এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হুমায়ূন আহমেদ

হিমু, শুভ্র, বাকের ভাই, মির্জা সাহেব, কুসুম-- এমন অনেক চরিত্র বইয়ের পাতা, টেলিভিশনের পর্দা কিংবা সেলুলয়েড থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের মানুষের আপনজন হয়ে উঠেছে। এদের মাঝেই নিজের অস্তিত্বের ছাপ রেখে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ৬৩ বছর বয়সে চলে গেছেন হুমায়ুন আহমেদ।

শান্তা মারিয়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2014, 06:22 AM
Updated : 20 July 2014, 07:29 AM

তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ অবলম্বনে সত্তরের দশকে নির্মিত হয় টিভি নাটক। নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বুলবুল আহমেদ, আল মনসুর, মিতা চৌধুরী। আশির দশকে হুমায়ূন আহমেদ টেলিভিশনের জন্য নিয়মিত নাটক লেখা শুরু করেন। টিভির জন্য লেখা তার প্রথম নাটক ‘প্রথম প্রহর’ ১৯৮৩ সালে প্রচারিত হয়। নাটকটির প্রযোজক ছিলেন নওয়াজীশ আলী খান।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিন রাত্রি’। এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছিলেন বুলবুল আহমেদ, ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর, লুৎফুন্নাহার লতা। 

‘এই সব দিন রাত্রি’র ব্যাপক জনপ্রিয়তার পর হুমায়ূন আহমেদ লেখা ‘বহুব্রীহি’ ধারাবাহিক নাটকটি প্রচারিত হয়। নাটকের সোবহান সাহেব, পাকুন্দার এমদাদ খোন্দকার, মামা ও কাদের চরিত্রগুলো আজও দর্শকের মনে জায়গা ধরে রেখেছে। এ ধারাবাহিকে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত, আবুল খায়ের, আসাদুজ্জামান নূর, আলী জাকের, লুৎফুন্নাহার লতা, আফজাল শরীফ, আফজাল হোসেন, আলেয়া ফেরদৌসী, দীপা ইসলাম।

হুমায়ূন আহমেদ পরিচলিত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের দৃশ্যে আসাদুজ্জামান নূর,আব্দুল কাদের ও লুৎফর রহমান জর্জ।

এরপরই বলতে হয় ‘অয়োময়’-এর কথা। এ নাটকের মির্জা সাহেব চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর ছিলেন অনবদ্য। অভিনয়ে আরও ছিলেন লাকী ইনাম, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, সুবর্ণা মুস্তাফা, মোজাম্মেল হোসেন।

‘কোথাও কেউ নেই’ সম্ভবত বাংলাদেশের ছোটপর্দার নাটকের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় হওয়ার খেতাব পাবে। বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল জনপ্রিয়তা পান আসাদুজ্জামান নূর। মুনা চরিত্রে সুবর্ণা মুস্তাফা ছিলেন অতুলনীয়। ধারাবাহিকটির শেষে নির্দোষ বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসি বন্ধের দাবীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল করে দর্শক। কোনো নাটকের ঘটনা নিয়ে জনজীবনে এমন উত্তেজনা ও আবেগ বাংলাদেশে কখনও কখনও দেখা যায়নি। এ নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা, আবদুল কাদের, মাহফুজ আহমেদ, আবুল খায়ের, হুমায়ূন ফরিদী, আফসানা মিমি, মোজাম্মেল হোসেন।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা আরও কয়েকটি ধারাবাহিক নাটক হল, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’, ‘সবুজ সাথী’, ‘উড়ে যায় বকপঙ্খী’, ‘এই মেঘ এই রৌদ্র’ । এক পর্বের  অসংখ্য নাটক লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। সেগুলোও জনপ্রিয় হয়েছে বিপুলভাবে। তার লেখা নাটকের মধ্যে ‘খেলা’, ‘অচিন বৃক্ষ’, ‘খাদক’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘অন্যভুবন’ দর্শকমনে চিরস্থায়ী হয়ে আছে।

নব্বইয়ের দশকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন হুমায়ূন আহমেদ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। 

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তখন অশ্লীলতা হানা দিয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ তার সিনেমার মাধ্যমে দর্শককে উপহার দিলেন সুস্থ রুচির কাহিনি ও স্বাভাবিক অভিনয়। হুমায়ূন আহমেদের সব চলচ্চিত্রেরই কাহিনি তার নিজের। চিত্রনাট্য,পরিচালনা ও প্রযোজনাও তার নিজের। অধিকাংশ চলচ্চিত্রের গানও তারই লেখা।

তার পরিচালনায় প্রথম সিনেমা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আগুনের পরশমণি’। আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত ও বিপাশা হায়াত অভিনীত এ ছবিটি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য চিত্রায়ন হিসেবে দর্শক মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। বহু বছর পর শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত দর্শক আবার হলমুখী হন। ‘আগুনের পরশমণি’ সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালনাসহ আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এ ছবির জন্য হুমায়ূন আহমেদ কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা এবং প্রযোজক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান।

২০০০ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। ছবিটি সাতটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। চলচ্চিত্রটি একদিকে যেমন দারুণ ব্যবসা সফল হয় তেমনি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের দৃষ্টিতে শিল্পসম্মত হিসেবে বিবেচিত হয়। জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, আনোয়ারা, গোলাম মুস্তাফা, শীলা আহমেদ অভিনীত চলচ্চিত্রটিকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের মাইল ফলক রূপে বিবেচনা করা হয়। সুবীর নন্দী ও বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে এই চলচ্চিত্রের গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’, ‘সোয়াচান পাখি, ‘আমার প্রাণে যত দুঃখ সয়’ ইত্যাদি গান এখনও বাংলাদেশের জনপ্রিয় গানের তালিকায় রয়েছে।

২০০১ সালে মুক্তি পায় ‘দুই দুয়ারী’। রিয়াজ, মাহফুজ আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন অভিনীত এ ছবিটিও দারুণ ব্যবসা সফল হয়। এ চলচ্চিত্রের জন্য রিয়াজ ২০০০ সালের সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এবং এ ছবির ‘বর্ষার প্রথম দিনে’ গানটির জন্য সাবিনা ইয়াসমিন সেরা নারী কণ্ঠশিল্পীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

২০০৩ সালে মুক্তি পায় ‘চন্দ্রকথা’। আসাদুজ্জামান নূর, আহমেদ রুবেল ও শাওন অভিনীত এ চলচ্চিত্রটিও ব্যবসা সফল হয় এবং সমালোচকদের প্রশংসা পায়। এ চলচ্চিত্রের ‘উড়াল পংখী রে’ এবং ‘চাঁদনি পসর রাতে’ গান দুটি দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

 ২০০৪ সালে মুক্তি পায় ‘শ্যামল ছায়া' চলচ্চিত্রটি। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়।

‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ মুক্তি পায় ২০০৭ সালে।

২০০৮ সালে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রটি। ফেরদৌস, মীম, জাহিদ হাসান ও মেহের আফরোজ শাওন অভিনীত এ ছবিটিও ব্যবসা সফল ও দর্শক নন্দিত হয়। সমালোচকদের প্রশংসাও অর্জন করে। ছবিটি দুটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।

২০১২ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় নির্মিত সর্বশেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। হুমায়ূন আহমেদ এ ছবির বিশেষ প্রদর্শনী উপলক্ষে শেষবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় ফেরেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন। 

‘ঘেটুপুত্র কমলা’র জন্য হুমায়ূন আহমেদ ২০১২ সালের শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবেও পুরস্কার পান তিনি। সিনেমাটি ৮টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার পায়। এ ছবির জন্য মামুন শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী এবং ইমন সাহা শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার পান। সিনেমাটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং সমালোচকদের প্রশংসা পায়। ২০১২ সালে ৮৫ তম অস্কারে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে বাংলাদেশ থেকে প্রতিযোগিতা করে ঘেটুপুত্র কমলা।

এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’, ‘শংখনীল কারাগার’, ‘নিরন্তর’, ‘দূরত্ব’, ‘সাজঘর’ ও ‘দারুচিনি দ্বীপ’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। ১৯৯২ সালে তিনি ‘শংখনীল কারাগার’ ছবির কাহিনিকার এবং ২০০৭ সালে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।