বিউটি সার্কাস এক ঘোর, গুরুত্বপূর্ণও

“বিউটি সার্কাস’ এক ঘোর। এই ঘোর আপনাকে টেনে নেবে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত।”

আহসান কবিরআহসান কবিরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2022, 03:51 AM
Updated : 8 Oct 2022, 03:51 AM

সার্কাসের আড়ালে মনেপ্রাণে মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাওয়ার এক সিনেমা ‘বিউটি সার্কাস’। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় সটান দাঁড়িয়ে মৌলবাদের অন্ধকার জগত থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক নারীর একাকী সংগ্রামের গল্প বিউটি সার্কাস। যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, ধর্মের মুখোশ পরে এখনও যে তারা বাউল গান কিংবা সার্কাসের বিপক্ষে, সেটা জানানোর গল্প বিউটি সার্কাস। স্বাধীনতার পর সার্কাস ও এর পেছনের স্মৃতিময় গল্পের প্রথম কোন সিনেমা বিউটি সার্কাস। মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারানো এক নারীর বয়ানে ঘোরলাগা এক রুদ্ধশ্বাস প্রতিশোধের সিনেমা বিউটি সার্কাস।

‘বিউটি সার্কাস’ এক ঘোর। গানের কথাতেও আছে-‘হয়ে যাও হয়ে যাও হয়ে যাও ভোর/সময়ের সার্কাসে কেটে যাবে ঘোর’! এই ঘোর আপনাকে টেনে নেবে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত। এদেশে একদা বেঙ্গল সার্কাস নামে সার্কাসের প্রতিষ্ঠিত এক দল ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বানিয়া শান্তা (মোংলা বন্দরের কাছেই) গ্রামে সার্কাস দেখাতে এসেছিল বেঙ্গল সার্কাস দল, যার প্রাণপুরুষ ছিলেন ওসমান শহীদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ না বলার কারণে আর সার্কাসের নামে ‘বেদাত’ কাজের অপরাধে তাকে নওয়াজেস ওরফে নাদের মোল্লার নেতৃত্বে সার্কাস প্যান্ডেলের সামনেই জবাই করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় প্যান্ডেল। এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে তার ছোট্ মেয়ে বিউটি। এই বিউটি একদা বেঙ্গল সার্কাসকে পুনর্গঠিত করে নাম রাখে বিউটি সার্কাস। ঘটনার অনেক পরে স্বাধীন দেশে বিউটি সার্কাস আসে সেই বানিয়া শান্তায়। বিউটি খুঁজে বের করতে চায় সেই নাদের মোল্লাকে।

সার্কাসের বিরতিতে সে খুঁজে ফেরে নাদের মোল্লাকে। সে জানিয়ে দেয় ‘আমি যদি পথ ছাড়ি তাহলে নারীরা হারবে’! সার্কাসের সূত্র ধরে একই গ্রামে বাউল গান নিষিদ্ধ করা হয়, বাউলদের চুল কেটে দেওয়া হয়। সার্কাসের প্যান্ডেলে বোমা মারা হয়, আগুনে পুড়ে যায় বিউটি সার্কাসের প্যান্ডেল। তবু থেমে থাকে না বিউটি। এক ঝড়বৃষ্টির রাতে প্রতিশোধ নেয় সে। এরপর বানিয়া শান্তা ছাড়ে বিউটি।

সিনেমার গল্প ও সংলাপ লিখেছেন মাহমুদ দিদার, পরিচালনাও করেছেন তিনি। উত্তেজনা ও আবেগের বন্ধনে বাঁধা সব দৃশ্য, একই সাথে এক নারীর প্রতিশোধ স্পৃহা ফুটিয়ে তুলেছেন দারুণ বাস্তবতায়। সার্কাসের গতিশীলতা আছে ক্যামেরায়, আছে সংলাপের মুন্সিয়ানা। দোলনায় কসরত, মাথার উপর একের পর এক কাপ পিরিচ জড়ো করা, দড়ির ওপর সাইকেল চালানো, দড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঝুলন্ত অবস্থায় অন্যের হাত ধরা আবার ছাড়ার কসরত ছাড়াও তরবারি দিয়ে মানুষ আলাদা করার মন্ত্র বা ছুরি গাঁথার খেলা অনবদ্যভাবে ফুটে উঠেছে সিনেমায়। সিনেমায় নাদের মোল্লাকে খুনের সময় বিউটির চোখে প্রতিশোধের আগুন কিংবা সার্কাসের ধারাভাষ্যকার শ্যামের মৃত্যুতে তার কান্না লক্ষণীয়! লক্ষণীয় নাদের মোল্লাকে খুনের পর সার্কাসটিক কিংবা জঙ্গিরা যেমন মানুষ খুন করে ঝুলিয়ে রাখত গাছে, তেমনি ঝুলিয়ে রাখার দৃশ্য।

বিউটির চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন জয়া আহসান। জমিদারপুত্র বখতিয়ার মির্জার চরিত্রে ফেরদৌস, নবাবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তৌকির আহমেদ। ভুলভাল ইংরেজিতে তৌকিরের সংলাপ ভালো লেগেছে। সম্ভবত ফেরদৌস এই প্রথম একটি নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ভালো লেগেছে নাদের মোল্লার চরিত্রে গাজী রাকায়েত আর তার সহযোগী চরিত্রে শতাব্দী ওয়াদুদকে। গাজী রাকায়েত এর নির্মমতা আর চুল কেটে দেওয়া কিংবা টাকা দেখিয়ে শতাব্দীর বলা-‘আমার ধর্ম টাকা’ এক কথায় দুর্দান্ত। যখন যে ক্ষমতায় আসে তাদের পদলেহন করার অভিনব ইঙ্গিত আছে এই চরিত্রে।

মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন হুমায়ুন সাধু। জঙ্গিরা একসময় মানুষ হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখত, সাধুর মৃত্যুদৃশ্য সেটাই মনে করিয়ে দেয়। সার্কাসের সঙ কিংবা ধারা ভাষ্যকার সাধুর সার্কাসের বড় আপা জয়ার প্রতি ভক্তি বা ভালোবাসা ফুটিয়েছেন দারুণভাবে। এই সিনেমা দেখে হুমায়ুন সাধুকে ভুলবে না মানুষ। দুর্ভাগ্য সিনেমাটা সাধু দেখে যেতে পারলেন না। মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে এসএম মহসীনও ভালো অভিনয় করেছেন। সাধু ও মহসীন মারা গেছেন। বিউটি সার্কাস তাদের আলাদাভাবে স্মরণ করেছে। জয়ার প্রেমিক রংলালের ভূমিকায় ভালো অভিনয় করেছেন এবিএম সুমন। তার চলচ্চিত্র জীবন সুগম হোক।

বিউটি সার্কাসের আরেক ভালো দিক এর সঙ্গীত ও ফটোগ্রাফি। চিরকূটখ্যাত শারমীন সুলতানা সুমীর কণ্ঠে ‘হয়ে যাও হয়ে যাও হয়ে যাও ভোর/সময়ের সার্কাসে কেটে যাবে ঘোর’ গানটা সুন্দর, যা বেশ আলোচিত হয়েছে। সিনেমার অন্যা গানগুলোও মনে রাখার মতো। বিউটি সার্কাসের সঙ্গীত পরিচালক পাভেল অরিন (চিরকূট) এবং চিত্রগ্রাহক কামরুল ইসলাম শুভ। পাভেল এবং শুভর জন্য শুভকামনা।

বিউটি সার্কাসের শুটিং শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে, শেষ হয় ২০২০-এ। শুটিং হয়েছে নওগাঁ, সাভার ও মানিকগঞ্জে। সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০২২ এর ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ১৪টি হলে।

লক্ষী নারায়ণ সার্কাসটিমের প্রায় সব সদস্য এই ছবিতে পারফর্ম করেছেন। একাত্তর সালে লক্ষী নারায়ণ সার্কাসের কর্ণধারকে হত্যা করা হয়েছিল, যার ছায়া আছে এই চরিত্রে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিউটি সার্কাস প্রযোজনা করেছেন মাহমুদ দিদার ও চ্যানেল আই এর পক্ষে ইবনে হাসান খান। সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর প্রচারণা নিয়ে পরিচালক মাহমুদ দিদারকে অসহায় মনে হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় এই সিনেমার সর্বোচ্চ প্রচার জরুরি ছিল। আশা করি বিউটি সার্কাস দেখতে হলে ফিরবে মানুষ।

জয় হোক বাংলা সিনেমার।