বাংলা চলচ্চিত্রে ফাইটারদের কাছে এখনো এই অভিনেতা 'জসিম ওস্তাদ' হিসেবেই বেঁচে আছেন।
Published : 08 Oct 2024, 05:18 PM
বাংলা সিনেমায় ফাইটিং শেখানোর কাজ নিয়ে এফডিসিতে প্রবেশ, তারপর খলনায়ক হয়ে পর্দা কাঁপানো-কেবল এতটুকু করেই থেমে থাকেননি ঢাকাই সিনেমার প্রয়াত নায়ক জসিম। প্রয়াত এই অভিনেতাকে নিয়ে পরিচালক দেওয়ান নজরুল বলেছেন, ভিলেন থেকে নায়ক হয়েও কীভাবে পর্দা নিজের দখলে রাখতে হয় তা প্রমাণ করেছিলেন জসিম।
'দোস্ত দুশমন', 'আসামী হাজির', 'কুরবানি', 'মাস্তান রাজা', 'কালিয়া', 'বাংলার নায়ক'সহ জসিমের অনেক সিনেমা এসেছে পরিচালক নজরুলের হাত ধরে। জসিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও ছিল এই পরিচালকের।
৮ অক্টোবর এই অভিনেতার ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গ্লিটজের সঙ্গে নজরুলের আলাপচারিতায় উঠে এসেছে জসিমের অভিনয় জীবনের ধাপ পরিবর্তনের বিভিন্ন গল্প।
নজরুল জানিয়েছেন, ১৯৭২ সালে ‘দেবর’ সিনেমা দিয়ে ঢাকার চলচ্চিত্রে ফাইটিং নির্দেশক ও অভিনেতা হিসেবে অভিষেক ঘটার পর খল চরিত্রে ৭০টির মত সিনেমা করেন জসিম। পরে নায়ক হয়েও করেন আরও শতাধিক সিনেমা।
কাজ শুরুর পর পরিচালকদের নজরে পড়তে জসিমের সময় লাগেনি। পরের বছরই ১৯৭৩ সালে জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ সিনেমায় নিজেকে তুলে ধরেছিলেন এই অভিনেতা। এর কারণ ছিল জসিমের অ্যাকশন দৃশ্যের নতুনত্ব।
ঢাকাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে চেনাজানা-পরিচিতির পরও জনপ্রিয়তার দেখা পেতে জসিমের সময় লেগে যায় আরো কয়েক বছর। ১৯৭৬ সালে নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’ দিয়ে জসিম পান দর্শকপ্রিয়তা।
ভারতের শোলের বাংলাদেশি সংস্করণের এই সিনেমায় খলনায়ক হিসেবে জসিমের অভিনয় সবার প্রশংসা কুড়ায়। আর নায়ক হিসেবে জসিম প্রথম হাজির হন সুভাষ দত্তের ‘সবুজ সাথী’ সিনেমায় ১৯৮২ সালে।
গ্লিটজকে নজরুল বলেন, “আশির দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে তখন নতুন ডাইমেনশন চালু হল। জসিমও ভিলেন চরিত্র থেকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। ‘সবুজ সাথী’, 'কুরবানি', 'কালিয়া', 'বাংলার নায়ক' এসব সিনেমায় নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন তিনি। সেসময় নায়ক হিসেবে রাজ্জাক, ওয়াসিম, আলমগীর, ফারুক ছিলেন। কিন্তু ভিলেন থেকে নায়ক হয়েও কীভাবে দর্শক ধরে রাখা যায় সেই গুণ জসিমের ছিল।"
১৯৫০ সালের ১৪ অগাস্ট ঢাকার নবাবগঞ্জের বক্সনগর গ্রামে জন্ম জসিমের। তার পুরো নাম আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। যুদ্ধে জসিমের সহযোদ্ধাদের একজন ছিলেন নজরুল।
মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে ‘দোস্ত দুশমন’সহ বিভিন্ন সিনেমায় অ্যাকশন ও ফাইটিং জসিমের মধ্যে ‘সহজাতভাবে’ এসেছিল বলে মনে করেন নজরুল।
“সিনেমার অ্যাকশনগুলো, ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য এসব আমরা যুদ্ধে সরাসরি দেখে এসেছি। তাই এই সিনেমার ফাইট অনেক সুন্দর হয়েছিল, ভারতেও প্রশংসা পেয়েছে। এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল সেসময় আড়াই কোটি টাকা ব্যবসা করেছিল।
“এছাড়া 'আসামী হাজির' সিনেমায় ডাকাত ধর্মা ও ডাকাত জগনুর ফাইট অর্থাৎ নায়ক ওয়াসিম ও জসিমের ফাইট দেখতে মানুষ হলে গেট ভেঙে ঢুকেছিল। তাদের ফাইট দেখে দর্শক হলেই হাত তালি আর চিৎকারে অন্যরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।“
শফী বিক্রমপুরী পরিচালিত 'রাজ দুলারী' সিনেমার গল্প লিখেছিলেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। সেই সিনেমায় জসিমকে ম্যান্ডোলিন বাজাতে হবে। জসিমের সাজ, লুক দেখে ঝন্টু তুলনা করলেন তামিল সিনেমার নায়ক শিবাজি গণেশনের সঙ্গে।
ঝন্টু গ্লিটজক বলেন, “শুটিং সেটে জসিমকে দেখে বলে ফেলি আপনাকে তামিলের 'সুহাগ' সিনেমার শিবাজির মত লাগছে। আরো বলেছিলাম, আমি যদি কখনো পরিচালক হই, তখন আপনাকে হিরো বানাব। জসিমও বলে উঠলেন দোয়া করি আপনি পরিচালক হন।,
ঝন্টু 'মোকাবেলা' সিনেমারও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন।
“ফখরুল হাসান বৈরাগীর পরিচালনায় ওই সেই সিনেমায়ও জসিম নায়ক হিসেবে খুব ভালো করেছেন।”
গল্পকার থেকে পরিচালকের ভূমিকায় ঝন্টু আসেন 'ওমর শরীফ' সিনেমা দিয়ে। সেখানে জসিমকে নায়ক বানিয়ে নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন ঝন্টু।
জসিম ও তার ফাইটিং দল
"জসিম আর আমি পাশাপাশি বাসায় থাকতাম, একসাথে লেখাপড়া, বড় হয়ে উঠা। পাকিস্তান আমলে মতিঝিলে জাপানি ইন্সট্রাক্টরের কাছে দুজন জুডো-কারাতে শিখেছিলাম, তখন থেকেই পরিকল্পনা ছিল সিনেমায় নেমে অ্যাকশন দৃশ্য পরিচালনা করব আমরা,” কথাগুলো বলছিলেন অভিনেতা জসিমের গড়ে তোলা ফাইটিং দল 'জ্যাম্বস' গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এনামুল করিম আমান।
শুরু কীভাবে জানতে চাইলে জসিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সহকর্মী আমান বলেন, “একাত্তরে দুই নম্বর সেক্টরে ঢাকা সিটি অপারেশনে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। যুদ্ধের পর বন্দুক জমা দিয়ে একেকজন একেক কাজের প্ল্যান করে।
“আমরা সিদ্ধান্ত নেই সিনেমায় যাব, অ্যাকশন দেখাব, যা আগেই ভেবেছিলাম আমরা৷ ফাইট ডিরেক্টর হিসেবে কীভাবে কাজ করা যায় সেটা খোঁজ করছিলাম। তখন আমার এক বন্ধু ছিল যে সিনেমায় যুক্ত ছিল। তার মাধ্যমেই শেখ লতিফ পরিচালিত ‘দেবর’ সিনেমায় কাজ পাই। আমাদের চলচ্চিত্র যাত্রা হল শুরু, সেখানে জসিম ফাইটিং শেখানোর পাশপাশি অভিনয় করনে।"
ষাট ও সত্তর দশকের জনপ্রিয় অভিনেতা আজিমের চোখে জসিমের ফাইটিং দক্ষতা ধরা পড়েছিল বলে জানান আমান।
“অভিনেতা আজিম জসিমকে তার অভিনীত ‘উৎসর্গ’ সিনেমায় যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেন। সিনেমাটি বানাচ্ছিলেন কবীর ঝন্টু। ওই সিনেমায় ফাইট ডিরেকশন এবং অভিনয়ে আমাদের দুজনকে নিলেন আজিম ভাই।"
নায়করাজ রাজ্জাকও জসিমকে এরপর ডেকে পাঠিয়েছিলেন বলে জানান আমান।
"'উৎসর্গ' সিনেমার ফাইট ডিরেকশন দেখে রাজ্জাক ভাই আজিম ভাইকে কল দিয়ে বলেছিলেন যে তার সিনেমায় যেন আমাদের (জসিম ও আমান) নেওয়া হয়।”
এফডিসিতে তখন সিনেমার ফাইট ডিরেকশনের জন্য জসিম, আমান এবং রুহুল আমিন বাবুলের নিয়মিত ডাক পড়ত।
ফাইটিংয়ের ‘জ্যাম্বস গ্রুপ’ গড়ে তোলার ইতিহাস বর্ণনা করে আমান বলেন, “'উৎসর্গ' সিনেমা মুক্তির পর 'এখানে আকাশ নীল' সিনেমার শুটিংয়ে আমরা কক্সবাজার গেলাম। সেখানে গিয়ে মাহবুব খান গুইকে পেলাম। এরপর আমরা চারজন এক হলাম এবং ফাইট ডিরেকশন এবং ফাইটার তৈরি করার জন্য ১৯৭৪ সালে খুললাম ‘জ্যাম্বস গ্রুপ’।
“সবার নামের প্রথম অক্ষরের সঙ্গে ‘এস’ যোগ করে দিয়ে গ্রুপের এই নামকরণ করা হয়। গুলিস্তানের অফিস নিলাম। একের পর এক অ্যাকশন সিনেমা হতে লাগল, এত ব্যস্ত হয়ে গেলাম শিডিউল দিয়ে শেষ করতে পারি না।”
আমানের ভাষ্য, জসিমের নেতৃত্বে ‘জ্যাম্বস গ্রুপ’ থেকে প্রায় দুইশ ফাইটার তৈরি হয়েছিল। যারা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। ফাইটারদের মধ্যে যারা ওই সময় বয়সে ছোট ছিলেন তাদের জন্য জসিম খুলে দিয়েছিলেন 'জুনিয়র জ্যাম্বস। এই জুনিয়র জ্যাম্বসে আতিকুর রহমান চুন্নু, আমীর ফকির, আওলাদ, হানিফ চাচা, দেলোয়ার, শেখ জামালসহ প্রায় ১০ জনের মত সদস্য ছিলেন।
'জসিম ওস্তাদ'কে নিয়ে গ্লিটজের কাছে স্মৃতিচারণ করেন ফাইট ডিরেক্টর আতিকুর রহমান চুন্নু। তিনি 'জুনিয়র জ্যাম্বস'র সদস্য ছিলেন।
জসিম কাজ শেখাতেন কীভাবে প্রশ্নে জবাবে চুন্নু বলেন, "জসিম ওস্তাদ বেঁচে থাকতে সকাল, বিকাল, দুপুর একচেটিয়া কাজ চলত আমাদের। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে এফডিসির কড়ইতলায় আমাদের ফাইট শিখাতেন। কীভাবে বাস্তবধর্মী করা যায়, কোন কৌশলে কাজ করতে হয় সব তিনিই শিখিয়েছেন।
“ওস্তাদ শুটিং সেটে স্যান্ডেল পরে আসা পছন্দ করতেন না, কাউকে স্যান্ডেল পরা দেখেলেই টাকা দিয়ে বলতেন, ‘আগে জুতা কিনে নিয়ে আসো, তারপর কাজ’। মানুষের বিপদে প্রয়োজনে উনি চুপচাপ সাহয্য করতেন। আমরা যারা উনার ছাত্র ছিলাম, আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপে উনি নজর রাখতেন। লাফ, ঝাঁপ, ফাইটিং করতে গিয়ে যেন বিপদ না হয় নজর দিতেন।”
জসিমের মৃত্যুর পর এফডিসির ২ নম্বর ফ্লোরকে 'জসিম ফ্লোর' নাম দেওয়া হয়। তবে এই ফ্লোরের দেয়ালে শুধু তার নামফলক রয়েছে, ভেতরে কোনো কক্ষের দেয়ালে এই নায়কের কোনো ছবি দেখা যায়নি।
জসিমের স্মৃতি ও কাজ ধরে রাখতে ‘অবহেলা’ আছে বলে আক্ষেপ ঝরেছে জ্যাম্বসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আমানের কথায়।
"জসিমকে স্মরণ করে আসলে কিছুই করা হয় না। পত্রপত্রিকায় লেখা থাকে না। কোথাও একটা সিনেমাও দেখানো হয় না। একটা শুটিং ফ্লোর করে রেখেছে, সেটার অবস্থাও করুণ।”
'জ্যাম্বস গ্রুপ' ধরে রাখা হল না কেন জানতে চাইলে আমান বলেন, "জসিম মারা যাওয়ার পরে তার সব কিছু দেখাশোনার দায়িত্ব আমার উপর এসে পড়ে। গ্রুপ ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। আর প্রোডাকশন হলো না।”
দিনে দিনে দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির অবস্থাও ‘দুর্বল’ হয়ে যাওয়ায় এই গ্রুপ তেমন কাজে আসত বলে মনে করেন না আমান।