রংধনুর সাত রং মনে রাখতে যে শব্দটি ব্যবহার করি তা হচ্ছে- বেনীআসহকলা। এটি তৈরি করা হয়েছে সাত রঙের প্রথম অক্ষর দিয়ে।
Published : 13 Dec 2023, 01:45 PM
শিরোনাম পড়ে মনে হতে পারে খুবই আজগুবি একটা ব্যাপার। রংধনুর আবার ফুল হয় নাকি! আসলে বিষয়টা ঠিক সেরকম কিছু নয়। রংধনুর ভেতর কোনো ফুল না থাকলেও এক ধরনের রঙের খেলা থাকে। আমরা সেইসব বর্ণাঢ্য রঙ দেখে অভিভূত হই।
আমরা নানা রকম রং পছন্দ করি। সে কারণে প্রকৃতির বিচিত্র রঙও আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু আমরা প্রকৃতিতে যা কিছু দেখি, তা হুবহু মানুষ বানাতে পারে না। অনেকটা কাছাকাছি যেতে পারে মাত্র। কারণ প্রকৃতির নিজস্ব রংটা মানুষ শুধু কল্পনা করতে পারে।
পাতার কথাই ধরা যাক- একটি পাতার রং সময়ের ব্যবধানে আমূল বদলে যেতে পারে। তবে এই বদলানো রং শিল্পীর আঁকায় কাছাকাছি একটা রূপ দাঁড় করাতে পারে মাত্র। তাহলে এবার দেখা যাক আমরা রংধনুর ৭টি রং প্রকৃতির অন্য কোনো উপাদান থেকে মেলাতে পারি কিনা।
রংধনুর সাত রং খুব সহজে মনে রাখার জন্য আমরা যে শব্দটি ব্যবহার করি তা হচ্ছে- বেনীআসহকলা। এ শব্দটি তৈরি করা হয়েছে সাত রঙের প্রথম অক্ষর দিয়ে। অক্ষরগুলো অর্থসহ সাজালে যে ৭টি রং পাওয়া যায় তা হলো- বেগুনি, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা আর লাল। আমাদের চারপাশে যে বিশাল ফুলের সাম্রাজ্য সেখান থেকেই এর কাছাকাছি রঙের ফুলগুলো খুঁজে বের করা যায়।
এবার তাহলে আমরা ফুলের রং থেকেই রংধনুর রঙগুলো সাজাতে চেষ্টা করবো। যদিও একই রঙের অনেক ফুল রয়েছে, আমরা প্রতীক হিসেবে শুধু একটি রঙের জন্য একটি ফুলই বেছে নেবো। আরেকটি কথা, ফুলের রং হুবহু একইরকম না-ও হতে পারে। তবে কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছি।
বেগুনি রং: জারুল
জারুল ফুল না চিনে কোনো উপায় নেই। নজরকাড়া শোভা দেখে আমরা খুব সহজেই তাকে চিনতে পারি। গরমের দিনে টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়া, কনকচূড়ার উপচানো হলুদ আর হলুদ সোনালি রঙের সোনালুসহ অনেক ফুলের ভিড়ে উজ্জ্বল বেগুনি রঙের একমাত্র বড় ফুল জারুল। জারুল আমাদের দেশের জলা জায়গার গাছ। শীতে গাছের সবপাতা ঝরানোর পর মরার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
জারুল মাঝারি আকারের গাছ। পাতা লম্বা, চওড়া এবং গাঢ়-সবুজ। খসে পড়ার আগে লালচে রঙের হয়। কোনো কোনো গাছের মাথা ঝাঁকড়া। ডালপালা কিছুটা রুক্ষ। চৈত্র মাসের প্রথম দিকেই কচিপাতার সঙ্গে বেগুনি রঙের ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। থাকে অনেকদিন, প্রায় বর্ষার প্রথমভাগ পর্যন্ত। এ রঙের এত বড় ফুল আর কোনো বড় গাছে নেই। কোমল লাবণ্যময় এই শোভার বৈজ্ঞানিক নাম: Lagerstroemia speciosa.
নীল রং: নীল অপরাজিতা
অপরাজিতা আমাদের বেশ চেনা একটি ফুল। গাছ লতানো ও বর্ষজীবী। গাছের গোড়ায় পানি জমলে আর বাঁচে না। বাঁশের বেড়া, গেইট ও রেলিং কিংবা যে কোনো বাহন পেলেই এরা বেড়ে উঠতে পারে। ফুল দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। একারণেই ইংরেজি নাম Butterfly Pea। আমাদের দেশে সাধারণত নীল, সাদা ও বেগুনি এই তিন রঙের অপরাজিতা দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নীল অপরাজিতা। গাছটি অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ে বলে অনেকেই বাগানের সৌন্দর্যের জন্য নির্বাচন করেন। গাছ লতা ঝোপময় ও চিরসবুজ। ফুল একপাপড়ি বিশিষ্ট, অন্য পাপড়িগুলো অফোটা অবস্থায় গুচ্ছবদ্ধ থাকে। মাঝখানে একটি সাদা বৃন্ত আছে। ফল দেখতে অনেকটা শিমের মতো। ফুল ফোটার মৌসুম গ্রীষ্ম থেকে শরৎকাল পর্যন্ত। বৈজ্ঞানিক নাম: Clitoria ternatea.
আসমানী রং: জ্যাকারান্ডা
জ্যাকারান্ডা আমাদের দেশি গাছ নয়; জন্মস্থান অনেক দূরের দেশ ব্রাজিল। সুন্দর এই গাছটি আমাদের দেশে প্রায় ৭০-৮০ বছর আগে এসেছে। গোড়ায় পানি জমলে এগাছ আর বাঁচে না। গাছ বাড়ে খুব ধীরে, ফুল ফুটতেও লাগে অনেক বছর। মাঝারি ধরনের শীতের দেশগুলোতে এফুল বেশি পরিমাণে ফোটে। ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও ধানমন্ডি এলাকায় বেশ কয়েকটি গাছ চোখে পড়ে। জ্যাকারান্ডা মাঝারি আকারের পাতাঝরা গাছ। কাণ্ড মসৃণ ও হালকা ধূসর রঙের। পাতা চিরল চিরল ও কারুকার্যময়। গ্রীষ্মের প্রথমভাগেই নতুন পাতা গজাতে শুরু করে। তার পরপরই ডালের আগায় থোকায় থোকায় ফুল ফুটতে শুরু করে। ফুলের রঙ বেগুনি, দেখতে নলাকার ও ২ ইঞ্চি লম্বা। বৈজ্ঞানিক নাম: Jakaranda mimosifolia.
সবুজ রং: ছাতিম
ছাতিমের আরো কয়েকটি নাম আছে- যেমন ছাতিয়ান, ছাইত্তান, সপ্তপর্ণী ইত্যাদি। এগাছ সারাদেশেই দেখা যায়। বাক্স-প্যাকিং ও দেশালাইয়ের কাজে ব্যবহার হওয়ায় গ্রামে শিমুল গাছের মতো এইগাছও প্রচুর পরিমাণে কাটা পড়ছে। ছাতিম গাছ চেনা খুবই সহজ। এগাছের সরল কাণ্ড কিছু দূর উপরে উঠে হঠাৎ শাখা-প্রশাখার একটি ঢাকনা সৃষ্টি করে আবার একলাফে একে ছাড়িয়ে অনেক দূর উঠে যায়। একারণে অনেক দূর থেকেই ছাতিম গাছ চেনা যায়। ছাতিম ১৫ থেকে ২০ মিটার উঁচু, দুধকষভরা ভারি সুন্দর গাছ। একসঙ্গে কখনই এগাছের পাতা ঝরে না। পাতা প্রায় ১৮ সেন্টিমিটার লম্বা, মসৃণ, উপরটা উজ্জ্বল সবুজ আর নিচের পিঠ সাদা রঙের। শরতের শেষে সারা গাছ ভরে সবুজাভ-সাদা রঙের থোকা থোকা ও ছোট ফুল ফোটে। ফুলের গন্ধ বেশ তীব্র, অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ফুল শেষ হতে না হতেই সজোড় ফলগুলো থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে। বৈজ্ঞানিক নাম: Alstonia scholaris.
হলুদ রং: কনকচাঁপা
কনকচাঁপা নামটি আমাদের বেশ চেনাজানা হলেও ফুল ততটা চেনা নয়। কারণ এই ফুল খুব একটা দেখা যায় না। কেউ কেউ শখ করেও নাম রাখেন কনকচাঁপা। সিলেট এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ে এগাছ আছে। চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত গাছটির নানা পরিবর্তন চোখে পড়ে। এসময় প্রথমেই তামাটে রঙের কচি পাতায় ভরে ওঠে গাছ। তারপর ফুটতে শুরু করে হলুদ সোনালি রঙের ফুলগুলো। ফুলের পাপড়ি অনেক, সারা গাছ জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফোটে। ফুলের সুবাসে বাতাস সুরভিত হয়, ভোমরা ছুটে আসে পরাগ-রেণুর লোভে। সবশেষে আসে ফল। আদিনিবাস আমাদের দেশসহ মিয়ানমার ও ভারত। গাছের শিকড় সাঁওতালরা কাজে লাগায়। তাছাড়া ছালের রস হজমিকারক। বৈজ্ঞানিক নাম: Ochna squarrosa.
কমলা রং: সোনাঝুরি লতা
সোনাঝুরি লতা আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায় না। উজ্জ্বল রঙ ও প্রাচুর্যের কারণে এফুলকে বাগানের অগ্নিশিখা বলা যেতে পারে। এগাছের মূল নাম গোল্ডেন শাওয়ার। উজ্জ্বল কমলা রঙের ফুলগুলো অনেক দূর থেকেই আমাদের নজর কাড়ে। ফুল ফোটার মৌসুম শীত-বসন্ত হলেও আমাদের দেশে শীতের শুরুতেই ফুল ফোটে এবং ফুলের শোভা থাকে অনেকদিন। এরা নমনীয়, পাতাঝরা ও ঝুলন্ত শাখাপ্রশাখাসহ লম্বা লতার গাছ। একটানা প্রায় ৭৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাতার উপরটা মসৃণ, ৪ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা, শীর্ষ পাতা শাখায়িত এবং আকষীতে রূপান্তরিত। ঝুলে থাকা মঞ্জরির ফুলগুলো নলের মতো, প্রায় ৫ সেন্টিমিটার লম্বা, কিছুটা বাঁকা ও মুখ বিভক্ত। গন্ধ নেই। বৈজ্ঞানিক নাম: Ochna squarrosa.
লাল রং: কৃষ্ণচূড়া
কৃষ্ণচূড়া সবার প্রিয় একটি ফুল। লাল টুকটুকে উজ্জ্বল রঙের এ ফুলটি অনেক দূর থেকেই আমাদের চোখে পড়ে। তবে গ্রীষ্মের ফুল হলেও আমাদের কবিরা ভুল করে বসন্তের নানা উপমায় কৃষ্ণচূড়ার কথা বলেছেন। এ গাছ মাঝারি আকারের, মাথার দিকটা এলোমেলো আর ডালগুলো নিচের দিকে নুয়ে থাকে। পাতাগুলো খুবই সুন্দর, বড় একটা ডাঁটার ডালে চিকন চিকন সব পাতা, দেখতে ঝালরের মতো। শীতে সবগুলো পাতা ঝরে যায়। গরমের শুরুতে একপশলা বৃষ্টি হলেই মরা ডালে নতুন পাতার আগেই ফুলের কুঁড়িগুলো উঁকি দিতে শুরু করে। তখন গাঢ়-লাল, লাল, কমলা, হলুদ এবং হালকা-হলুদ রঙের ফুলে ফুলে ভরে ওঠে গাছ। দূর থেকে গোটা গাছটাকেই একটি বিশাল ফুলের তোড়া মনে হয়। এমন রং-রূপ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। বৈজ্ঞানিক নাম: Delonix regia.