আরও মহামারী আসবে, প্রস্তুতিটা রাখতে হবে: ড. ফেরদৌসী কাদরী

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের দাপট চলার মধ্যেই নতুন মহামারী নিয়ে হুঁশিয়ার করলেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী। আর তা মোকাবেলার প্রস্তুতিও রাখতে বললেন তিনি।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2021, 05:27 AM
Updated : 10 Oct 2021, 11:53 AM

মর্যাদাপূর্ণ র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারজয়ী ফেরদৌসী কাদরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চলমান মহামারী, ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে কথা বলেছেন।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এই জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলেন, “বর্তমানে সবাই করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যস্ত। তবে অনেক রকম রোগ আসতে পারে। আজ কোভিড-১৯ আছে, কাল অবশ্যই অন্য কিছু আসবে। এজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

কেন এই শঙ্কা- তা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এমার্জিং প্যাথোজেন, যেটা নিয়ে আমরা অনেক চিন্তা করি, নিপাহ, ডেঙ্গু … পরিবর্তন সব জায়গায় হচ্ছে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়েল রেজিস্ট্যান্সও মারাত্মক জিনিস। একটা জীবাণু যদি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়, তাহলে কোনো ওষুধই কাজ করবে না। তখন চিহ্নিত রোগও মহামারী আকারে চলে যাবে। এমার্জিং এবং রি-এমার্জিং ইনফেকশন নিয়ে সচেতন থাকতে হবে।”

তবে ড. কাদরী মনে করেন, করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় করতে গিয়ে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে যে কাঠামো তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যতে কাজে আসবে।

“শুরুতে ৪-৫টা আরটি-পিসিআর ল্যাব ছিল, এখন এক হাজারের কাছাকাছি হয়েছে। আমরা এখন বায়োসেইফটি-২ তে কাজ করছি। বায়োহ্যাজার্ড নিয়ে সচেতনতা এসেছে। এখন আমাদের দায়িত্ব, সরকারের দায়িত্ব এই অবকাঠামো এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা যেন থাকে। এটা নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক আলোচনা থাকতে হবে।”

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে বাংলাদেশে এক সময় করোনাভাইরাসে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৬ হাজার, মৃত্যু আড়াইশ এবং শনাক্তের হার ৩২ শতাংশের উপরে উঠেছিল।

মাসখানেক ধরে সংক্রমণ নিম্নমুখী। শুক্রবার নতুন করে ৬৪৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এদিন ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা সাত মাসে সর্বনিম্ন। নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার ২ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

আইসিডিডিআরবি,র এই বিজ্ঞানী সংক্রমণের বিচারে দেশে বর্তমান পরিস্থিতি ‘ভালো’ বললেও নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আবার যে সংক্রমণ বাড়িয়ে দিতে পারে, তা নিয়ে সতর্কও থাকতে বললেন।

“গতবারও দেখেছিলাম সংক্রমণ কমেছিল। কিন্তু ডেল্টা আসার পর আবার বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের মনে রাখতে হবে, আরেকটা ওয়েভ আসতে পারে, ভ্যারিয়েন্ট আরেকটু চেঞ্জ হতে পারে। এটা আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করে, ভাইরাসের ক্ষমতা কমে গেছে কি না? কিন্তু আমি এখনও বলব না যে একেবারে কমে গেছে, ভাইরাসের ক্ষমতাটা এনডেমিক হয়ে গেছে। আমি এখনও সন্তুষ্ট হতে পারছি না।”

দেশে করোনাভাইরাসের টিকা ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তুষ্ট ড. ফেরদৌসী কাদরী। তবে টিকার সঙ্কট পুরোপুরি কাটাতেদেশে টিকা তৈরির উপর জোর দেন তিনি।

“আমরা কোভিড সম্পর্কে জানতাম না, ভ্যাকসিন সম্পর্কে ঠিকমতো বুঝতে পারি নাই। কিন্তু সেখান থেকে আমরা অনেক এগিয়ে এসেছি। এখন আমরা টিকা কিনছি, কোভ্যাক্স থেকে আনছি, পাশাপাশি নিজেরা তৈরি করার চেষ্টাও করছি। দেশে যদি টিকা তৈরি না হয়, আমরা সব সময় টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে থাকব।”

বিশ্বে টিকার ক্ষেত্রে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তার উপরও আলোকপাত করেন বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানী।

“বেশিরভাগ ধনী দেশ ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ টিকা তাদের নিজেদের জন্য রেখে দিচ্ছে। তারা বুস্টার ডোজের জন্য রেখে দিচ্ছে। তারা অনেক টিকা নষ্ট করছে। এমনিতে তো সব সময় বৈষম্য থাকে। কিন্তু টিকা নিয়ে বৈষম্যটা আমরা আরও বেশি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের কাছে আর টিকা আসত যদি উন্নত দেশগুলো এসব টিকা শেয়ার করতো।” 

গবেষণা হওয়া উচিৎ ‘দেশের বা্স্তবতায়’

কলেরা আর টাইফয়েডের টিকা তৈরি করে হাজারো মানুষের প্রাণ বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য চলতি বছরের র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন ড. ফেরদৌসী কাদরী। টিকার উন্নয়ন, উন্নত জৈব প্রযুক্তির চিকিৎসাবিদ্যা এবং জটিল গবেষণা লাখো মানুষের অমূল্য জীবন রক্ষায় ‘অসামান্য ভূমিকা’ রয়েছে ফেরদৌসী কাদরীর।

তবে গবেষণায় বাংলাদেশে পিছিয়ে থাকার জন্য অর্থকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করছেন এই বিজ্ঞানী। পাশাপাশি গবেষণাগার এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানেরও অভাবের কথা বলেন তিনি।

“বাংলাদেশে গবেষণার জন্য ফান্ডিং আছে, কিন্তু সীমিত। এত সীমিত অর্থে ভালো গবেষণা করা যায় না। আমাদের এখানে আইসিডিডিআর,বি ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান নাই যেখানে শুধু গবেষণা হয়।”

ড. কাদরী মনে করেন, বাংলাদেশে গবেষণা দেশের ‘বাস্তবতায়’ হওয়া উচিৎ। তা মাথায় রেখেই নিজের গবেষণার বিষয় নির্ধারণ করেন তিনি। এজন্য তিনি কলেরা রোগ, টিকা, রোগ নির্ণয় করা, টাইফয়েড, ইটেক ডায়রিয়া, পুষ্টি এসব বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন।

“যে গবেষণার বাংলাদেশে কোনো ভ্যালু থাকবে না, সেটা করে তো লাভ হবে না। আমরা বাংলাদেশে কলেরা, ডায়রিয়া এবং নানা ধরনের সংক্রামক রোগ সম্পর্কে জানি। ছোটবেলায় আমরা কলেরার টিকা নিয়েছি ওটাতে কোনো লাভ হত না। টাইফয়েডের টিকা দিত, সেটাও সেরকম কাজ করে নাই। এজন্য আমি জানতাম আমাদের দেশে কাজ (গবেষণা) এমন একটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে যা বাংলাদেশের কাজে লাগবে।”

যেদিন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারের পাওয়ার খবর জানলেন সেদিন ড. ফেরদৌসী কাদরীর স্বামী জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে। এ কারণে পুরস্কার পাওয়া নিয়ে সে সময় কোনো অনুভূতি কাজ করেনি।

তিনি বলেন, “সত্যি বলতে আমি এত বেশি চিন্তিত, এত বেশি কষ্টে ছিলাম ওই সময়, আমার কোনো অনুভূতি হয় নাই। আমাকে যদি বলা হত- কোনটা চাই, স্বামীর সুস্থতা না পুরস্কার? আমি অবশ্যই আমার স্বামীর সুস্থতা চাইতাম।

“কিন্তু পরে যখন চিন্তা করি, তোমরা সবাই আমার সাফল্য নিয়ে কথা বলতে চাও। সবাই এত সম্মান করছে, তখন আমি বুঝতে পারছি অ্যাওয়ার্ডটা কত উচ্চ ধরনের। আমি অনেক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, কিন্তু এটা যে অন্য সবগুলোর চাইতে বড়, সেটা আমি তখন বুঝি নাই, পরে বুঝেছি মানেটা কী। নিজের কাছেই অবাক লাগে আমাকে খুঁজে তারা পুরস্কার দিল!”

স্বাস্থ্য, জন্মগত রোগ নির্ণয়, শিশুদের বা বড়দের জন্য যেসব টিকা বাংলাদেশে আসা উচিৎ, এসব টিকা নিয়ে গবেষণা করতে চান ড. ফেরদৌসী কাদরী।

“পাশাপাশি বাংলাদেশে টিকা তৈরি হোক, তা নিয়ে কাজ করতে চাই। আমার গবেষণা দিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে আরও উন্নত করতে চাই।”