উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছেন, “দাবানল সৃষ্টির আগে ছোট ছোট আগুন জ্বলে। ঝাঁপিয়ে পড়ে সে আগুন নেভাতে হয় যেন একটা আগুনের সঙ্গে যেন আরেকটা আগুনের উৎস মিলে না যায়।
“সেই কাজটা এখন আমরা করছি, ঝাঁপিয়ে পড়ে যেখানে আগুন পাচ্ছি, সেখানে দৌড়ে যাচ্ছি। যেভাবেই পারি নেভানোর চেষ্টা করছি। আশেপাশের গাছপালা কেটে পরিষ্কার করছি।”
নতুন এই ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশও যখন অবরুদ্ধ অবস্থা তৈরি করতে যাচ্ছে, তখন পরিস্থিতির ভয়াবহতা সবাইকে উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়েছেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই গবেষক।
বিশ্বে ৪ লাখকে আক্রান্ত এবং ১৮ হাজার মৃত্যুর ঘটনার পর দেশে ৩৯ জনের সংক্রমণ এবং চারজনের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে মহামারী মোকাবেলার এই লড়াইয়ে কোনোভাবেই আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ড. মুশতাক।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কিছু দিন আগে অবসরে যাওয়া মুশতাক এই সঙ্কটকালে অভিজ্ঞতা নিয়ে সহায়তা করছেন সংস্থাটিকে।
দেশের ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ডাকসুর জিএস নির্বাচিত হওয়া মুশতাক এখন রয়েছেন কভিড-১৯ মোকাবেলার লড়াইয়ে; বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন এই লড়াইয়ের নানা দিক নিয়ে।
মহামারী মোকাবেলা
মহামারী মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুতি লাগে- এ প্রশ্নের জবাবে মুশতাক হোসেন বলেন, “প্রস্তুতি মানেই কিন্তু হাসাপাতালের প্রস্তুতি না। হাসপাতাল হল শেষ স্টেইজ। দুনিয়ার কোনো দেশই যদি তার মোট জনসংখ্যার এক শতাংশও এক যোগে হাসপাতালে ভর্তি হতে যায়, তাহলে সেটা নিতে পারবে না।
“এক্ষেত্রে মনে করেন সারা বাংলাদেশের হাসপাতালে এক কোটি মানুষের প্রস্তুতি রাখা হল। যদি এখানে পাঁচ কোটি লোক আক্রান্ত হয়, তাহলে কী হবে? সেই পাঁচ কোটিতে যেন না যায়, সেই কাজটা করতে হয় সব থেকে আগে এবং দ্রুত।”
কভিড-১৯ প্রথম হানা দিয়েছিল যে দেশে, সেই চীন সাময়িক সময়ের জন্য হাসপাতাল তৈরি করেছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেখিয়েছে, এখন কত দ্রুত বিস্তার ঘটছে নভেল করোনাভাইরাসের।
প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ৬৭ দিন, এক লাখ থেকে দুই লাখে যেতে সময় লাগে ১১ দিন। আর চার দিনেই রোগীর সংখ্যা দুই লাখ থেকে তিন লাখে পৌঁছে যায়।
রোগী বৃদ্ধির এই পাল্লায় কোনো দেশই পেরে উঠছে না। যুক্তরাষ্ট্রেও সব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারছে না। নিউ ইয়র্কে পাঁচ তারা হোটেলকেও হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে।
মুশতাক বলেন, “মহামারী মোকাবেলার প্রথম কথা হল, এটাকে র্যাপিড রেসপন্স করার ক্ষমতা আছে কি না? যেন ওটা প্যানডেমিক স্তরে না যায়। রিস্ক কমিউনিকেশনের মাধ্যমে ব্যাপক জনগণকে, স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে, গোটা দেশবাসীকে এটা সম্পর্কে জানানো যে কী করতে হবে, না করতে হবে এবং ল্যাবরেটরিগুলো প্রস্তুত আছে কি না, তা দ্রুত সনাক্ত করা।
“যেন হাসপাতাল থেকে রোগটা না ছড়ায়। যারা আক্রান্ত, তাদের মাধ্যমে কমিউনিটি লেভেলে না ছড়ায়। আবার তারা যখন খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে আসে, হাসপাতালের সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখতে হবে।”
এছাড়া রোগী খুঁজে বের করা, গ্রুপ করা, রোগীদের সংস্পর্শে আসা লোকদের আলাদা করা এবং রোগীদের আইসোলেটেড করার কাজও চালিয়ে যেতে হবে।
পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য ব্যাপক প্রচার করা এবং এ কাজে কমিউনিটি যেন এগিয়ে আসে সে ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করেন মুশতাক।
জনসমাগমে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ে বলে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা এসেছিল আগেই।
আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর সোমবার সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব অফিস-আদালতে ছুটি ঘোষণা করে।
বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সরকার সরকার সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েন করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা লকডাউন করা হচ্ছে।
মুশতাক বলেন, “এখন তো প্যানডেমিক হয়ে হাসপাতালে আসবে না। এখন প্যানিকড হয়ে হাসপাতালে আসবে। এদের মধ্যে যাদের সর্দি, কাশি, জ্বর তাদেরকে বাছাই করে বাসায় ফেরৎ দেওয়া হচ্ছে। আর যারা বয়স্ক, যাদের আরও অসুখ আছে এবং যাদের অবস্থা জটিল, আমরা তাদেরকে টেক-কেয়ার করছি।” আইইডিসিআরের সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, “কিন্তু আমরা প্রথমেই যদি শুরু করি হাসপাতালে কয়টা বেড আছে? এ বিষয়টা অবশ্যই আসবে যখন বেশি রোগী আসবে। তখন তাঁবু খাটিয়ে হাসপাতাল বানিয়ে তাদেরকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে কি না, সেটা দেখতে হবে। ডাক্তারদের, কমিউনিটিতে সেইরকম মোটিভেশন আছে কি না, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
এছাড়া মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা যায় কি না, তাও মাথায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ডা. মুশতাক বলেন, “স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন বলতে বোঝানো হয় ক্লিনিক্যাল সার্ভিসটা কতটুকু ভালে। বাংলাদেশের পাবলিক হেলথ অনেক রেসপন্সিভ। অনেক কিছু মোকাবেলা করেছে। কিন্তু রিসোর্স কম। সেটাকে যদি অর্গাইনজ করা হয় এবং এটা করা হচ্ছে। পুলিশ, প্রশাসন, সশস্ত্রবাহিনী এবং জনগণও সাহায্য করছে।
“কিন্তু হাসপাতালে বেড নাই, ডাক্তার নাই, মাস্ক নাই, হাসপাতালে গেলে রোগী বের করে দেওয়া হচ্ছে- এসব গুজবে গোটা লোকজন প্যানিকড হয়ে যাচ্ছে। রোগী পেলে তারা ফ্ল্যাট থেকে, ক্লিনিক থেকে বের করে দিচ্ছে, হাসপাতাল নিচ্ছে না। এটা একটা চরম দুরবস্থা হচ্ছে।”
বাংলাদেশ এখনও কভিড-১৯ আক্রান্ত সেই স্তরে পৌঁছেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দুনিয়ার কোনো দেশে যদি হাজার হাজার, লক্ষ, লক্ষ রোগী প্যানিকড হয় এবং হাসপাতালে সিট চায়, সেটা অসম্ভব। এটাকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করতে হয়। স্তরে স্তরে প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রণ করে সেই জায়গায় পৌঁছতে হয়।”
দেশে মহামারী এখনও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বরে মনে করেন এই গবেষক।
“কারণ আমরা জানি, রোগটা কোথা থেকে ছড়ায়। কলেরা বা ডায়ারিয়ার মতো কোনো অজানা জায়গা থেকে ছড়াচ্ছে না। রোগবাহক মানুষের কাছ থেকে ছড়াচ্ছে। সেই মানুষটা এখনো ট্রেস করা যাচ্ছে। তারা বিদেশ ফেরৎ।”
স্বাস্থ্যসেবা খাতের চিত্র
কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা, সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে শুরু থেকেই। দেশে জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতালে শয্যার অপ্রতুলতা রয়েছে। ফলে কভিড-১৯ বিশ্বে মহামারী আকার ধারণ করায় বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা কতটা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে চিকিৎসকসহ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৭৮ হাজার ৩০০ জন। এরমধ্যে চিকিৎসক পদে রয়েছেন ২৭ হাজার ৪০৯জন।
বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল, বিডিএমসির হিসাবে দেশে রেজিস্টার্ড নার্সের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাচ্ছে, সারাদেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। যার মধ্যে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ১৪০টি হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৩১ হাজার ২৬০টি। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে ৫১৪টি হাসপাতালের শয্যা রয়েছে ২০ হাজার ৫৬টি। বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি।
সারাদেশে অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে ৫ হাজার ৫৫টি। এছাড়া অনুমোদিত ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের সংখ্যা নয় হাজার ৫২৯টি।
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৪৩২টি আইসিইউ এবং ৪৮১টি সিসিইউ শয্যা রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ৭৩৭টি আইসিইউ এবং ৫৫৩টি সিসিইউ বেড রয়েছে।
জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসকের স্বল্পতা রয়েছে দেশে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালে শয্যা বরাদ্দ আছে ৩ দশমিক ২৪টি, বেসরকারি হাসপাতালে ৫ দশমিক ৫৭টি।
বাংলাদেশের ১ হাজার ৫৮১ জন মানুষের জন্য ১ জন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক ৬ দশমিক ৩৩ জন। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় চিকিৎসকের সংখ্যা ১ দশমিক ২৮ জন।
প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আছেন মাত্র শূন্য দশমিক ৩২ জন।
দেশের প্রস্তুতি
আইইডিসিআর থেকে মঙ্গলবার জানানো হয়েছে, সারাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের জন্য ২৯৪টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একযোগে ১৬ হাজার ৯৪১ জনকে সেবা দেওয়া যাবে।
আইসোলেশনের জন্য বেড প্রস্তুত করা হয়েছে ৪৫৩৯টি, এরমধ্যে ঢাকা শহরে রয়েছে ১০৫০টি।
ঢাকা শহরে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, উত্তরা ও মিরপুরের রিজেন্ট এবং যাত্রাবাড়ীর সাজিদা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ২৯টি আইইসিইউ বেড তৈরি রাখা হয়েছে এবং আরও ১৬টি প্রস্তুতির কাজ চলছে।
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৫টি ডায়ালাইসিস শয্যা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তিনশ’র বেশি জনবল কাজ করছে করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্তের কাছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সোমবার নাগাদ ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষার জন্য সাড়ে তিন লাখ পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক) সংগ্রহ করা হয়েছে এবং বিতরণ করা হয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার। মজুদ আছে ৬৫ হাজার। মার্চের মধ্যেই পিপিই সংগ্রহ করা হবে আরও ১০ লাখ।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেছেন, বর্তমানে মজুদ আছে ১৩ হাজার কিট। আরও ২০ হাজার কিট কেনার আদেশ হয়েছে। চীন আরও ১০ হাজার কিট দেবে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে কভিড-১৯ পরীক্ষা করার জন্য আরও ৭টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।