টিকার চাহিদা কতটা মেটাতে পারবে ভারত?

প্রতি বছর বিশ্বে যত টিকা উৎপাদিত হয়, তার ৬০ শতাংশের যোগান দেয় ভারত। কিন্তু এই মহামারীর মধ্যে করোনাভাইরাসের টিকার জন্য ভারতের নিজস্ব চাহিদাও কম নয়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Jan 2021, 06:49 PM
Updated : 10 Jan 2021, 06:53 PM

ভারতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে এক কোটি সাড়ে চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতিতে আগামী ১৬ জানুয়ারি থেকে সেখানে করোনাভাইরাসের টিকাদান শুরু হচ্ছে।

কিন্তু ভারতকে শুধু নিজেদের চাহিদা মেটালে চলবে না, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, বিশ্বের বহু দেশকে তাদের টিকা সরবরাহ করতে হবে।

ভারতের টিকা প্রস্তুতকারকরা সেজন্য কতটা প্রস্তুত, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা।

কত টিকা তৈরি করতে পারবে ভারত?

ভারতের ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রণক সংস্থা এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের দুটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে।

এর মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা ভারতে উৎপাদন এবং কোভিশিল্ড নামে বাজারজাত করবে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইনডিয়া। আর ভারতীয় কোম্পানি ভারত বায়োটেক তাদের টিকা বাজারজাত করবে কোভ্যাক্সিন নামে।

এর বাইরে আরও কয়েকটি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ল চলছে ভারতে, অনুমোদন পেলে সেগুলো সেখানেই উৎপাদিত হবে।

বিবিসি লিখেছে, ভারতের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো গত কয়েক মাসে নতুন যন্ত্রপাতি যুক্ত করে অথবা বর্তমান কাঠামোতে পরিবর্তন এনে করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির জন্য উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে।

এর মধ্যে টিকা উৎপাদনকারী সবচেয়ে বড় কোম্পানি সেরাম ইনস্টিটিউট বলেছে, প্রতি মাসে তারা ৬ থেকে ৭ কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকার যোগান দেওয়ার সক্ষমতা রাখে এখন।

আর ভারত বায়োটেক বলেছে, তারা বছরে ২০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করেছে। এখন পর্যন্ত তাদের মজুদে আছে ২ কোটি ডোজ কোভ্যাক্সিন।

ট্রায়ালে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ভারত সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে, যাতে অনুমোদন পেয়ে গেলে তারা টিকা বিক্রি করতে পারে।

বিবিসি লিখেছে, সব মিলিয়ে আগামী মাসগুলোতে ভারতে কত টিকা উৎপাদন সম্ভব হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

ভারতে টিকাদান শুরুর জন্য নিবন্ধনের কাজ চলছে। ছবি: রয়টার্স

ভারতের চাহিদা কত?

১৩৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের ৩০ কোটি মানুষকে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে দেশটির সরকার।

এর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীসহ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যারা সামনের সারিতে আছেন, এমন তিন কোটি কর্মী টিকা পাবেন সবার আগে।

৩০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য আগামী সাত মাসের মধ্যে ভারতের দরকার হবে ৬০ কোটি ডোজ। অর্থাৎ প্রতি মাসে চাহিদা থাকবে মোটামুটি সাড়ে ৮ কোটি ডোজের।

সেরাম ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, মান পরীক্ষার পর তাদের হাতে ৫ কোটি ডোজ টিকার মজুদ আছে, যা তারা যে কোনো সময় সরবরাহ করতে পারবে।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, উৎপাদনের কত শতাংশ তারা ভারতের চাহিদা মেটাতে রাখবে আর কত শতাংশ রপ্তানি করতে পারবে, তা নিয়ে এখনও কাজ চলছে।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাক্সিন সিরিঞ্জে ভরেতে দেখা যাচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

টিকার দুনিয়ায় ভারতের ভূমিকা কী

গরিব দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস বা গ্যাভি এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস মিলে কোভ্যাক্স নামে যে প্ল্যাটফর্ম গড়েছে, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট তার সঙ্গেও যুক্ত।

গত সেপ্টেম্বরে সেরাম ইনস্টিটিউট প্রতিশ্রুতি দেয়, ২০২১ সালে তারা কোভ্যাক্সকে ২০ কোটি ডোজ টিকা দেবে। সেটা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা হতে পারে, আবার যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি নোভাভ্যাক্সও হতে পারে, যার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনও শেষ হয়নি।

সেরাম ইনস্টিটিউটের সিইও আদর পূনাবালা বিবিসিকে বলেছেন, কোভ্যাক্সের সঙ্গে তাদের চুক্তিতে টিকা সরবরাহের পরিমাণ আরও ৯০ কোটি ডোজ বাড়ানোর একটি সম্ভাবনাও সামনে রয়েছে। সেক্ষেত্রে কোভ্যাক্সের জন্য সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রতিশ্রুত টিকার পরিমাণ বিলিয়ন ডোজ ছাড়িয়ে যাবে।

বিবিসি লিখেছে, আগামী মার্চ থেকে সেরাম ইনস্টিটিউট তাদের উৎপাদন বাড়িয়ে মাসে ১০ কোটি ডোজে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকার জন্য কাচের ভায়াল। ছবি: রয়টার্স

আর কাকে টিকা দিতে হবে ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে

কোভ্যাক্স ছাড়াও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বিক্রির জন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে সেরাম ইনস্টিটিউট।

কিন্তু এ মাসের শুরুতে পূনাবালার একটি বক্তব্য ঘিরে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তিনি বলেছিলেন, আগে ভারতের চাহিদা মিটিয়ে তারপর তারা রপ্তানিতে যাবেন।

সেই বিভ্রান্তি দূর করতে পরে ভারত সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, টিকাদান শুরু হলেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রপ্তানির অনুমতি দিয়ে দেবে ভারত।

সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকা কিনতে ইতোমধ্যে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ।

বিবিসি লিখেছে, সৌদি আরব, মিয়ানমার ও মরক্কোর সঙ্গেও এরকম চুক্তি করেছে সেরাম ইনস্টিটিউট, তবে সেসব দেশকে কত দিনে কত ডোজ দিতে হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

নেপাল, ব্রাজিল ও শ্রীলঙ্কাও তাকিয়ে আছে ভারতে উৎপাদিত টিকার দিকে। সেটা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকা অথবা ভারত বায়োটেক- যে কোনোটিই হতে পারে। 

কোভ্যাক্সের সহ উদ্যোক্তা গ্যাভির একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, তারা ভারত এবং সেরাম সেরাম ইনস্টিটিউট- দুই পক্ষের সঙ্গেই নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। তারা আত্মবিশ্বাসী যে প্রতিশ্রুত সময়েই তারা কোভ্যাক্সের আওতায় টিকা সরবরাহ করতে পারবেন।

ভারতীয় ভাইরোলজিস্ট ডা. শহীদ জামিলকে উদ্ধৃত করে বিবিসি লিখেছে, কোভ্যাক্সকে টিকা দেওয়া একটি আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা। আবার যেসব দেশের সঙ্গে টিকার বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে, তা পূরণ করতে না পারাও ভারতীয় কোম্পানির জন্য ভালো দেখাবে না।

“তবে এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে ভারত শেষ পর্যন্ত টিকার অভাবে পড়বে- এমন আশঙ্কা আমি করছি না।”

শহীদ জামিল বলেন, কত দ্রুত মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে- সেটি এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভ্যাকসিনের জন্য যে কাচের ভায়াল দরকার হয়, তার পর্যাপ্ত মজুদ। কাচের ভায়ালের সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে পুরো বিশ্বেই এক ধরনের উদ্বেগ আছে।

তবে সেরাম ইনস্টিটিউট এখন পর্যন্ত কাচের ভায়ালের সরবরাহ নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যায় পড়েনি বলে বিবিসিকে জানিয়েছে।