কালজয়ী অনেক গানই নকল: শওকত আলী ইমন

সম্প্রতি ঘোষিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৩র সেরা সংগীত পরিচালক হিসেব নির্বাচিত হয়েছেন শওকত আলী ইমন। 

তানজিল আহমেদ জনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 March 2015, 06:38 AM
Updated : 29 March 2015, 06:47 AM

‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’ সিনেমার জন্য এই স্বীকৃতি পেলেন তিনি। সম্প্রতি গ্লিটজের ক্যারিয়ার ও বাংলাদেশের সংগীত জগত নিয়ে নানা আলাপ করলেন তিনি।

গ্লিটজ : শুরুতেই অভিনন্দন জানাই। আবারও শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কারটি পেতে চলেছেন। কেমন লাগছে ?

ইমন : পুরস্কার সবসময়ই অনুপ্রেরণার।  আমি সবসময়ই নিজের সেরাটি দিতে চেষ্টা করি।কোনো পুরস্কারের কথা ভেবে কাজ করি না আমি। আমার গান শ্রোতার হৃদয় ছুঁতে পারলে সেটাই আমার বড় পুরস্কার।শ্রোতারা যখন গুনগুনিয়ে আমার কম্পোজকরা গানগুলো গায়, তাই আমার ভালো লাগার।শ্রোতার ভালো লাগার চেয়ে বড় পুরস্কার কিছু নেই আমার।

হ্যাঁ, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অবশ্যই আমার জন্য বড় প্রাপ্তি।সম্মানিত জুরি বোর্ড আমার গানটিকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন।তাদের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।  

গ্লিটজ: অন্য প্রসঙ্গে আসি। বতর্মানে আমাদের অডিও শিল্প কেমন অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করছেন?

ইমন: ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পযর্ন্ত অডিও বাজার রমরমা হলেও এখন সেই অবস্থান নেই।তাছাড়া কোনো একটি অ্যালবাম রিলিজের কিছুক্ষণের মধ্যে ইন্টারনেটে এর পাইরেটেড কপি ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে পাইরেসির কারনে আমাদের অডিও শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।তবে বিগত কয়েক বছরে ‘ভালোবাসার রঙ’, ‘হানিমুন,’  ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’,‘ভালোবাসা আজকাল’ ইত্যাদি সিনেমার গানগুলো ভালো হওয়ার কারণে আগামীতে সিনেমার গানের অডিও বাজার ভালোর দিকে যাওয়ার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

গ্লিটজ: অনেক গীতিকারের গানের কথা ভালো। কিন্তু সুর করার পরে সেই গানটা আর হৃদয় ছুঁতে পারছে না। তাহলে আপনি কি মনে করেন আমাদের দেশে ভালো সুরকার নেই?

ইমন:  আমাদের দেশে ভালো কম্পোজারের আসলেই ঘাটতি রয়েছে। বতর্মানে যারা গানের কম্পোজিশন করছে তাদের অভিজ্ঞতায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কেউ হুবহু ‘কপি-পেষ্ট’ করেই যাচ্ছে, আবার নতুন অনেকেই কাজ করছে যাদের কাজে আসলেই ভিন্নতা পাচ্ছি না।

গ্লিটজ: বতর্মানে আমাদের গানের জগতে মানসম্মত কাজ না হওয়ার পেছনে কোন কারণটি রয়েছে বলে মনে করেন?

ইমন: আগে শিল্পী কম ছিলো কিন্তু মানসম্মত কাজের সংখ্যা ছিলো বেশি। আর এখন শিল্পীর সংখ্যা আগের চেয়ে বহুগুনে বেড়ে যাওয়ার কারনে মানসম্মত কাজের পরিমান কমে গেছে।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অযোগ্য ছেলেমেয়েরা কাজ করছে।যাদের বেশিরভাগই গানের কিছুই না জেনে ইন্টারনেট থেকে কোনো গানের নকল করে একটি কম্পিউটার নিয়ে বসে হুট করেই গায়ক, গীতিকার ও কম্পোজার বনে যাচ্ছে। এদের অনেকেই মিডিয়ার সহযোগিতায় রাতারাতি তারকাও বনে যাচ্ছে।

গ্লিটজ: নব্বইয়ের দশকের গানগুলো আজও সবার মুখে মুখে ফেরে, কিন্তু এখনকার সময়ের গানগুলোর স্থায়িত্ব কম কেন?

ছবি: তানজিল আহমেদ জনি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ইমন:
আমাদের সময় আমরা প্রচুর গান শুনতাম। সংগীতের অনেক গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি।কিন্তু এখনকার সময়কার ছেলেমেয়েদের গান শোনার আগ্রহ নেই। ওরা সংগীতের বেশি গভীরেও যেতে পারছে না। তবে অনেকেই আবার কিছু কিছু ভালো গান করছে।

গ্লিটজ: এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কি?

ইমন: বাংলা সিনেমার জন্য যেমন সেন্সর বোর্ড রয়েছে তেমনি যত দ্রুত সম্ভব অডিও কন্ট্রোল বোর্ড তৈরি করা দরকার। তাহলেই কেবল মানসম্মত গানগুলো টিকে থাকবে।

গ্লিটজ: সাম্প্রতিককালে ঢাকাই সিনেমায় দক্ষিন ভারতীয় সিনেমার অনেক গানের হুবহু নকল করা হচ্ছে। এই বিষয়টি আমাদের ঢাকাই সিনেমার গানের বাজারকে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ করছে বলে আপনি মনে করেন?

ইমন: যার ভিতরে কোন ধরনের ক্রিয়েটিভিটি নেই তারা এমন কপি-পেষ্টের কাজ তো করবেই। আর যারাই এসব গানগুলোর গীতিকার হিসেবে কাজ করছে হয়তো তাদের কোনো কাজ নেই কিংবা সৃষ্টিশীল কিছু লেখার যোগ্যতা নেই।

আমাদের দেশে ৭০,৮০ ও ৯০ এর দশকে প্রচুর নকল গান হয়েছে কিন্তু তখন মানুষ জানতো না।বাংলাদেশের কালজয়ী অনেক গান আছে যেগুলো নকল গান।

কিন্তু এখন মানুষ গ্লোবালাইজেশনের যুগে সহজেই জেনে যায় কোন গানটি নকল। শিক্ষিত লোকও নকল করে। কিন্তু আমাদের অগ্রজরা শিক্ষিত ছিলেন তাই তারা জেনে কাজটি করেছেন। আর এখনকার এরা অশিক্ষিত যারা না জেনেই নকল করছেন।

গ্লিটজ: আপনি তো অনেক সিনেমার আইটেম গানের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। সেক্ষেত্রে এখনকার আইটেম গানগুলোকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

ইমন: সিনেমাতে সবসময় একটা বিনোদন লাগেই। সিনেমাতে অনেক আগে থেকেই আইটেম গানের প্রচলন ছিলো। তখন সেটাকে বলা হতো ক্যাবারে সং। সেই ক্যাবারে সং-এর নতুন রুপ হলো আইটেম গান। বলিউড ও টালিউডেও যার প্রচলন রয়েছে।

গ্লিটজ: ২০০২-এর পর থেকে আপনি ঢাকাই সিনেমায় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আবার ২০০৭ সালে ফিরে আসার নেপথ্যের কারণ কি ছিলো?

ইমন: এর অন্যতম কারন হলো ২০০২ সালের পরেই ঢাকাই সিনেমায় অশ্লীলতার ছোঁয়া লাগা শুরু হয়েছিলো। তাই সেই সময়টায় আমি পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু বাংলা সিনেমায় কাজ করেছি।পরবর্তীতে ২০০৭ সালে ‘এক টাকার বউ’, ‘বলবো কথা বাসর ঘরে' ইত্যাদি সিনেমায় কাজের মাধ্যমে আবারো ঢাকাই সিনেমায় কাজ শুরু করি।

গ্লিটজ: আপনি তো একটি রিয়ালিটি শোয়ের বিচারক ছিলেন। এসব শোর মাধ্যমে আমরা আদৌ কি মানসম্মত শিল্পী পাচ্ছি?

ইমন: রিয়েলিটি শোয়ের মতো প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কখনো শিল্পী তৈরি হয় না। এ পযর্ন্ত প্রায় ৪০টি রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে প্রায় চার শতাধিক শিল্পী বেড়িয়ে এসেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র হাতে গোনা পাঁচ-ছয়জন শিল্পী বাজারে টিকে আছে আর বাকিরা  হারিয়ে গিয়েছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে মানসম্মত শিল্পীরা বেড়িয়ে আসছে না।

গ্লিটজ: তাহলে এক্ষেত্রে ব্যর্থতা কার?

ইমন: এসব প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হঠাৎ করেই কাউকে একটি অবস্থানে বসিয়ে দেওয়া হয়।যেখানে টিকে থাকার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতাটাও নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাবলিক সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে এসএমএসেরমাধ্যমে প্রতিযোগীদের কয়েকজনকে বিজয়ী করা হয়। যেখানে এসব প্রতিযোগীদের ভবিষৎ নিয়ে আয়োজক টিভি চ্যানেলগুলোর কোনো পরিকল্পনাই থাকে না। এই পুরো বিষয়টাই হলো চানেলগুলোর ব্যবসা।

গ্লিটজ: এখন ব্যস্ততা কি নিয়ে?

ইমন: আমি মূলত সিনেমার কাজগুলোই বেশি করে থাকি। তবে এর বাইরে এখন কণার নতুন অ্যালবামের চারটি গানের মধ্যে একটি ও আঁখি আলমগীরের একটি গানের কাজ করছি। আর সিনেমার ক্ষেত্রে এখন 'অগ্নি-২' সিনেমার জন্য দুটি গান করছি। এছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি সিনেমার কাজের প্রস্তাব হাতে রয়েছে।