বুধবার কলকাতার রবীন্দ্রসদনে গান স্যালুটের মধ্যে দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় প্রয়াত শিল্পীকে।
Published : 10 Jan 2024, 05:12 PM
যার দরদভরা মেজাজি কণ্ঠের মায়াজালে বুঁদ হয়ে থাকতেন শ্রোতারা, সেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পী ওস্তাদ রাশিদ খানের মৃত্যুতে শোকাচ্ছন ভারতের সংগীত জগতের শিল্পীরা। সংগীতের দুনিয়ায় তার সহযোদ্ধারা মনে করছেন যার চলে যাওয়ার বয়সই হয়নি, সেই প্রয়াণ মেনে নেওয়া যায়না।
শোক জানিয়েছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, হৈমন্তী শুক্লা, ঊষা উত্থুপ, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। শিল্পীদের পাশাপাশি নোবেলজয়ী পদার্থবিদ অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি, সঞ্চালক তারকা মীর আশরাফ আলীসহ আরও অনেকে রাশিদ খানের সঙ্গে নিজেদের সময় কাটানোর স্মৃতিতে ডুব দিয়েছেন।
সংবাদ প্রতিদিন বলছে, বুধবার কলকাতার রবীন্দ্রসদনে গান স্যালুটের মধ্যে দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় প্রয়াত শিল্পীকে। সে সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্পীর পরিবার, স্বজনরা। এছাড়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিসহ সরকারের আরও কয়েকজন।
রাশিদকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন হৈমন্তী শুক্ল, ঊষা উত্থুপ, তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, দেবজ্যোতি বসু, সমর সাহাসহ আরও অনেককে। রাশিদকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শিল্পীর বাসভবনে। রাশিদকে সমাহিত করা হবে তার জন্মস্থান উত্তর প্রদেশের বদায়ুঁতে।
৫৫ বছর বয়সে মঙ্গলবার বিকালে মারা যান রাশিদ খান। এই শিল্পী গত কয়েক বছর ধরে প্রস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে স্ট্রোক করলে প্রথমে তাকে দক্ষিণ কলকাতার একটি হাসপাতালে ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিটে (আইটিইউ) রাখা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসা চলার মধ্যেই দিনে দিনে শরীর খারাপ হতে থাকে। মঙ্গলবার অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় আইসিইউতে নিয়ে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয় এই শিল্পীকে।
শোকাতুর শিল্পীরা
শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী সাংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি শোক জানানোর পরিস্থিতিতে নেই। গত এক মাস ধরে প্রিয় ছাত্র রাশিদ খানের নিয়মিত খোঁজ রাখছিলেন তিনি।
“ও তো আমার হাতেই তৈরি। এটা তো চলে যাওয়ার বয়স নয়। দেশের সঙ্গীত জগৎ এক গুণী শিল্পীকে হারাল।”
সঙ্গীতশিল্পী কবিতা কৃষ্ণমূর্তি সোশাল মিডিয়ায় লিখেছেন “আমি শোকাহত। অপূর্ব শিল্পী ছিলেন রাশিদ খান। বরাবরই আমি তার সঙ্গীতের অনুরাগী। রাশিদ খানের কণ্ঠ সারাজীবন আমার হৃদয়ে থেকে যাবে। শিল্পীর পরিবারের জন্য সমবেদনা রইল। এবার ঈশ্বরকে খুশি রাখুন।”
‘মৌসম’ সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালক প্রীতম চক্রবর্তীর সুরে গান গেয়েছিলেন রাশিদ খান। শিল্পীর প্রয়াণের খবর পেয়ে পুরনো স্মৃতিতে ভেসেছেন প্রীতম।
Losing Rashid Khan Saab is a huge loss for the world of music. In my family, we have been devotees of his music, and my kids were students at his academy. I had the opportunity to work with Rashid Bhai in Mausam.
— Pritam (@ipritamofficial) January 9, 2024
We will miss your music.
⁰My deepest condolences to his family.…
তিনি লিখেছেন, “রাশিদ খানের চলে যাওয়া বিশ্ব সঙ্গীতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমি তার সঙ্গীত শিষ্য ছিলাম। আমার সন্তানরা তার অ্যাকাডেমির ছাত্র। তার সঙ্গীত মনে থাকে যাবে।”
প্রখ্যাত সরোদশিল্পী তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার জানালেন, রাশিদ খানের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি ছুটে যান হাসপাতালে।
“আমার সঙ্গে ওর শেষ কথা হয়েছে অক্টোবর মাসে। রাশিদ বলেই ডাকতাম। ও আমাকে বাবা বলে ডাকত। আমার স্ত্রীকে ডাকত মা। কোথায় সে চলে গেল এত শিগগিরই!”
রাশিদ খানের মৃত্যুতে অনেক কিছুর প্রতি 'টান কমে গেল' বলে জানিয়েছেন নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, “নোবেল জয়ের পর আমাকে সবাই জিজ্ঞাসা করেছিল, এই মুহূর্তে আমি কী চাই। আমি বলেছিলাম, রাশিদ খানের সামনে বসে তার কণ্ঠে কিরওয়ানি রাগ শুনতে চাই। সেই মানুষটা চলে গেলেন।”
সঞ্চালক ও অভিনেতা মীর আফসার আলী শিল্পীর আরেকটি গুণের কথা জানালেন।
মীর বলেন, “ওস্তাদজির গান ও তার হাতে বানানো বিরিয়ানি। আমি খুবই ভাগ্যবান। দুটোরই সান্নিধ্য পেয়েছি। আমি শোকপ্রকাশ করব না বরং ওর সঙ্গে কাটানো সময়ের কথা মনে রাখব।”
উত্তর প্রদেশের বদায়ুঁতে ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই রাশিদ খানের জন্ম। ওস্তাদ নিসার হুসাইন খানের কাছে প্রাথমিক তালিম নেন তিনি।
দশ বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসেন রাশিদ। মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে ওঠেন তিনি। শৈশবেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অনুপ্রাণিত হন তিনি। রাশিদ খান রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার শিল্পী ছিলেন। এই ঘরানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইনায়েত হুসেন খান। এই ঘরানার গানের বৈশিষ্ট্য হলো মধ্যম নিচু লয়, মুক্ত কণ্ঠ ও জটিল তাল।
রাশিদ খানের মধ্যে ওস্তাদ আমির খান ও পণ্ডিত ভীমসেন যোশী, গুরু ওস্তাদ নিসার হুসাইনের প্রভাব রয়েছে। পণ্ডিত ভীমসেন যোশী একবার বলেছিলেন, “রাশিদ খানের কণ্ঠ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ভবিষ্যৎ।”
এছাড়া ‘বিলম্বিত খেয়াল’ পরিবেশনের জন্য বেশ খ্যাতি ছিল তার।
শাস্ত্রীয় সংগীতের বাইরে বলিউড ও ভারতীয় বাংলা সিনেমার গানেও পাওয়া গেছে রাশিদ খানকে।
বলিউডের ‘মাই নেম ইজ খান’, ‘যব উই মিট’, ‘ইশক’; কলকাতার সিনেমা ‘বাপি বাড়ি যা’, ‘কাদম্বরী’, ‘মিতিন মাসি’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমার গান করেছেন তিনি।
রবীন্দ্রসংগীতও গেয়েছেন রাশিদ খান। ২০০০ সালে প্রকাশ হয় রাশিদ খানের ‘বৈঠকি রবি’ অ্যালবাম।
রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে রাশিদ খান বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি, রবীন্দ্রসংগীত না গাইলে কোনো শিল্পীর জীবনে পূর্ণতা আসে না।”
সংগীত জীবনে ‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্মভূষণ’সহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হন রাশিদ খান।
বাংলাদেশেও একাধিকবার সংগীত পরিবেশন করেছেন এই শিল্পী।
আরও পড়ুন: