বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক এই সদস্য এক সাক্ষাৎকারে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উদ্যোক্তা, ব্যবস্থাপক ও নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের (অডিট ফার্ম) মতো কোম্পানির ভেতরের লোকেরাই পুঁজিবাজারের অনিয়ম ‘সবচেয়ে বেশি’ করেন, কারণ তারা আগে থেকেই তথ্যগুলো জানেন।
“এই ইনসাইডারদের তথ্যের ভিত্তিতে শেয়ারবাজারে অনেক অনিয়ম হয়। এ বিষয়ে আইন থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বল; এ আইনের মাধ্যমে ইনসাইডারদের চার্জশিটের আওতায় আনা যায় না।”
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ অনুসরণ করে বাংলাদেশে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ বন্ধে আরও কঠোর আইন করার ওপর জোর দেন আরিফ খান।
“আমাদের আইনটাকে ব্যাপক পরিবর্তন করে ইনসাইডার ট্রেডিং যারা করে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এগুলো করলে পুঁজিবাজারের উপর মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।”
বর্তমান বিধি অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বার্ষিক হিসাব শেষ হওয়ার দুই মাস আগে থেকে শুরু করে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে ওই হিসাব চূড়ান্তভাবে বিবেচিত, গৃহীত বা অনুমোদিত হওয়া পর্যন্ত উদ্যোক্তা, পরিচালক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী, নিরীক্ষক বা নিরীক্ষাকার্যে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, পরামর্শক বা আইন উপদেষ্টা, কিংবা বেনিফিশিয়াল ওনার সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার ক্রয়, বিক্রয় কিংবা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তরের সুযোগ নেই।
ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে সর্বশেষ সংশোধিত এই বিধি জারি হয় ২০১০ সালের মার্চ মাসে। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বর ও পরের বছর জানুয়ারিতে শেয়ারবাজারে নামে বড় ধস।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করা, শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত দেখানো ও ইনসাইডার ট্রেডিং ওই ধসের পেছনে বড় ভূমিকা রাখে।
এরপর স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশনসহ একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে আরও কার্যকর কোনো আইনি উদ্যোগ দেখা যায়নি।
ওই ধসের পর পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিমালা সংশোধনে অধ্যাপক খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আরিফ খান। ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছর তিনি বিএসইসির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশে আর্থিক সেবা খাতে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) এমবিএ ডিগ্রিধারী আরিফ খানের। ১৯৯১ সালে আরব-বাংলাদেশ ব্যাংকে (এবি ব্যাংক) তার কর্মজীবন শুরু হয়।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখন অনেক শক্তিশালী হয়েছে, নতুন সফটওয়্যার এসেছে, ভাল টিম সেখানে কাজ করছে। তবে এই উন্নয়নের কোনো শেষ নেই।
“আমরা যদি সিঙ্গাপুরের সাথে তুলনা করি আমাদের উন্নয়নের অনেক জায়গা আছে। আমাদের দেশের স্টক মার্কেটে যে কারসাজি হয় সেটাকে ধরার জন্যে আমাদের নজরদারি আরও শক্তিশালী করতে হবে।”
তার মতে, সাত বছর আগের ধসের পর বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে অনেকগুলো ইতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার শক্তি ও পেশাদারিত্ব বেড়েছে।
আরিফ খান
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বৈশ্বিব সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনের (আইওএসসি) কাছ থেকে বিএসইসির ‘এ’ ক্যাটাগরির স্বীকৃতি পাওয়াকে একটি ‘বড় অর্জন’ হিসেবে বর্ণনা করেন আরিফ খান।
“আমাদের সরকার স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচুয়ালাইজ করেছে- সেটাও একটা বড় পরিবর্তন।”
আরিফ খান বলেন, কোম্পানির বিভিন্ন মূল্য সংবেদনশীল তথ্যসহ আর্থিক প্রকৃত তথ্য দেওয়া নিশ্চিত করতে আর্থিক বিবরণী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এর কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দায়ীদের দণ্ড ও জরিমানা হলে তবেই মানুষ আর্থিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য বিশ্বাস করবে।
ব্যাংকের আমানতের তুলনায় মুনাফার হিসাবে চলতি বছর বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি ‘বেশ ভাল’ ছিল বলে মন্তব্য করেন আর্থিক খাতের এই বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের পুঁজিবাজারে মুনাফা প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। বাজারে ১০০ টাকা রাখলে তা ১২৫ টাকা হয়েছে।
“কিন্তু ১০০ টাকা যদি ব্যাংকে রাখতেন কত টাকা মুনাফা হতো? ৭ শতাংশের বেশি না। তাহলে ব্যাংকে রাখলে ৭ শতাংশ আর পুঁজিবাজারে রাখলে ২৫ শতাংশ। অতএব ২০১৭ সাল আমাদের পুঁজিবাজারে অত্যন্ত ভাল ছিল।”
তাছাড়া ব্যাংকের আমানতের সুদের হার গত তিন বছরে ১২/১৩ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যার ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়েছে বলে মনে করেন আরিফ খান।
“যে কারণে পুঁজিবাজার ভাল করবে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, এখন দেশে সুদের হার ৩ বছর আগের তুলনায় অনেক কম। মানুষ যখন দেখে পুঁজিবাজারে টাকা রাখলে এফডিআর থেকে বেশি পাওয়া যাবে- তখন মানুষ টাকা পুঁজিবাজারেই রাখবে।”
তাছাড়া বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ফ্রন্টিয়ার মার্কেট’ হিসেবে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।
“২০১০ সালে যখন পুঁজিবাজারে ধস নেমেছিল তখন বাজার ছিল গুজবনির্ভর। এখন কিন্তু অনেক ভাল বিনিয়োগ হচ্ছে। ১০০ জনের মতো প্রশিক্ষিত ছেলে-মেয়ে এই বাজারে তাদের অবদান রাখছে।
“আগামী বছর কেমন যাবে সেটা হয়ত বলা যাবে না। তবে বলা যায় যে, আগামী বছর পুঁজিবাজারের মুড ভাল থাকবে।”
পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নতির জন্য আইনি ভিত্তি শক্ত করার পাশাপাশি পুঁজিবাজারের বাইরে থাকা অনেক ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করার ওপর জোর দেন আরিফ খান।
তার সঙ্গে বন্ড মার্কেটের উন্নয়নসহ আরও নতুন কোনো ডেরিভেটিভের (কেনা-বেচার আগাম চুক্তি) নতুন কোনো পণ্য চালু করা যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।
“ডেরিভেটিভ হয়তো এখুনি চালু করা যাবে না, কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্ক এখন করে রাখতে হবে।”
তিনি বলেন, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ উৎপাদন, ব্রিজ-কালভার্টসহ বড় অবকাঠামো তৈরি করতে বাংলাদেশের প্রতিবছর ২০ বিলিয়ন ডলার দরকার।
“এই ২০ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ কোথা থেকে পাবে? হয় নিজেরা জোগাড় করতে হবে অথবা বিশ্ব ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান দেবে। ওরা কিছুটা দেবে, কিছুটা আমরা আনব- বন্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ছাড়া এই টাকা জোগাড় সম্ভব নয়।
“বন্ড মার্কেট তৈরি না করলে আমরা অবকাঠামো উন্নয়নে গতি আনতে পারব না। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে, পুঁজিবাজারকে উন্নত করতে হবে।”
পুঁজিবাজারে ‘অন্ধভাবে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়ে আইডিএলসির সিইও বলেন, “বাজার যতই ভাল থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষ কিন্ত সবসময় লাভ করতে পারে না। এই ভালোর মধ্যেই কিন্ত অনেক মানুষ লোকসান করে যাচ্ছে।”
কোন বিনিয়োগে লাভ বেশি
বিনিয়োগে কোম্পানি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ও সম্ভাবনাময় খাতের সঙ্গে অন্যান্য মৌলভিত্তি বিবেচনায় নেওয়ার পরামর্শ দেন আরিফ খান।
এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে আইডিএলসির উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা সম্ভাবনাময় খাত দেখে সাত বা আটটা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছি। যেমন টেলিযোগাযোগ, ওষুধ ও ব্যাংকিং ও জুতার ব্যবসায় ভালো প্রবৃদ্ধি আছে।
“অর্থাৎ প্রথমে আমরা ভাল খাত বেছে নেই। সেখান থেকে সবচেয়ে ভাল দুটি কোম্পানিকে আমরা খুঁজে বের করি। তারপর আমরা দেখি কার সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থাপনা আছে। তারপর আমরা তাদের পরিকল্পনা জানতে চাই।
“এরপর কেম্পানিটির উপরে কয়েক মাস ধরে গবেষণা করি। আমরা দেখি কোম্পানির শেয়ারের দাম কত। আমরা যদি দেখি কোম্পনি ভাল, কিন্তু শেয়ারের দাম বেশি তাহলে আমরা সেটা কিনি না।”
এর সঙ্গে ভালো ব্যবস্থাপনা, সুশাসন ও আর্থিক প্রতিবেদনের সংখ্যাগুলো বিশ্বাসযোগ্য কিনা তাও বিবেচনা করা হয় বলে জানান তিনি।
“তারপর আমরা দেখি তাদের দাম কি বেশি না কম। যদি বেশি থাকে তাহলে অপেক্ষা করি কখন তা কমবে। হাই মার্কেটে আমরা বিনিয়োগ করি না। আমরা প্রতি সপ্তাহে কিনে প্রতি মাসে বেচা-কেনা করি না; এক থেকে দুই বছর কখনো তিন বছর অপেক্ষা করি।”
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের যেহেতু এই পরিমাণ সক্ষমতা থাকবে না, তাদেরকে ভালো মিউচুয়াল ফান্ড খুঁজে বের করে বিনিয়োগের পরামর্শ দেন আরিফ খান।
“তবে সব মিউচুয়াল ফান্ড ভালো নয়। বাংলাদেশে কিন্তু দুর্বল মিউচুয়াল ফান্ডও আছে। আমাদের বের করতে হবে কোন মিউচুয়াল ফান্ড সবচেয়ে বেশি রিটার্ন দেয়।”
এছাড়া বিনিয়োগকারীদের অর্থ অন্য কোথাও সরানোর রেকর্ড নেই, টোটালি পোর্টফোলিও ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে- এমন কোম্পানি খুঁজে বের করার পরামর্শ দেন তিনি।
“আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে- ওপেন, ট্রান্সপারেন্ট, কমপিটেন্ট লোক কারা? কাদের মুনাফা আনার রেকর্ড আছে।”