সাক্ষাৎকারবাংলাদেশ যা চায়, তাই দেওয়া উচিত: সুনীল

মনমোহন সিংয়ের উচিত ঢাকা সফরে একদম উদার হয়ে যাওয়া। ভারতের দরকষাকষি করা উচিত নয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2011, 03:18 AM
Updated : 6 Sept 2011, 03:18 AM
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকদের একজন। ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সংস্থা সাহিত্য একাডেমির সভাপতিও তিনি। সাহিত্য একাডেমি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়নে একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। বাঙালির ঘরে ঘরে উচ্চারিত এই লেখকের গল্প উপন্যাস থেকে ছবি বানিয়েছেন সত্যজিৎ রায় ও গৌতম ঘোষের মতো চিত্র পরিচালকেরা। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এই লেখকের পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম আলো, সেই সময়সহ বিভিন্ন উপন্যাস এদেশে খুব জনপ্রিয়।
দুই বাংলায় জনপ্রিয় এই লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
এস এন এম আবদি
প্রশ্ন: বাংলাদেশ বললেই চোখের সামনে কি ভেসে ওঠে?
উত্তর: আমি তো জন্মেইছি ওখানে! একগাদা ঝলমলে স্মৃতি রয়েছে ওখানকার। ১৯৩৪ সালে মাদারীপুরের কাছেই পূর্ব মাঝিপাড়া বলে এক গাঁয়ে আমার জন্ম। বাবা ছিলেন কলকাতায় স্কুলের মাস্টার। কিন্তু গরম আর শীতের ছুটিতে প্রায়ই পূর্ব পুরুষের ভিটায় যেতেন তিনি। ১৯৪২ সালে যখন জাপানিরা কলকাতায় বোমা ফেলতে শুরু করলো তখন বাবাই আমাদের মাঝিপাড়ায় বছর খানেকের জন্য রেখে আসেন। আমি তো মাঝিপাড়ার একটা স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলাম। যুদ্ধের কারণে কলকাতায় তখন স্কুল-কলেজ সব বন্ধ করে দেওয়া হয়।
জাপানিরা ছিল ভাত-খেকো। জাপানের ভূমি আগ্রাসনের ভয়ে ব্রিটিশ সরকার চালের মজুদ সব আটকে রাখল। তখন আমাদের তিন বেলা আলু খেয়েই টিকে থাকতে হতো। পকেটে করে আলুভাজা নিয়ে যেতাম স্কুলে। দুপুরের খাবারের সময় স্কুলের দপ্তরি লবণ এনে দিত। ক্লাসরুমে তখন রীতিমতো আলুর লড়াই। যাদের টাকা ছিল তারা অবশ্য চাল আর অন্য খাবার দাবার কিনে খেতে পারতো।
আমরা কলকাতায় ফিরে আসি ১৯৪৩ সালে। আমি বেশ কয়েকবারই বাংলাদেশে গিয়েছি। কিন্তু ২০০৮ এর আগে মাঝিপাড়ায় যাওয়া হয়নি। সেটা অবশ্য আলাদা গল্প।
প্রশ্ন: আপনার দিক থেকে মনমোহন সিং এবং শেখ হাসিনার প্রতি কোনো পরামর্শ রয়েছে কি?
উত্তর: ১৯৭১ সালেই আমার একটা উপলব্ধি হয় যে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কটা স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। আমি স্বাধীনতার পরপরই ওখানে গিয়েছি। সবাই আনন্দে ভাসছে। আবার সকলেই কিন্তু বাংলাদেশ চায়নি। পাকিস্তানের পরাজয় অনেকের কাছেই তেতো লাগছিল। অনেকে এমন ব্যাখ্যাও দিতে চাইলেন যে, ভারত নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। অনেকে বললেন ভারতীয় সেনাবাহিনী কখনোই বাংলাদেশ ছাড়বে না। ছোট ভাইয়ের চোখে বড় ভাই সাধারণত সন্দেহভাজন। আমি জানি না ভারত কখনো এই বিরাট প্রতিবন্ধকতা পার হতে পারবে কি না।
ড. সিংয়ের উচিত ঢাকা সফরে একদম উদার হয়ে যাওয়া। ভারতের দরকষাকষি করা উচিত নয়। ভারতের উচিত বাংলাদেশে যা চায়, তাই দিয়ে দেওয়া। কিন্তু এতেও হয়ত সমস্যাটার সমাধান হবে না। কিন্তু দেওয়ার মাধ্যমেই আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা করতে পারি।
ড. সিং এবং শেখ হাসিনাকে অবশ্যই ভিসার বিষয়টা তুলে নিতে হবে। ভিসার ব্যাপারটা স্রেফ ঝেড়ে ফেলুন। এতে মানুষে মানুষে বাঁধনটা পোক্ত হবে। বিশেষ করে আমি চাইব যে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে আসুক, দেখুক সেখানে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র আছে। ভারতের মুসলমানরা হয়তো কোথাও কোথাও সব সুযোগ সুবিধা পান না, কিন্তু তারা একেবারে খারাপ নেই। যদি তারা পুরোপুরি বৈষম্য বা অন্যায়ের শিকার হন, তাহলে তারা শুধু আদালতেই না, সিভিল সোসাইটির কাছেও যেতে পারেন।
কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশের হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। শেখ হাসিনা পর্যন্ত দেশটাকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে পারেননি।
প্রশ্ন: ভিসাপ্রথা রদ করা ছাড়া আপনি আরো কী প্রস্তাব করবেন?
উত্তর: রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক সম্পর্ক দুটোই যথেষ্ট শক্ত নয়। সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করা প্রয়োজন। যেমন- রবীন্দ্রনাথের দেড়শতম জন্মবার্ষিকী এখন দুদেশই পালন করছে। কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একই হওয়া উচিত।
কলকাতার বইমেলায় বাংলাদেশের প্রকাশকরা অবাধে বই বিক্রি করতে পারেন। সেখানে ফি বছর একটা আস্ত প্যাভিলিয়নই থাকে বাংলাদেশী বইয়ের। বেশী দিন হয়নি শেখ হাসিনা কলকাতার বইমেলা উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বইমেলাগুলোতে ভারত একদম অনুপস্থিত।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ কেমন আসা হয়?
উত্তর: বছরে এক-দুইবার তো বটেই। দুমাস আগেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছরের উদযাপন অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম ঘুরে আসার সুযোগ হয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ কি খুব দ্রুত বদলাচ্ছে না?
উত্তর: গত এক দশকে দুটো বিষয়ের কথা বলতে পারি। নারীশক্তির উত্থান এবং নারীদের ভেতর শিক্ষার হার বাড়া। কাজের ক্ষেত্রে এখন অনেক নারী। তারা রোজগার করছে, সংসার চালাচ্ছে। নারীশিক্ষার হার পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। এটা বিরাট সাফল্য। কিন্তু এখানটায় তা ব্যর্থ হয়েছে।
আমার ধারণা গার্মেন্ট শিল্প নারীদের অন্তঃপুর থেকে টেনে এনেছে। তারপর তারা আর পেছনে ফিরে তাকায়নি।
প্রশ্ন: ২০০৮ এর মাঝিপাড়া প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গে ফেরা যাক
উত্তর: পুরো কৃতিত্বটা রাজ্জাক হাওলাদারের। তিনি মাঝিপাড়ারই সন্তান, কানাডার মন্ট্রিলে আইনপেশায় নিয়োজিত। তিনি আমার বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে আবিষ্কার করেন আমি তারই গাঁয়ের লোক। তখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে মাঝিপাড়া যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। আমি তো প্রথমে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তখন আমার স্ত্রীকে যাকে বলে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে, এই ২০০৮ এ নিয়ে এলেন।
রাজ্জাক আমাদের ভিটেয় একটা দুই ঘরের বাড়ি তুলেছেন। সেখানে এখন লাইব্রেরি আর ক্লিনিক। প্রতিবছর ৭ সেপ্টেম্বর আমার জন্মদিনে সেখানে সুনীল মেলা হয়। আমি এক হাজার বই দিই লাইব্রেরিতে। আর আমার ডাক্তার বন্ধুরা ওষুধ পাঠান। রাজ্জাক এখন আমাদের ঘরের মানুষ।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো আর খারাপ দিক কী?
উত্তর: আপনি যদি ঢাকা সপ্তাখানেক থাকেন, বেশি খেয়েই মারা পড়বেন। বাংলাদেশের আতিথেয়তার এটা সবচেয়ে বড় হ্যাপা।
পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেন বাংলাদেশীদের ভালোবাসা পেয়েছি। সে মালয়শিয়া হোক, ইতালি কি জার্মানি। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায় মনে আছে ৩৫ বছর বয়স্কা এক লাজুক নারী এসে বললেন, আমি নাকি তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছি। তার কঠিন অসুখ হয়েছিল। জার্মান এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডাক্তারকে বাঁচার সম্ভাবনার কথা জিজ্ঞেস করতেই, ডাক্তার বলত 'দেখা যাক'। তিনি ডাক্তারকে বলেন, মরার আগে আমার পূর্ব পশ্চিম উপন্যাসটা শেষ করে যেতে চান। ওটা প্রায় হাজার পৃষ্ঠার বই। তখন তার নাকে নল দেওয়া। নার্সরা পাতা উল্টিয়ে দিতেন, তিনি পড়তেন। আশ্চর্যজনক ভাবে বইটা যেদিন শেষ হলো, তিনি সেরে উঠলেন। তাই তিনি ধন্যবাদ জানালেন তার এই নবজীবনের জন্য।
আমি তাকে বললাম, আপনিও আমায় অমূল্য একটা জিনিস দিলেন। তিনি বললেন সেটা কি? আমি বললাম নোবেল প্রাইজ।
বাংলাদেশীরা তাদের সংস্কৃতিটাকে ধরে রেখেছে। অন্যদিকে ভারতীয় বাঙালিদের দেখুন, একবার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বনে গেলে সাহিত্যপাঠে ইতি।
প্রশ্ন: কলকাতা আর ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা বাংলার যৌথ সংস্কৃতির কথা বলে থাকেন। কিন্তু আপনি কি মনে করেন না, ধর্ম ভারত আর বাংলাদেশকে পৃথক করে রেখেছে?
উত্তর: হ্যাঁ, ধর্ম একটা বড় বাধা অবশ্যই। ধর্মের প্রশ্নটা ছিল না বলে দুই জার্মানি এক হতে পেরেছিল। কিন্তু আমি কি দুই বাংলার একত্রকরণ চাই? না। যত দিন না মৌলবাদকে বিদায় করা যাচ্ছে সমস্যা আর সংঘাত বাড়বেই। ততদিন বন্ধুবৎসল পড়শি হয়েই কাটানো যাক।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, অনিন্দ্য রহমান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম