুকলেই অনুভব করা যায় জোসেন রাজবংশের উত্তাপ। এ রাজবংশের পাঁচটি রাজকীয় প্রাসাদের মধ্যে এটি একটি।
১৩৯৫ সালে জোসেন রাজবংশের প্রথম শাসক রাজা তাইজো ‘খিয়ংবোকগুং প্রাসাদ’ নির্মাণ করেন। পরবর্তী ২০০ বছর রাজা তাইজং ও রাজা সেজং প্রাসাদের আয়তন সম্প্রসারণ করেন। ১৫৫৩ সালে একটি অগ্নিকাণ্ডের পর রাজা মিয়ংজং একে পুনরুদ্ধারের আদেশ দেন।
এই সময়ে প্রাসাদটি রাজপরিবারের আবাসস্থল ছিল এবং প্রাসাদের দেয়ালের পেছনে বিভিন্ন হলগুলোতে রাজকীয় দায়িত্ব পালন করা হতো। প্রায় ৩ হাজার লোক এ প্রাসাদে বাস করত। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ জন ছিলেন রাজপরিবারের সদস্য, আর ছিল ২ হাজার পাহারাদার সৈন্য এবং ৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী।
প্রাসাদের ছাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে বিভিন্ন প্রাণী আকৃতির ছাদের টাইলস এবং আলঙ্কারিক চিত্র। প্রাসাদের প্রধান ছাদের দুই প্রান্ত ড্রাগন ও ঈগলের মাথা দিয়ে সাজানো। ভাবা হতো, এ প্রাণীগুলো প্রাসাদকে আগুন থেকে ‘রক্ষা করবে’।
ইমজিন যুদ্ধে জাপানি আক্রমণের সময় ১৫৯২ সাল পর্যন্ত খিয়ংবোকগুং প্রাসাদটি সম্প্রসারিত হতে থাকে। পরবর্তীকালে ১৮৬৭ সালে এটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। পুনরায় খিয়ংবোকগুং প্রাসাদ আবার সিউলের হৃদয় এবং কোরিয় রাজপরিবারের প্রতীক হয়ে ওঠে।
দুঃখজনকভাবে, ১৮৯৫ সালে আবারও ট্র্যাজেডি ঘটে যখন সম্রাজ্ঞী মিয়ংসেংকে এ প্রাসাদে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুর পর তার স্বামী সম্রাট গোজং প্রাসাদ ছেড়ে যান। ১৯১০ সালের শুরুতে কোরিয়ায় জাপানি দখলদারিত্বের সময় খিয়ংবোকগুং প্রাসাদের দশটি ভবন বাদে সবগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
১৯৮৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার দেশটিতে ধ্বংস হওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থাপনা সংস্কারে উদ্যোগী হয়, খিয়ংবোকগুং প্রাসাদের পুনরুদ্ধার পরিকল্পনাও এর অংশ ছিল এবং এরই মধ্যে অনেক সংস্কার শেষ হয়েছে। আপনি যখন প্রাসাদের মাঠে ঘুরে বেড়াবেন, তখন কল্পনায় হয়তো সেই সময়ের রাজদরবারের মাঝে হারিয়ে ফেলবেন নিজেকে।
এ প্রাসাদে অনেকগুলো ঐতিহাসিক কোরিয় নাটক, টেলিভিশন শো ও চলচ্চিত্রের চিত্রধারণ করা হয়েছে। যেমন ‘গবলিন’, ‘মাই স্যাসি গার্ল’, ‘টেম্পারেচার অফ লাভ’ এবং ‘লিজেন্ড অফ দ্য ব্লু সি’ ইত্যাদি।
ইতিহাস তো জানা হলো, এবার আসি পরিবহন ও টিকিট প্রসঙ্গে। প্রাসাদটি স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় খোলে, তবে ভিড় এড়াতে কয়েক মিনিট আগে পৌঁছানোই বুদ্ধিমানের কাজ। সপ্তাহে মঙ্গলবার ছাড়া অন্যান্য দিন বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে।
প্রাসাদটিতে প্রবেশমূল্য ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সবার জন্য ৩ হাজার কোরিয়ান ওন। সিউলের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস বা ট্যাক্সিতে অল্প সময়ে এখানে পৌঁছে যাওয়া যায়।
রাজকীয় বাসভবন, পাঠাগার ও জাদুঘরসহ একাধিক স্থাপনা ঘুরে দেখতে পারবেন এই প্রাসাদের ভেতর। খানিকটা বিশ্রাম নিতে পারবেন সবুজে ছায়াঢাকা মাঠ অথবা পদ্মফুলের পুকুরপাড়ে বসে, কল্পনায় রাজদরবারের পাইক পেয়াদাদের হাল-হাকিকত উপভোগ করতে পারবেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় এলে খিয়ংবোকগুং প্রাসাদ থাকতে পারে আপনার পছন্দ তালিকার শীর্ষে।