সরকারি ভবনেই ‘মশার চাষ’, দায় নিতে নারাজ কর্তারা

“অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে দেখছি, সরকারি সংস্থাগুলোর বেজমেন্টেও মশার চাষ হচ্ছে”, কারওয়ানবাজারে অভিযান শেষে বলেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2023, 01:08 PM
Updated : 10 July 2023, 01:08 PM

ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহ বিস্তারের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে যখন জনসচেতনতায় জোর দেওয়া হচ্ছে, সে সময় সরকারি প্রতিষ্ঠানে অবহেলার চিত্র উঠে এল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অভিযানে।

সোমবার ঢাকার কারওয়ানবাজারে সরকারি ছয়টি সংস্থার বহুতল ভবনে গিয়ে চারটিতেই লার্ভার সন্ধান মেলে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বেইজমেন্টেই জমে ছিল পানি।

এই চিত্র দেখে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, তারা সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেটি মানছে না বেশিরভাগ মানুষ।

এই ভবনগুলোর চিত্র দেখে তিনি মন্তব্য করেছেন, “এখানে তো মশার চাষ হচ্ছে।”

অন্য অনেক প্রজাতি থেকে ডেঙ্গুর বাহক এইডিস মশার জীবনচক্র কিছুটা আলাদা। অন্যগুলোর মত এই প্রজাতির মশা ময়লা পানিতে জন্ম নেয় না। বাড়ির আঙিনায় বা ভবনে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতেই সাধারণত জন্ম নেয় সেগুলে।

দুই দশক আগে যখন দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে, তখন থেকেই, বিশেষ করে বর্ষায় সচেতন থাকতে আহ্বান জানানো হয়। কোথাও যেন পানি জমতে না পারে সেই বার্তা নানা মাধ্যমে দিয়ে আসছে নগর কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

এর মধ্যেও ডেঙ্গুর বিস্তার বেড়েই চলেছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার রোগী। মৃত্যু হয়েছে ৭৩ জনের। প্রতিদিনই এ সংখ্যাটি বেড়ে চলেছে। মানুষ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায়, কিন্তু সতর্কতা বাড়ছে কি?

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তিন দিন ধরে নগরীর বহুতল ভবনগুলোতে যে অভিযান শুরু করেছে, তাতে মানুষের অসচেতনতার বিষয়টি স্পষ্ট। অভিযানের তৃতীয় দিন সোমবার দেখা গেল, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোও এ বিষয়ে উদাসীন।

মেয়র আতিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে পেট্রোবাংলা, যমুনা অয়েল, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন-বিটিএমসি- এই চার প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিকে পাঁচ লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়।

একই এলাকায় জাহাঙ্গীর টাওয়ারের বেজমেন্টে জমে থাকা পানিতে লার্ভা দেখে জরিমানা করা হলে ভবনটির কর্মকর্তারা সেখান থেকে সটকে পড়েন। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বির আহমেদ ওই ভবনের অফিস বন্ধ করে দেন।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ঢাকা ওয়াসা ভবন এবং প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবনের বেজমেন্টেও চলে অভিযান। এই তিনটি ভবনে কোনো লার্ভা মেলেনি।

সব দায় ‘অন্যদের’ দিলেন কর্তা-ব্যক্তিরা

লার্ভা পাওয়ার ঘটনায় সরকারি সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সবাই দায় চাপিয়েছেন অন্যদের ওপর।

পেট্রোবাংলা ভবনে অভিযানের খবর শুনে নিচে আসেন সংস্থার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার। পানি সরে যেতে ভবন লাগোয়া সরু একটি নালায় লার্ভা থাকার বিষয়ে নিজের দায় অস্বীকার করে তিনি বলেন, পানি অপসারণে জন্য ১০দিন আগেই তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন।

 “পানি অপসারণের জন্য লোক নিয়োগ করেছি। আপনারা দেখেছেন সে কাজ করছে। এ অবস্থায় লার্ভা পাওয়া গেলে ঠিকাদার এবং আমার অফিসের লোক যারা আছে এরা দায়ী। এটা তাদের ব্যক্তিগত ফল্ট”, বলেন পেট্রোবাংলা প্রধান।

পাশেই যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের নিচতলায় লিফটের জন্য নির্ধারিত জায়গায় জমে থাকা পানিতে বিপুল পরিমাণ লার্ভার পাশাপাশি উড়ছিল মশাও।

যমুনা অয়েলের কর্মকর্তা তারিক আজিম বলেন, “আপনারা দেখেন সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে কিন্তু পানি সব সময় সরিয়ে দেওয়া হয়। এটা বেশি দিনের জমে থাকা পানি না।”

পাশের ভবনে অভিযানের খবরে টিসিবি ভবনের বেজমেন্ট পরিষ্কার করে ড্রেনে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। কিন্তু বেজমেন্টের পাশের ছোট নালায় জমে থাকা পানিতে লার্ভা পাওয়া যায়।

টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসানও দাবি করেন, তারা যথেষ্ট ব্যবস্থা নেন। তারপরও বড় এই ভবনের অনেকগুলো ড্রেনেজ সিস্টেমের কোথাও ‘দুয়েকটা গ্যাপ’ হতে পারে।

“আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি লার্ভা নিধন করতে। এখন বেশি বেশি বৃষ্টি হচ্ছে তাই প্রায়ই পানি জমা হয়ে যায়। এজন্য দুয়েকটা জায়গায় পাওয়া গেছে এটা খুবই কম। আমরা চেষ্টা করব একেবারে জিরো পর্যায়ে আনার জন্য”, বলেন তিনি।

সবচেয়ে বাজে অবস্থা দেখা গেছে বিটিএমসি ভবনের বেজমেন্টে। অভিযানের খবর শুনে সেখানেও বেজমেন্টের কিছু অংশের পানি সরিয়ে সেখানে ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হয়। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।

বেজমেন্টের বেশিরভাগ অংশ ছিল স্যাঁতস্যাঁতে। অনেক জায়গায় জমে থাকা পানি থেকে লার্ভা তুলে আনেন ডিএনসিসির পরিচ্ছন্ন কর্মীরা।

‘এ তো মশার চাষ’

মেয়র আতিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তারা ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছেন। যার যার আঙিনা পরিষ্কার করার আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু বিষয়টি মানছেন না বেশিরভাগ মানুষ।

“যার যার আঙিনা পরিষ্কার করে ফেললেই এইডিস মশা থেকে দূরে থাকা যায়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে দেখছি সরকারি সংস্থাগুলোর বেজমেন্টেও মশার চাষ হচ্ছে।

“বেজমেন্টে যেখানে গাড়ি রাখে সেখানে ড্রেনের মধ্যে মশা। আজ পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা দিয়েছেন কিন্তু পাঁচশো টাকা খরচ করলেই জায়গাটি পরিষ্কার রাখা যেত, মশামুক্ত রাখা যেত।”

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় শনিবার থেকে মাসব্যাপী অভিযান শুরু করেছে ডিএনসিসি। এর আগে শনিবার এবং রোববার দুই দিনে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২১ লাখ টাকা জরিমানা করেছে সংস্থাটি।