মাসুম আজিজকে বিদায় জানাতে শহীদ মিনারে এসে ‘সাচ এ শর্ট লাইফ’ বলেই কেঁদে ফেলেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ।
Published : 18 Oct 2022, 05:39 PM
ভালোবাসার অশ্রু আর ফুলেল শ্রদ্ধায় একুশে পদক জয়ী অভিনেতা মাসুম আজিজকে শেষ বিদায় জানিয়েছে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন।
মঙ্গলবার বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তার মরদেহ নেওয়া হলে সর্বস্তরের মানুষ তাকে শেষ বিদায় জানায়।সেখানে সহকর্মীরা স্মরণ করেন অভিনয়ে নিবেদিত মাসুম আজিজের ‘আপসহীন’ এক জীবনের কথা।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে মাসুম আজিজের জানাজা হয়। এরপর স্বজনরা মরদেহ নিয়ে পাবনার বোনাইনগর ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা হন।
মাসুম আজিজকে বিদায় জানাতে এসে ‘সাচ এ শর্ট লাইফ’ বলেই কেঁদে ফেলেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ।
তিনি বলেন, “মাসুমের চলে যাওয়া বেদনার, ভীষণ কষ্টের। মাসুম বৈষয়িকভাবে সফল হতে পারেনি। দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু ওর সাফল্য এসেছে শিল্পচর্চায়। পুরো পরিবারটিই একটা শিল্প পরিবার।”
দীর্ঘদিন ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন অভিনেতা মাসুম আজিজ। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত সপ্তাহে তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে সোমবার তার মৃত্যু হয়।
শহীদ মিনারে এই অভিনেতাকে বিদায় জানাতে এসে সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “আমাদের দেশে শুধু নাটক করে বেঁচে থাকার প্রত্যয় আমরা অনেকেই চলতে পারিনি। কিন্তু মাসুম চলেছে, সারাজীবন নাটক নিয়েই থেকেছে। আমরা অনেকেই আপস করেছি। জীবনের গতির সাথে মিলিয়ে চলবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মাসুমকে কখনও আপস করতে দেখিনি।
“মাসুম আজিজের সাথে কয়েকটা কাজও করেছি। তার চলে যাওয়া মানে অঙ্গীকারবদ্ধ এক শিল্পীর চলে যাওয়া। তার ভাবনায় সব সময় দেশ এবং মানুষ ছিল।”
অভিনেতা, নাট্যকার রামেন্দু মজুমদার বলেন, “নাটকের পাশাপাশি গান করেছে মাসুম। নানা প্রতিকূলতায়ও নাটক করেছে, অভিনয় করেছে মাসুম। সে তরুণদের অনুপ্রাণিত করতে পারত। মাসুম আজিজের মৃত্যুতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হল।”
শ্রদ্ধা নিবেদনের পর নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তিনি কখনও আপস করেননি। অনেক প্রতিকূল অবস্থায় দাঁড়িয়েও তিনি অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছেন।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মাসুম আজিজের স্ত্রী সাবিহা জামান বলেন, “মাসুম সবসময় কাজের মধ্যেই থাকতে চেয়েছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পরও পুরোদমে শুটিং চালিয়ে গেছে। সবসময় বলত, এ দেশের মানুষের জন্য, সংস্কৃতির জন্য, আমার কত কী দেওয়ার বাকি রয়ে গেছে…।”
ছেলে উৎস জামান বলেন, “দেশের মানুষ আমার বাবাকে অনেক ভালোবাসতেন, এজন্য আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গত ১০ মাস আমাদের পরিবারের পাশে থেকেছে। তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাই।
“এ বছরের ৩ জানুয়ারি বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর বাবা যেন এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অগ্রজ সংস্কৃতিজন আসাদুজ্জামান নূর, গোলাম কুদ্দুছ, মামুনুর রশীদ সকলেই বাবার সেই যুদ্ধের সহযোদ্ধা ছিলেন। বাবার শেষ সময়ের পুরোটা জুড়ে তারা ছিলেন পাশে। আজ বাবার সেই যুদ্ধটা শেষ হয়ে গেল।”
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “মাসুম আজিজের অসুস্থতার সময় তার সাথে কথা হত। তিনি আমাদের বলতেন, আমি ঠিক হয়ে যাব। নতুন নাটক কী করা যায়? আমি কী সান্ত্বনা দেব। উনার মনোবল দেখে অবাক হতাম। উনি অসুস্থতার সময়ও নতুন নাটক করার কথা ভাবতেন।”
অভিনেতা নাদের চৌধুরী বলেন, “মাসুম আজিজের সাথে আমার প্রায় তিন যুগের সম্পর্ক। কত কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি। এক মাস আগেও উনার সাথে কথা হয়েছে। তাকে বলেছি, দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। মঞ্চে অভিনয় করতে হবে। নতুন নাটক দেন।”
আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়, অভিনেত্রী দিলারা জামান, অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু, অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদ, তারিন, সালাউদ্দিন লাভলু, চয়নিকা চৌধুরী, সজলসহ অনেকেই এ শিল্পীকে বিদায় জানাতে শহীদ মিনারে আসেন।
মাসুম আজিজকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিলসহ কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য সদস্যরা।
এছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, ঢাকা থিয়েটার, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, পথনাটক পরিষদ, অভিনয় শিল্পী সংঘ, কমিউনিস্ট পার্টি, যুব ইউনিয়ন, ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠী, ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলার্স ক্লাব, দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, আরণ্যক নাট্যদল, ডিরেক্টরস গিল্ড, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, থিয়েটার আর্ট ইউনিট, দৃষ্টিপাত নাট্যদল, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠন শ্রদ্ধা জানায়।
আরও খবর