বিদেশে পুরস্কারজয়ী ‘আদিম’ দেশে যেখানে আটকে

পরিচালক সমিতির সদস্য হওয়ার ‘টাকা নেই’ যুবরাজ শামীমের, তাই ‘আদিম’ দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে পারছেন না।

গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2022, 03:58 PM
Updated : 8 Sept 2022, 03:58 PM

‘আদিম’ বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জিতে দেশের সম্মান বাড়ালেও দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে পারছেন না এর নির্মাতা যুবরাজ শামীম।

কারণ পরিচালক সমিতির সদস্য হওয়ার ‘টাকা নেই’ তার। আর সমিতির সদস্য না হলে দেশের প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা মুক্তি দেওয়া যায় না।

গণঅর্থায়নে নির্মিত সিনেমা আদিম সম্প্রতি মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘নেটপ্যাক জুরি অ্যাওয়ার্ড’ জিতে আসে।

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের সিনেমা তৈরির গল্প নিয়ে হাজির হন যুবরাজ শামীম।

দেশের সিনেমা হলে কবে মুক্তি পাবে আদিম- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রশ্নে শামীম বলেন, “আমি তো পরিচালক-প্রযোজক সমিতির সদস্য নই। এখানকার সদস্য হতে যে টাকা লাগে সেটাও নেই। যদি তারা টাকা ছাড়া আমাকে সদস্য করে নেয়, তাহলে খুব ভালো হয়।”

পুরস্কার জেতার পর এখন পর্যন্ত এফডিসির কোনো সমিতি থেকে তাকে অভিনন্দনও কেউ জানায়নি বলে জানান তিনি।

পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে যুবরাজ শামীম বলেন, “কোন ফাঁকে যেন মস্কোতে পুরস্কার পেয়ে গেল বুঝি নাই। মস্কোতে যখন যাই, এয়ারপোর্টে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কিন্তু পুরস্কারপ্রাপ্তির পর যখন ফিরি, তখন এয়ারপোর্টে অনেকেই সম্মান দেখিয়েছেন।”

“পুরস্কার জিতে দেশে ফেরার পর যেটা ভালো লেগেছে, সেটা হলো, আমার আশপাশের মানুষ বা এলাকার মানুষ, যারা আমাকে তেমন গুরুত্ব দিত না। এখন তারা আমাকে দেখে সমীহ করছে। এ জয়কে তারা নিজেদের জয় বলে মনে করছে। মস্কোর জয়ের চেয়ে এ বিষয়টি আমার কাছে কোনো অংশে কম না।”

Also Read: গণঅর্থায়নের সিনেমা ‘আদিম’-এর মস্কো জয়

৮৩ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের আদিম স্বাধীন একটি চলচ্চিত্র। ৫০ জনের কাছে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে সিনেমাটির নির্মাণ খরচ।

পরিচালক জানিয়েছেন, এর নির্মাণ খরচ ১৫ লাখ টাকা। তবে এর মধ্যে নেই পরিচালকসহ কলাকুশলীদের সম্মানী।

‘আদিম’ সিনেমা শুরুর পর নানা কটাক্ষ-অপমানের শিকার হতে হয়েছে বলেও জানান নির্মাতা ও কলাকুশলীরা, যারা কেউ পেশাদার শিল্পী নন।

অভিনেত্রী সোহাগী বলেন, “আমাকে অনেকেই বলেছেন, ‘তোমাদের সিনেমা ইউটিউবে দেখাবে। এসব করে কী হবে? তোমাদের টিভির পেছনে দেখা যাবে’ ইত্যাদি বলে টিটকারি করত আমাদের নিয়ে।”

আদিমে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করা দুলাল মিয়া বলেন, “কত মানুষ আমাকে, শামীম ভাইকে অপমান করছে, তার ঠিক নাই। প্রশাসনসহ রাজনৈতিক মানুষ এসে ঝামেলা করেছে।”

সিনেমায় অভিনয়ের বিষয়টি প্রথমে সোহাগী, দুলাল কেউই গুরুত্ব দেননি বলে জানান।

সোহাগী বলেন, “যখন দুলাল ভাই এসে বলল যে সিনেমা করতে হবে, আমি তাকে বলেছিলাম, মশকরা করো? তার কয়েক দিন পর শামীম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে দুলাল ভাই আমাকে দেখায়ে শামীম ভাইকে বলেন, নায়িকা চলবে? শামীম ভাই বলেন, চলবে। তখনও সিনেমাটা আসলেই হবে কি না, এটা জানতাম না। তারপর আমরা তিন মাস রিহার্সাল করি। কখনও ভাবি নাই এমন কিছু হবে।”

দুলাল মিয়া বলেন, “আমরা টঙ্গীর ব্যাংকের মাঠ বস্তিতে থাকি। শামীম ভাই বস্তিতে থাকা শুরু করলে তাকে নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। মনে করতাম বড়লোকের ছেলে, কী থেকে কী করে। একদিন শামীম ভাই আমাকে বলল সিনেমা করবেন? এ কথা শুনে আমার আরও হাসি পায়। দুই-তিনবার বলার পর আমি রাজি হই। বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলেছে মন্তব্য করেছে, এর মধ্যেও আমরা কাজ শুরু করি।”

আদিমের গল্প নিয়ে নির্মাতা শামীম বলেন, “ল্যাংড়ার ভাসমান জীবন। খুনের দায় এড়াতে সে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়। যেখানেই যায়, সেখানেই সে নতুন মানুষের সঙ্গে নতুন সম্পর্কে জড়ায়। এমনই একদিন টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশনে কালা এবং কালার স্ত্রী সোহাগীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। যে পরিচয় ল্যাংড়ার জীবনে নানা রকম জটিলতার জন্ম দেয়।

“আদিম নির্মাণের পেছনের গল্প আরও বিস্তৃত। ২০১৬ সালের শেষের দিকে প্রথম আদিম নির্মাণের ভাবনা মাথায় আসে এবং হাতের কাছে যা আছে তাই দিয়েই আদিম নির্মাণের পরিকল্পনা করি। ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডসের নির্মাতা ক্লিমেনটিনে এডারভিন আমার ভাবনা শুনে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে ২০০ ইউরো আমার হাতে ধরিয়ে দেন, যা আমাকে আদিম নির্মাণে প্রথম সাহস জোগায়। সিনেমার বাকি টাকা আমি আশপাশের মানুষের কাছ থেকে ধার নেওয়ার চিন্তা করি, তখন মোহাম্মদ নূরুজ্জামান আমাকে সিনেমার শেয়ার বিক্রির পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ আমার মনে ধরে।”

“ক্লিমেনটিনের টাকা হাতে পেয়ে আমি টঙ্গীর ব্যাংক মাঠ বস্তিতে থাকার সিদ্ধান্ত নিই, কারণ আমার মনে হয়েছে যে মানুষগুলোর গল্প আমি বলব তাদের সঙ্গে থাকাটা আমার জন্য জরুরি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আমার বস্তির দিন কাটে, মাঝেমধ্যে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ি। কিন্তু ধীরে ধীরে বস্তির কয়েকজন মানুষের সঙ্গে আমার সখ্য তৈরি হয় এবং আমি সিদ্ধান্ত নিই বস্তির মানুষজন নিয়েই আদিম চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করব।”

“শুটিং পর্ব শেষে আমার পোস্ট প্রোডাকশনের যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে আমার সঙ্গে শামিল হন সুজন মাহমুদ। যিনি সিনেমাটির সাউন্ড এবং কালার করেছেন। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অর্জন এবং দেশের মানুষের ভালোবাসা আদিম-এর নির্মাণের সকল যন্ত্রণা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে,” বলেন শামীম।